নদীয়ার গোরাগাঙনি : খাল নয়, নদী

গোরাগাঙনি
গোরাগাঙনি একটি নদীর নাম। তার উৎসমুখ লুঠ হয়ে গেছে। চূর্ণীর যে স্থান থেকে তার সূচনা, সেখানে এখন আবাদী ফসলের মাঠ। কিন্তু কথায় বলে না, ‘নদী শুকিয়ে গেলেও খাত বেঁচে থাকে’।
ফলে নদীয়া জেলার হাঁসখালি ব্লকের বেড় হাঁসখালি ও পাড়বাটিকামারী দুটো গ্রামের ভৌগোলিক সীমানাবিভাজন রেখার মতো এখানে এখনও বেঁচে আছে নদীখাত। দীর্ঘ চোদ্দো কিলোমিটার পথ- কোথাও অতিপ্রশস্ত নদীর মতো জলধারা, আবার কোথাও সেই ধারা ক্ষীণ বটে। মাঝে মাঝে ভেড়ি বেঁধে চলছে মাছের চাষ। আবার কোথাও বা নদীপাড়ের বড়ো বড়ো বাড়ি থাবা বসিয়েছে নদীর জলকর অংশে। এই সব আগ্রাসনেই হারিয়ে গেছে গোরাগাঙনির প্রবাহ। আর আমরা আমাদের জীবনের দিনানুদৈনিক অভ‍্যস্ততায় মেনে নিয়েছি এই অস্বাভাবিকতা, বিশ্বাস করতে শিখেছি ,এটাই স্বাভাবিক।
একটু উল্টো করে ভাবা যাক। ধরা যাক চূর্ণীর উ‍্ৎস থেকে গাজনা বাওর হয়ে ইছামতীর সীমান্তে গোরাগাঙনি জলবতী এক কন‍্যে। মিলননগর, পাড়বাটিকামারী, গৌরনগর, বগুলা, বংশীনগর, ভবানীপুর, কৌতুকনগর, গাড়াপোতা, শ‍্যামনগর, কমলপুর, গাজনা, পেপুলবেড়িয়া প্রভৃতি গ্রামের প্রান্তরেখা ছুঁয়ে, কারও রান্নাঘর, কারও গোয়ালঘর আবার কোনো মন্দির বা বুড়ো বটতলার কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে মানুষের এই আদুরে কন‍্যে- কেমন হতো। কেমন হতো, যদি মুড়াগাছার বিলেন মাঠ, লক্ষ্মীবিল বা আন্ধারে বিলের বর্ষার জলধারা পুষ্ট এই ছোট্ট মেয়েটির শরীর জুড়ে মীনসন্তানের অবাধ সাঁতারে তৈরি হতো আনন্দময় তরঙ্গভঙ্গ। কিংবা কেমন হতো সেই ছবিটা বাঁশঝাড় বা বেনাবন অথবা কলমিঝোঁপের আড়াল ভেঙে ছোট্ট তালডোঙা চেপে আলো- আঁধারির সন্ধেয় চই চই হাঁক ছেড়ে পোষা হাঁস ঘরে ফেরাতে মুখর করে তুলতো কোনো কিশোরী। আজকের নাগরিক জীবনের ‘সিরিয়াল’ কলঙ্কিত চালসে পড়া চোখে হয়তো বেমানান এই ছবি। কিন্তু ভেবে দেখলে মানতেই হয়, এইসব ছবিতেই তো ধরা থাকার কথা স্বদেশসন্ধান। এমনকি ইতিহাসও।
গোরাগাঙনির ইতিহাসের সূচনা তো তার নাম নিয়েই। কিঞ্চিৎ বিতর্কও আছে। বিতর্কটা এই গোরাগাঙনি নদী না খাল ? – এই প্রশ্নে।
