গল্প : পদ্মার সাথে বিনিদ্র বাসর

গল্প

উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে স্নাতকের করিডোরে পা রাখলো অমিত। স্কুল-কলেজের সেরা ছাত্র সে। এরইমধ্যে প্রাচ্যের একটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার জুনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরির দরখাস্ত করেছিল। কলমের জোরে নিয়োগপত্র ও দ্রুত চলে আসে। যৌথ পরিবারের সবাই খুশি। এতো ভাল চাকুরী সহজে মিলে না। অমিত নিয়োগপ্রাপ্ত হয় ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল জেলায়। ২০০৩ সালে তখন বরিশাল জেলা ছিলো। ছামান গোছগাছ করে নিয়োগপত্র সংঙ্গে করে নরসুন্দাপাড়ের অমিত পাড়ি দিলো ধানসিঁড়ির উদ্দেশ্যে। ঢাকার সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা হয়ে পদ্মার উপর দিয়ে সারারাত লঞ্চে বরিশাল। নভেম্বরের মাঝামাঝি শীতল পদ্মার বুকে পারাবত-১ নামক লঞ্চটির ছুটে চলা ও আলাওলের পদ্মাবতীর পুঁথিপাঠের আসর মনে সাড়া দিলো অমিতের। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। বিলাস কেবিনে অমিত শরতের জোস্নারাতে পদ্মার সাথে বাসর রচনা করবে। বাসরঘরে নীরব নিথর পল্লীবধূর মতো পদ্মার বুকের জল। কলকল শব্দে ছুটে চলা পারাবতের চাকা। হৃদয় মুছড়ে উঠে তবু মুখ ফোঁটে না। ঘোমটাতোলে করে বর বলবে প্রথম কথা? ঢেউ আঁছড়ে কূলে পড়বে দুটি নয়ন দিয়ে আর বলবে ওগো প্রাণনাথ!

এটাই ছিল অমিতের জীবনের লম্বা নৌ-ভ্রমন। ঢাকা থেকে বরিশাল। সারারাত নির্ঘোম পদ্মার সহযাত্রী। রাত নয়টায় লঞ্চ ছাড়লো। মায়ের দেয়া মুড়ি- মুড়কি আর হরেকরকম পিঠাপুলি দিয়ে রাতের খাবার সারলো অমিত। পারাবতের প্রথম তলায় অভিসার যাত্রীদের গিজগিজ আর পাটাতনে খবরের কাগজ বিছিয়ে যাত্রীদের জামাতের সহিত নিদ্রা। দ্বিতীয় তলায় মধ্যবিত্ত শ্রেনীর গোছগাছ সহাবস্থান যাত্রীদের। তৃতীয়তলায় বিলাসী কেবিনের সমাহার। জানালার ফাঁকে পদ্মার সবকিছু দেখা, খোলা আকাশ দেখা সবি সম্ভব। চতুর্থতলায় কেবিন ক্রু আর সারেংদের আবাসিক কলোনী আর খোলা ছাদ। সবকিছু ঘুরে ফিরে দেখে অমিত নিজের কেবিনে ফিরে এলো। রাত থমথম গহীনের দিকে। অমিতের বিশাল পদ্মারবুকে মনটা ছড়িয়ে দিলো। দৃষ্টির সীমানা আর মনের আঙ্গিনায় পদ্মার রূপযৌবন দেখা আর নদী ও নারীর ভাবনায় সমার্থক হৃদয় অমিতের। ভাবনার রেশ আর অবগাহনের লেশ একি করিৎকর্মা করে তোলেছে তার মনটাকে? নদী সর্বনাশা? নাকি নারী সর্বনাশা? অযুত লক্ষ নিযুত কোটি ভাবনার দিগন্ত। কিসের জন্য পাহাড় ধেয়ে নেমে আসে নদী? তীরে বসতি গড়ে মানবজাতি। বুকের ছাতিভেংগে পথে বসায় আবার সুফলা করে সমতল। আশায় বুকবাঁধে মানুষ। আবার বসতি গড়ে মানুষ। আত্মার স্বত্তা নাকি মানবের তরে স্বত্তার্পন। একি খেলা মানবস্বত্তা নিয়ে নদী ও নারীর?

