সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা- নদী তীরবর্তী পরিবারের নদী ছন্দিত উপন্যাস

নলিনী বেরা’র ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ উপন্যাস

এবছর আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত নলিনী বেরা’র “সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা” নিয়ে নদী ও পরিবেশ চিন্তক তুহিন শুভ্র মন্ডল এর অনুভবি বিশ্লেষণ।

“….. আমাদের গ্রামের উত্তরে নদী সুবর্ণরেখা, তার আগে ‘হুড়ি’, ছোটোখাটো পাহাড়। ওই পাহাড়ে দাঁড়ালেই ‘তল্লাট’ চোখে পড়ে। নদী, নদীজল, নদীবালি…” নদীর প্রসঙ্গ এই ভাবে শুরু করছেন নলিনী বেরা, প্রান্তিক জনপদের কাহিনীকে যিনি বুকে ধারণ করেছেন, উৎস থেকে মোহনায় পৌছানোর পর যখন সামনে দেখেন শান্তি পারাবার তখন যার মনে পড়ে যায় শেকড়ের কথা সেই নলিনী বেরা। নাকি ললিন?! উপন্যাসের ললিন আর নলিনী কি একই? সেই নলিনী যার জন্ম পশ্চিমবঙ্গ- ওড়িশা – বিহার সীমান্তের কাছাকাছি সুবর্ণরেখা নদীতীরবর্তী গ্রামে, অতিশয় এক দরিদ্র পরিবারে।

‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ নদীবন্দিত এক আখ্যান যেখানে শত শত জনপদ, জনজীবনের কেন্দ্রে রেখে দেয় এক পরিবারকে আর তাকে ঘিরেই কেন্দ্রায়িত হয় এই কাহিনী যেখানে ‘নদী থাকে পূর্বগামিনী। তার মানে নিরন্তর বয়ে চলেছে পশ্চিম থেকে পূবে। পূবে, পূবে। আমাদের গ্রামের শিমূলতলার ঘাটে এসে দাঁড়ালে ডাইনে- বাঁয়ে অনেকদূর অব্দি নদী দেখা যায়….’।

‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ উপন্যাসের জন্য ১৪২৫ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত
‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ উপন্যাসের জন্য ১৪২৫ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত-নলিনী বেরা

নিজের গ্রাম আর নিজের নদী নিয়ে আশ্চর্য অহংকার যেন নলিনী বেরার। রাজ্য খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের উচ্চপদস্থ চাকুরে হলেও ভুলতে পারেন না নিজের আইডেন্টিটিকে। বলা ভাল ভুলতে চান না। শুধু বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান না তিনি। বরং বুক থেকে বের করে সবাইকে দেখাতে চান, জানাতে চান সুবর্ণরেখা, ডুলুং,রোহিণী- রণজিতপুর, হুড়ি, বাজে শিমূল, কমলাপুখুরিয়ার কথা….সেই কবেকার কথা! কিন্ত কি অবলীলায় বলে চলেন নলিনী ” কোবরেজ গেল, নাটুয়াদলে ‘নাচুয়া’ হওয়া গেল না- আমার দ্বারা আর কি হবে!” আর তারপরেই কি অপূর্ব বর্ণনা- “হতাশায় হতাশায় মাঠে- ঘাটে বিলে- বাতানে টঙ টঙ করে ঘুরে বেড়াই। রামধনু ওঠে, দিগঙ্গন কালো করে বর্ষা নামে, যেতে- আসতে পায়ের তলায় পায়ের চাপে পুটুস পাটাস করে চেপ্টে গুঁড়ো হয়ে যায় কত যে ‘ছাগলহাঁচি’- র ডুমো ডুমো ফল! পাড়িয়ার বিলে ধানগাছের গোড়ায় নাড়া- জলে হঠাৎ হঠাৎ খলবলিয়ে ওঠে কই কি মাগুড়। ধানফুল ঝরে ‘আলা’ হয়ে যায় করণতলার মাঠ, গোছা ফুলের মালা গেঁথে ঝিরিঝিরি জলে….” সুবর্ণরেখাকে, তাকে ঘিরে থাকা গ্রামকে ঘিরে সহজ সরল ভাবে গাঁয়ের অকৃত্রিম সব সম্পদের ছবি এঁকেছেন তিনি।কি নৈসর্গিক তার উপমা দেওয়ার ধরণ! সাবঅল্টার্ন মানূষের জীবন- বৃত্তান্তের কি অপরুপ রুপরেখা- যা পড়তে ভেসে ওঠে ….’ হাটুয়াপাড়ার’ সেই গান, “বিধি যাহা লেখি আছে কপালে বৈশাখীপালে গো বৈশাখীপালে”।

প্রান্ত মানুষের কথা, কথ্য ভাষাকে শহুরে বেডরুমের বেডসাইড টেবিলে অনায়াসে স্থান করে দিতে পারে নলিনী বেরা আর তার সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা।লেখকের মাটির মৃদঙ্গ, জোন থার্টি, এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, অমৃত কলস যাত্রা ইত্যাদি কিছুই আমি পড়িনি। কিন্ত এই যে ” সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা পড়ে আমার মনে হচ্ছে সব কিছু ছেড়ে, সব কিছু ফেলে ঝুম হয়ে বসে থাকি নদীর পাড়ে, হাঁটুর ভিতর মুখ গুঁজে নাভির ভিতর দিয়ে খুঁজতে থাকি আমার অতীত, আমার শেকড়, আমার পূর্বপুরুষ সর্বোপরি আমাকে – এর দায় আমি আর কাউকে না দিয়ে নলিনীকেই দেবো। নাকি ললিনকে?!

আরো পড়তে পারেন….

পুনর্ভবা’র ভাঙন: নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে স্কুল, আস্ত একটি গ্রাম

নদীর জন্য নবনির্বাচিত সাংসদের কাছে আমরা যা চাই

সংশ্লিষ্ট বিষয়