লোকমুখে গোরাগাঙনি খাল হিসেবেই পরিচিত। আজ থেকে নয়, বহুদিন আগে থেকেই। ‘খাল’ বলি কাকে? না, মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম জলপ্রবাহকে। তাহলে তো চূর্ণীকেও নদী বলা চলে না।  ইতিহাস বলে, ১৭৪৩ সালে মাথাভাঙার একটি ছোট্ট জলখাত, যাকে পরবর্তীতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কঙ্কণা নামে পরিচিত করান, তার সঙ্গে অঞ্জনার স্রোতের মিলন ঘটিয়ে দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র চূর্ণী প্রবাহপথ তৈরি করেন। সেও তো খাল। না চূর্ণী পুরোপুরি খাল নয়। কেননা, অঞ্জনা নামের নদীর সঙ্গে সে মিলেছে। তাই চূর্ণী নদী। কিন্তু গোরাগাঙনি যে খাল তার ইতিহাসগত প্রমাণ কী? কবে, কীভাবে, কার বা কাদের উদ‍্যোগে এই খাল কাটা হয়, সে প্রশ্নে ইতিহাস নীরব। না কি বর্তমানের চূর্ণী, এককালের স্বাভাবিক নদী অঞ্জনারই কোনো শাখানদী গোরাগাঙনি? আবার এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে হাঁসখালিতে যেখানে চূর্ণীর রঘুনন্দন মিত্রের কাটাখাল অঞ্জনার সঙ্গে মিশেছে, সেখান থেকে ডানদিকে ঘুরে অঞ্জনার একটি ধারা যেমন গঙ্গা-অভিমুখী, তেমনি আর একটা প্রবাহ সোজা পূর্বদিকে গোরাগাঙনি নামে প্রবাহিত হয়। কঙ্কণা থেকে কাটাখাল যেমন মাথাভাঙার মূলস্রোতের জলধারা আত্মসাৎ করে ইছামতীকে দুর্বল করে, তেমনি বিপুল জলস্রোতের তীব্রতায় প্রবাহিত নবোদ্ভূত চূর্ণীধারা অঞ্জনার সমস্ত জল আত্মসাৎ করে বলে গোরাগাঙনিৎপরাভূত হয়ে মজা নদীতে পরিনত হয়। এ প্রসঙ্গে আমি সাক্ষ্য মানতে পারি, এই অঞ্চলের প্রবীণ মানুষ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কার্তিকচন্দ্র বিশ্বাস মহাশয়ের একটি লেখার। কার্তিকবাবু লিখেছেন, ” পূর্বদিকে পাতুরিয়াঘাটার খাল আসলে মজানদী গোরাগাঙনি। হাজরাতলার ( বেড় হাঁসখালির বিখ্যাত হাজরা ঠাকুরের থান) পশ্চিমদিকে যেমন চূর্ণী নদী, তেমনি একসময় পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত ছিল গোরাগাঙনি।’ কার্তিকচন্দ্র বিশ্বাস গোরাগাঙনিকে নদী হিসেবে ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু পাতুরিয়াঘাটার খাল ও গোরাগাঙনি এক নয়। বরং হাঁসখালি মৌজার হাজরাতলা খাল, সাতপোতা মৌজার সাতপোতা খাল, মুড়াগাছার ডিঙিটানা ও পচার বিলের জল আজকের কৃষ্ণনগর-রানাঘাট বাসরুটে চূর্ণী ব্রীজের পরে যে ছোটো ব্রীজ বাসস্ট‍্যান্ড রয়েছে তার তলা দিয়ে কাটাখালযোগে গোরাগাঙনিতে ফেলা হতো। কাটাখাল থেকে গ্রামের নাম আজ কাটাখালি। ভাবনাটিই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। ফলে ভৌগোলিক তথ‍্য বিশ্লেষণ যেভাবেই হোক, গোরাগাঙনিকে নদী হিসেবে চিহ্নিত করার সম্ভাবনাই বেশি মনে করি।

