আমার সখা নরসুন্দা : মু আ লতিফ

আমার সখা নরসুন্দা

।। মু আ লতিফ ।।

[প্রথম পর্ব] নরসুন্দা নদীর সঙ্গে আমার জন্মাবধি ভালোবাসা। আমার শৈশব-কৈশোর নরসুন্দার জল, জলের স্রােতধারা ও এর বালুচরের সঙ্গে মিশে আছে। নদীর নিরবধি বয়ে চলা, বর্ষায় টই-টম্বুর খরস্রােতা নরসুন্দার ছবি এখনো আমাকে উন্মনা করে। আমার শরীর-মন ও আমার চৈতন্যকে বিকশিত করেছে- আমার সখা নরসুন্দা। ছেলেবেলায় যে নরসুন্দাকে দেখেছি এখনো সেই স্মৃতিই মানসপটে আঁকা রয়েছে। খরস্রােতা যৌবনা নরসুন্দার কল্লোলধ্বনি এখনো কানে বাজে। ওই সময়ের নরসুন্দার শোভার কথা বললে এখন কেউ বিশ্বাস করবে না, জানি। কিন্তু ছেলেবেলার রোমাঞ্চকর স্মৃতি তো ভুলার নয়। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, সুখময় সেই স্মৃতিই আমার মনের আয়নায় বেঁচে থাক।

আমি একসময় ‘নরসুন্দা’ নামে একটি পত্রিকা করেছিলাম। এ পত্রিকায় ‘নরসুন্দা একটি নদীর নাম’ শিরোনামে নিয়মিত ফিচার লিখতাম। সেখানে নরসুন্দার ছবি আঁকতাম মনের উচ্ছাস আর আবেগের আতিশয্যে। ছবি আঁকতাম জন্মভূমি কিশোরগঞ্জের মাটি ও মানুষের। প্রবাহমান নরসুন্দার জলধারা ও পলিমাটির পরশেই পত্তন হয়েছে এ জনপদের। কিশোরগঞ্জ ও নরসুন্দা তাই তো পরিপূরক একে অপরের। এ যেন জমজ দু’ভাই: সুখ-দুঃখের সমভাগী।

নরসুন্দা কিশোরগঞ্জ শহরের বুকচিরে বয়ে গেছে। আজকের এই যে ঝলমল কিশোরগঞ্জ, এর শুরুটা হয়েছিল এ নদীকে ঘিরেই। সুদূর কোনো অতীতে এ নদীকে ঘিরেই জনবসতির সৃজন ও অবশেষে এ শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। তখন নদীই ছিল এ শহরের প্রাণ। প্রবাহমান নদীর মতই ছিল এখানকার মানুষের ছন্দোময় জীবন। বর্ষায় টলমল জল, পালতোলা নৌকার চলাচল আর নদীর ঘাটে ঘাটে নৌকায় সন্ধ্যাপ্রদীপের আলোর ঝিকিমিকি জলের উপর খেলা করত। চন্দ্রিমা রাতে অপরূপ চাঁদ জলে ঢেউ খেলতো।

এ নদীর সঙ্গে এখানকার মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। শুধু কী আবেগ- আবেগের সঙ্গে রয়েছে স্বপ্নও। এ স্বপ্নের ডালপালা চারদিক বিস্তৃত। কারণ নদী মানেই বাংলাদেশ। নদী ছাড়া বাংলাকে কল্পনা করা যায় না। বাংলার বৈশিষ্ট্যই নদী। যত ইতিহাস-উপাখ্যান এবং ঐতিহ্য সবই নদীকে ঘিরে। বিখ্যাত মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া-মলুয়া ও কেনারামসহ সব পালাগানই রচিত হয়েছে নদীর পটভূমি ও সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিকে উপজীব্য করে। নদীই আমাদের জীবন- নদী ছাড়া আমরা বাঁচি না। নদী ব্যতীত আমাদের জীবন ধুসর- মরুভূমির মত।

কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে লেখক মু আ লতিফ
কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে লেখক মু আ লতিফ। ছবি- রিভার বাংলা

নরসুন্দার স্রােত পশ্চিম থেকে পূবে বয়ে যেত। শহরের পাগলা মসজিদের আরো পশ্চিম থেকে অর্থাৎ হোসেনপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে কলকল, ছলছল রবে জলের ধারা বয়ে আসতো পূবে। নদীর দু’ধারের সবুজ-শ্যামলিমায় অপরূপ গ্রামগুলো মন জুড়িয়ে দিত। নদীর এখানে ওখানে খড়াজাল দিয়ে মাছ ধরতো জেলেরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নদীতে কলা গাছ নিয়ে সাঁতার কাটতো ও খেলা করতো। শহরের কাচারি বাজারের পেছনে নদীতে গভীর কুড় ছিল। প্রচুর মাছের বংশ ছিল এ কুড়ে। গৌরাঙ্গবাজার জ্ঞানাদাসুন্দরী ব্রীজের পূর্বেও কুড় ছিল। বর্ষাকালে নদী আরো প্রসস্থ হয়ে যেত। নদীর দুকূল উপচে পড়তো। শহরের আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের রাস্তার দক্ষিণ পাশটা তখন ফাঁকা ছিল। কোনো দোকান বা স্থাপনা ছিল না। তখন বর্ষায় নদীর পানি রাস্তা ঘেষে কলকল করতো। ঝুলন ও রথযাত্রার সময় রাস্তার পাশ ঘেষে প্রচুর বজরা এখানে নোঙর করা হতো। নানা বাহারি নৌকা। হাওরের মানুষ এসব বজরায় শহরে আসতেন। অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও নদী পথে নানা প্রয়োজনে শহরে আসা যাওয়া করতেন। রাতের বেলায় বজরাগুলোয় জ্বালানো প্রদীপের আলো এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করতো। প্রদীপের আলো নদীর জ্বলে খেলা করতো।