আফজল হোসেন আজম এর গল্প- ‘পদ্মার সাথে বিনিদ্র বাসর’
উদরে ধরে আবার শিশুকালে লালন-পালন করে বড় করে সেতো আর কেউ না মা। যিনি একজন নারী। মধ্যবয়সে কামসাগরের মোহনায় নোঙ্গর ফেলে প্রতিটা পুরুষ যার কাছে সেতো একজন নারীই। আর বার্ধক্যে সেবা সময় সঙ্গ দেয় সেতো মেয়ে, পুত্রবধূ, নাতিনী যেই হোক না কেন? নারীই বটে। সেজন্যেই পুরুষ শব্দটি বিচিত্র অলংকারিক। আর নারী অলংকারিক নামে নয় গাত্রে। নদ-নদীর বেলায় তাই। স্বত্তার সাবিত্রী সে এ ধরিত্রীর। শরাব সাকিতে ভরা যৌবনে একূল ভাংগে আর ওকূল গড়ে। স্রষ্টার অপার লীলা। ভাবনার অতলে হারিয়ে যাচ্ছে অমিত। ঘুমে ঢলে পড়বে। অকস্মাৎ হাইতোলে তাকালো অমিত। ঘড়িরকাটা রাত তিনটা। নাহ ঘুমালে চলবে না। পদ্মার সাথে বাসর আজ। তার মান ভাঙ্গাতে হবে। কলম আর ডায়েরিটা নিয়ে বসে পড়লো। পদ্মাকে কবিতা শুনাবে বাসর রাতের কবিতা
তন্দ্রাহত রাতে কোমল মেঘের
ডানার পরে চাঁদ,
তারার দীপ জ্বলা ধ্রুপদী আকাশের
নীচে- তুমি এলে
নির্বাসন ভেঙে; তখন ঘুমন্ত শরীর আমার
জাগে বিদ্যুতের বেগে,
সকল গ্রন্থির কাটে অবসাদ ।
যখন দেখি তার নির্নিমেষ চোখে নেশার প্রণয়
কামনা বাসনার ঘোর লাগে রক্ত-মাংস শরীরে ।
কম্পিত হৃদয়ে লাজুক ঠোঁট দুটি
কেঁপে কেঁপে ওঠে;
ছিন্ন-ভিন্ন এ হৃদয়ে -ও শঙ্খ আবার বাজায় ।
নিঃশ্বাসে বেড়ে যায় উষ্ণতা
আমার, হাল্কা বাতাসে
বুকের বসনখানি আলগা হয় আর- লুটায় কবরী
নগ্ন কটিদেশে, দুলে ওঠা স্তনের- সে অলংকারে ;
আমার সে যুবক জেগে ওঠে
আবার তোমার আকাশে।
সোনালি ঈগলের মতো ডানা
ঝাপটে অভিমান ভেঙে-
আমার পুরু ঠোঁট উল্কি এঁকে যায় নগ্ন শরীরে ;
মদির তনু বাসে রোমে-রোমে ফোটে
হাজার ক্যাকটাস,
সর্পিল বাঁধনে আমায় বাঁধো তুমি
তীক্ষ্ণ বর্শার আঘাতে ঘুমন্ত প্রস্রবন খোলে,
দীর্ঘ পরিশ্রমে প্রেমসুখে সিক্ত
দেহে ঝরে ঘাম –
ক্লান্তির শরীরে নেমে আসে তৃপ্তি আর আনন্দ!
প্রেমে থাকে যৌনতা, যেমন থাকে
প্রেম ঈশ্বর কোলে
তাইতো পদ্মা মেঘনা যমুনা
কেবল তোমাদেরি স্বত্তা
ধরিত্রীর এই পাঁজাকোলে।
শনশন বাতাস আর নিবু নিবু হ্যাজাকের আলোতে গনেশ কুবেরের পানসী নৌকা দেখা যায় মাঝে মাঝে। রাতের চাঁদটাও মৌনতায় আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে তারকারা ছোট হয়ে ভাসছে। পদ্মার ঘোমটাতোলে আব্দুল আলীমের স্বর্ণকন্ঠে টান দিলো অমিত….বধূর বাড়ি মধুপুর আমার বাড়ি অনেকদূর, এরি মাঝে কে বাজালো গো, মধুর মিলন বাঁশির সুর। পদ্মারবুকে ঘুমে লুটিয়ে পড়লো অমিত। পদ্মাকে অবহেলা করা মানেই তার স্বত্তাকেই অস্বীকার করা। এভাবেই একটি রাত বিনিদ্র পাড় করলো অমিত পদ্মারবুকে।
আরো পড়তে পারেন…

সংশ্লিষ্ট বিষয়