আরো পড়ুন…

চূর্ণীকথা : একটি নদীপ্রবাহের উৎসের খোঁজে – গৌতম অধিকারী

কবি গৌতম অধিকারী’র কবিতা- নদী, নারী ও দেশের কথা

আমার ব‍্যক্তিগত এই বিশ্বাসের সমর্থনে ‘গোরাগাঙনি’ শব্দবন্ধের ‘গাঙনি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস প্রমুখের অভিধানগুলো ‘গাঙনি’ অর্থে ছোটো নদীকেই বুঝিয়েছে। ‘গোরা’ শব্দের সঙ্গে অনিবার্যভাবে ‘গাঙনি’ যুক্ত হওয়াটা গোরাগাঙনির নদী পরিচয়টাকে নিশ্চিত করে। তাহলে ‘গোরা’ শব্দটির ব‍্যাখ‍্যা কী? এ প্রসঙ্গে একটি ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০১০-এর নভেম্বর মাসে আমরা যখন ‘গোরাগাঙনি’ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করি, তখন কিছু মানুষ আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন ‘গোরাগাঙনি’ নয়, ‘গোড়াগাঙনি’। তখন তাঁদের কাছে এর ব‍্যাখ‍্যা চাইলে তাঁরা উল্লেখ করেন ১৯৫২ সালে প্রাতঃস্মরণীয় কমলাকান্ত দাসের গোরাগাঙনি সংস্কার আন্দোলনের কথা। এই আন্দোলনের কাগজপত্র, ব‍্যানার সর্বত্রই লেখা হয়েছিল ‘গোড়াগাঙনি’। তথ‍্যটা হয়তো সত্যি। কিন্তু তাতে ‘গোরাগাঙনি’ কখনোই ‘গোড়াগাঙনি’ হতে পারে না। আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ সম্পর্কে অবহিত মানুষমাত্রই জানেন ‘র’ কে ‘ড়’ এবং ‘ড়’ কে ‘র’ উচ্চারণ করা বঙ্গালী উপভাষার একটা প্রবণতা। সেই প্রবণতার ছাপ পড়েছিল ‘গোরা’কে ‘গোড়া’ উচ্চারণ করার মধ্যে। কিন্তু মধ‍্যবঙ্গ অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতের প্রেসিডেন্সি ডিভিশন নদীয়া, যশোর, খুলনা, চব্বিশ পরগনার মানুষেরা উচ্চারণে এই ত্রুটি থেকে মুক্ত। সে জন‍্যই ১৯৫২ সালের অনেক আগে বাংলা ১৩৩২ সালে, অর্থাৎ ইংরাজি ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসের ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায় গোরাগাঙনির সমস্যা, সংস্কারবিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র হালদার। তাঁর লেখার শিরোনামে ‘গোরাগাঙনি’ নামেই চিহ্নিত করা হয়েছে এই জলপ্রবাহকে। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার পাতায় হাঁসখালি এলাকায় ‘ম‍্যালেরিয়া নিবারণী সমিতি’র শাখা প্রতিষ্ঠার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কুমারী রামনগর গ্রামের নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এর সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে প্রথম গোরাগাঙনি সংস্কারের দাবি ওঠে। এই সমিতির কার্যবিবরণী ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়। কোথাও ‘গোড়া’ শব্দটি মেলেনি। মেলেনি ‘খাল’ শব্দটিও।
প্রশ্ন হতে পারে ‘গোরাগাঙনি’ নামের পেছনে যুক্তিটা কী? দুটো সম্ভাবনার কথা আমার মনে হয়েছে। এক, ছোট্ট নদী গাঁয়ের সীমানা, বাড়িঘর ছুঁয়ে ঘুরে ঘুরে বয়ে চলেছে, তাই ঘোরা ছোটো নদী ‘ঘোরাগাঙনি’। এর পাড়ে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি নীলকুঠি। বগুলা কুঠিপাড়া নামটিও গোরাগাঙনিপাড়ের নীলকুঠি থেকে। গাজনার নীলকুঠি আজও গোরাগাঙনি যুক্ত গাজনা বাওরের পাশে। নীলকর সাহেবদের নীলবাণিজ‍্য চলতো গোরাগাঙনি, চূর্ণী, ইছামতী , অঞ্জনার প্রবাহপথে। তাদের উচ্চারণে ‘ঘোরা’ হয়ে গেছে ‘গোরা’। এভাবেই ‘গোরাগাঙনি’ যাকে বাঁচাতে পারলে ইতিহাসকে ছোঁয়া যায়, চেনা যায় স্বদেশকে, জগতটাকে। কেননা, ” নদীর অঙ্গে জগত পয়দা হয়।”

সংশ্লিষ্ট বিষয়