এখনো এসব মনে হলে বেশ নষ্টালজিয়াই ভোগী।আজ সব অতীত। এর কোনই অস্থিত্ব নেই। আজ নদীতে স্রােত নেই-কুড় নেই, মাছ নেই, আজ নেই নদীও। নদী দখল হচ্ছে। অবাদে নদীতে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। নদীতে কচুরিপানার প্রবল আধিপত্য বিস্তার করে যতসামান্য অবশিষ্ট পানিকেও ঢেকে দিয়েছে। নদীর কচুরিপানা বা বর্জ্য পরিস্কার করার কোনো উদ্যোগ নেই। এ নদীর যেন কোনো মালিকও নেই। অথচ নদী হচ্ছে বিশ্বমানবতার সম্পদ। নদী, জলাশয়, বায়ু সবই হচ্ছে অহস্তান্তরযোগ্য সম্পদ যা- সর্বদাই রাষ্ট্রের।

বাঙালির ভাষা যদি বাংলা না থাকে- বাঙালি থাকে না। নদীর দেশে নদী না থাকলে কি হয়? পাশ্চাত্যের আদলে আধুনিকতার (?) নামে আমাদের যারা স্বপ্ন দেখাতে চায়- তারা আসলে কি চায়? তারা মূলত আমাদের স্বপ্নকেই চুরমার করতে উদ্যত। নদীকে যারা হত্যা করেছে- আর যাই হোক বাঙালির বন্ধু নয়। আমরা স্রােতস্বিনী নদী চাই। আমরা নদীপথে যাতায়ত করতে চাই। সড়ক, রেলপথের ন্যায় আমাদের বাণিজ্য চলবে নদী পথেও। আমাদের নদীই হবে উন্নয়নের রোলমডেল। নরসুন্দা ও ব্রহ্মপুত্রসহ নদী আমাদের দেশের প্রাণপ্রবাহের উৎস।

আমাদের হাওরে গেলে আমরা মাটি ও পানির গুরুত্ব বুঝি। অথৈ জল চারদিকে। শুধু পানি আর পানি। এই পানির উপর ভেসে আছে গ্রামের পর গ্রামগুলি। নৌকায় চড়ে যাতায়ত করছে গ্রামের সাহসী মানুষ। ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঢেউয়ের মধ্যে তাদের বসবাস। বর্ষাকালে হাওরের এক রূপ আবার শীতকালে পানিশূন্য চারদিক। গ্রামকে ঘিরে আঁকাবাঁকা নদী ও জলাভূমি। নদী-নালা,খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ। নদীর প্রবাহের সাথে এখানকার মানুষের জীবন প্রবাহ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নদী নেই তো হৃদয়ে প্রবাহ নেই। নদী মরে যাওয়া যেন জীবন অচল হয়ে যাওয়া। তাই নরসুন্দার দুর্দশায় এখানকার মানুষের হৃদয়ে এত রক্তক্ষরণ, এত হাহাকার। একসময় নরসুন্দার দখলমুক্ত ও নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবিতে কিশোরগঞ্জের মানুষ আন্দোলন করেছেন। এখানকার সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও মানববন্ধন ও মিছিল করে সরকারের কাছে নরসুন্দাকে বাঁচাতে আহবান জানিয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। নরসুন্দাকে রক্ষা করা যায়নি।

শুধু নদী নয়। আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশকেও ধ্বংস করে চলেছি। নৈসর্গিক সৌন্দর্য, ফুল, পাখি, বৃক্ষরাজি, আকাশ, মাটি, পাহাড় ও নদীর ঐশ্বর্য ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। ফুলের সুরভি ও সৌন্দর্য, পাখির কলকাকলি, নদীর কলতান, পাহাড়ের মৌনতা, আকাশের বিশালতা এবং বৃক্ষরাজির অকৃপণ সিগ্ধতা, সুশোভিত ও অপূর্ব দৃশ্যাবলি আমাদের কঠিন হৃদয়েও প্রাণের উদ্রেক করে। তারপরও আমরা অবলীলায় ধ্বংস করছি এসব সম্পদ।

লেখক পরিচিতি: মু আ লতিফ, সাংবাদিক, লেখক ও আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংগ্রাহক।

আরো পড়তে পারেন….

কাশিয়া খাঁড়ি খনন-একটা উদাহরণ : এবার প্রশাসনিক উদ্যোগ প্রয়োজন

কর্ণফুলী নদীর তীরে দ্বিতীয় দিনের মতো উচ্ছেদ অভিযান চলছে

ভারতে গঙ্গা রক্ষায় অনশন, ধর্ণা অবস্থান অনুষ্ঠিত

সংশ্লিষ্ট বিষয়