নরসুন্দার নাব্যতা ফিরে পাওয়ার এখনই সময়

নরসুন্দার নাব্যতা ফিরে পাওয়ার এখনই সময়

আমার ছেলেবেলার দেখা নরসুন্দা এখন আর দেখি না। এখন যা দেখি একে নদী বলা যায় না। আমার দেখা ৬০-৭০ দশকের নরসুন্দার অস্বিস্থ এখন বিলুপ্ত প্রায়। অথচ এখনও আমরা ওই নদী নিয়ে স্বপ্ন দেখি। কেন দেখি তার উত্তর আমারও জানা নেই। জীবন জীবনের উৎস খুঁজে, সে তার শৈশব, কৈশর আর যৌবনের জয়গান করতে ভালোবাসে। সেই স্বার্ণালি জীবনটারে মানুষ আবার ফিরে পেতে চায়। তাই তো মানুষ বারবার অতীতের কাছে ফিরে যায়।

আমারও অতীত ছিলো, ছিলো কৈশর ও যৌবনের উচ্ছ্বাস। আমি নরসুন্দা পাড়ের মানুষ তাই আমার কৈশর আর যৌবনের সঙ্গে মিশে আছে খরস্রােতা নরসুন্দার কলধ্বনি ও আমার দুরন্তপনার ধারাপাত। আমি তাই বারবার ফিরে যাই আমার প্রিয় নরসুন্দার কাছে।

ছেলেবেলায় আমি যখন শীতের বিকালে বালুচরে বন্ধুদের নিয়ে মারবেল খেলতাম। তাদের সঙ্গে ছোটাছুটি করতাম সেই দিনগুলো আমার কতই না আনন্দের ছিলো। আমার বন্ধু অরুণ, টগর, পানুর কথা মনে পড়ে। এখন তারা কে কোথায় কি ভাবে আছে তাও বলতে পারবো না। কিন্তু সেই মুখাবয়ব, সেই উচ্ছলতা আর দুরন্তপনার ছবি এখনো আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। আমার চিরচেনা সেই নদী আমি দেখতে পাই, কলকল বয়ে চলার জলধ্বনি আমার কানে বাজে। আমার বন্ধুদের নিয়ে বালুচরের উদ্দামতাকে আমি এখনও অনুভব করি। আমি হারিয়ে যাই অতীতের সেই মধুর দিনগুলোর অতলে।

ওই নদীই ছিলো এ শহরের প্রাণ। নদীর মতই ছিলো এখানকার মানুষের ছন্দোময় জীবন। বর্ষায় নদীর টলমল জল, পালতোলা নৌকার চলাচল আর ঘাটে ঘাটে নোঙর করা নৌকায় সন্ধ্যাপ্রদীপের আলোর ঝিকিমিকি জলের উপর খেলা করতো। চাঁদ রাতে অপরূপ চাঁদের আলো জলে ঢেউ খেলতো। নদীর ধারে তালবৃক্ষ,নদীর বাঁকে বাঁকে জেলেদের মাছধরার জাল বাংলার চিরচেনা সেই অপরূপ দৃশ্য এখন আর খোঁজে পাওয়া যাবে না।

কিশোরগঞ্জ শহরের মধ্যদিয়ে নরসুন্দা পশ্চিম থেকে প্রবাহিত হয়ে পূবে চলে গেছে। শহরের পুরানথানা এলাকায় এসে নদীটি বাঁক খেয়েছে দুদিকে, দক্ষিণে ও উত্তরে। দক্ষিণে মণিপুর ঘাট হয়ে সেটি আবার দুদিকে বাঁক নিয়েছে। একটা চলে গেছে ঢুলদিয়া হয়ে নিকলীর হাওরে ও অপরটি গেছে ভৈরবের পথে। উত্তর দিকে প্রবাহিত এটিও বাঁক নিয়েছে দুদিকে। একটি গেছে করিমগঞ্জ হয়ে ইটনার হাওরে। অন্যটি গেছে বাঁক খেয়ে তাড়াইলে। তরুণ বয়সেও দেখেছি সবগুলো নদীপথই নাব্য ছিলো। এসব পথে নৌকা চলতো। হাওরের মানুষ নদীপথেই আসা-যাওয়া এবং তাদের পণ্য পরিবহণ করতো। এছাড়াও অন্যান্য জেলার পণ্য পরিবহণ হতো এই নদীপথ দিয়েই। গত পাঁচ দশকে নদীপথগুলো সব মরে গেছে। স্থানে স্থানে ফসলের ক্ষেত এবং অনেক স্থানই দখল হয়েছে দখলদারদের কালো থাবায়। নরসুন্দা আজ জীবন্ত লাশ। আবহমান বাংলার রূপ-বৈচিত্র আর প্রাণ প্রবাহের এ এক করুণ পরিণতি। সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে ঘেরা গ্রাম-গঞ্জের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর শোভায় উচ্চকিত বাঙালির মনেও ধরেছে জং-জরা। অথচ নদী ছাড়া বাঙালির জীবন ধুসর, মরুভূমির মত।

আরো পড়তে পারেন…

…………………………………………..

ববর্ষের প্রত্যাশা : ভালো থাকবে আমার নদী সুতি

ফুলেশ্বরীর আত্মকথা

রিভার বাংলা নদীসভার উদ্যোগ : তাড়াইলে আলোচনা সভা ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত

…………………………………………..

নরসুন্দার উৎপত্তিস্থলে অর্থাৎ হোসেনপুরে বাঁধ দিয়ে এর প্রবাহকে বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে ব্রহ্মপুত্র থেকে নরসুন্দার দিকে নদীর স্রােত বন্ধ হয়ে গেছে। এটা নদীকে মেরে ফেলার আয়োজন এবং মানবতা বিরোধী। ব্রহ্মপুত্র থেকে পানির প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় নরসুন্দায় পানি শূণ্যতা দেখা দেয় এবং ধিরে ধিরে নদী মরে যায়। এই সুযোগে নদী দখল শুরু হয়। নদীতে ধান চাষ এবং স্থানে স্থানে ভরাট করে তৈরি হয়েছে স্থাপনা। এই হত্যাযজ্ঞ ও দখল সমর্থন যোগ্য নয়।

সম্প্রতি ঢাকার তুরাগ নদকে হাইকোর্ট ‘জীবন্ত সত্তা বা (লিভিং এনটিটি) বলে ঘোষনা করেছেন। নদী এখন থেকে একটি জীবন্ত সত্তা। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘মানবজাতি টিকে থাকার জন্য অন্যতম হচ্ছে নদী’। তাই মানবজাতির স্বার্থেই আমাদেরকে নদী রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আদালতের রায়ে এটাই বলা হয়েছে যে আমাদের দেশের নদীগুলো জীবন্ত সত্তা। এর ফলে মানুষের মত নদীগুলোরও আইনী অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। দেশের বিশেষজ্ঞগণ রায়ের ব্যাখ্যায় এমনটিই বলেছেন। তাই এখন সময় এসেছে নরসুন্দার নাব্যতা ফিরে পাওয়ার। আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে নরসুন্দাকেও বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কিশোরগঞ্জের মানুষের জীবন ও উন্নয়নের জন্যই নরসুন্দার নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি।

 ১৭. ০৪. ১৯ ।। কিশোরগঞ্জ

সংশ্লিষ্ট বিষয়