প্রসঙ্গ: ভারতের সাম্প্রতিক নদী আন্দোলন ও আমার কিছু কথা

    বন্দো মাতা সুরধনী পুরাণে মহিমা শুনি
  পতিত পাবনী পুরাতনী
বিষ্ণুপদ উপাধান দ্রবময়ী তব নাম 
  সুরাসুর নরের জননী।। 
ভারত উপমহাদেশের শুধু ভৌগলিক রূপরেখা তৈরি নয় সভ্যতা, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাক্ষী ও ধারক-বাহক আমাদের গঙ্গা নদী। অসংখ্য জীব-বৈচিত্র্যর প্রাণশক্তি যুগিয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। ‘স্বর্গের নদী’ নামে খ্যাত ‘গঙ্গা-যমুনী-তহজীব’ এই নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ভারতীয় সভ্যতা।
ভারত, তিব্বত (চীন), নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ জুড়ে ১০৮৬০০০ বর্গ কিমি জুড়ে গঙ্গা অববাহিকা।  ভারতের ২৬ শতাংশ ভূমিখন্ডে ৮৬১৪৫২ বর্গ কিমি গঙ্গা ও তার উপনদী ভারতের মূল জল বহনের আধার।  উত্তরে হিমালয়, পশ্চিমে আরাবল্লী, দক্ষিণে বিন্ধ্যো-ছোটনাগপুর মালভূমি, আর ব্রহ্মপুত্র শৈলশিরা, ২৫২৫ কিমি দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট নদীর বয়ে চলার জল যুগিয়ে চলেছে।  এই অববাহিকায় রয়েছে ভারতের ৬৫.৫৭ শতাংশ কৃষিজমিসহ ৩.৪৭ শতাংশ জলের আধার (water body)।
ভারতের ২৩৯ টি লোকসভা কেন্দ্র, প্রাচীন ঐতিহাসিক শহরসহ দিল্লী, কলকাতা মহানগরসহ অসংখ্য ছোট বড় শহর গড়ে উঠেছে এই নদী অববাহিকায়।  বিশ্বের সর্বোচ্চ জন ঘনত্বের এই নদী অববাহিকা হলো ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড। কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে গড়ে ওঠা ভারতীয় সভ্যতা, উপনিবেশ যুগ থেকে ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভ্রান্ত ধারণা ও পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
যা ধীরে ধীরে গঙ্গাসহ ভারতের মাতৃসম নদীগুলিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে ১৯৬০ এর দশক থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নীতিনির্ধারকরা ভৌমজল নির্ভর ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার দেশজ ধারাকে অবহেলা করেছে। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, আজ দেশজুড়ে জল সংকট ভীষণ আকার ধারণ করছে। গঙ্গার প্রায় সমস্ত উপনদী যা আসলে গঙ্গার জীবনীশক্তিসহ গঙ্গার মূল প্রবাহে জলের বহমনতা হ্রাস পেয়েছে সর্বত্র। গঙ্গাসাগরে গঙ্গা নদীর ৫৭ শতাংশ জলপ্রবাহ কমেছে মাত্র তিরিশ বছরে। হাজারেরও বেশী বাঁধ-ব্যারেজ, নদী পরিকল্পনা নদীর জলকে তাঁর প্রবাহ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
নদী পরিকল্পনাগুলি দেশের মানুষকে উন্নতির স্বপ্ন দেখালেও তা সুস্থায়ী উন্নয়ন হয়ে উঠতে পারছে না।  অথচ এতদিন পরেও দেশের সরকার গঙ্গা নদীকে এখনো ব্যাবসার কাঁচামাল রূপে ব্যবহার করে চলেছে।  দেবী জ্ঞানে পূজিত নদী আজ “জলপথ নং ১” নামে পরিচিত হচ্ছে; উত্তরাখন্ডে ভাগীরথী, অলকানন্দা, মন্দাকিনী, ধৌলি গঙ্গা, পিন্ডার নদীর মিলনে গড়ে ওঠা গঙ্গার মূল প্রবাহে জলবিদ্যুতের নামে নদীকে শৃঙ্খল পড়ানো হয়েছে। 
আর ফারাক্কায় এসে যেনো গঙ্গা নদীকে ফাঁসীর দড়িতে ঝোলানো হয়েছে। যা কখনোই ভারতীয় নদী-সংস্কৃতিতে মান্যতা পায়নি। হিমালয় অঞ্চলে উচ্চ গতিতে চলা গঙ্গা নদীর উপর অত্যাচারের ফলে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের জঙ্গল সুন্দরবন আজ সংকটে। অসংখ্য জীব-বৈচিত্র্যসহ মানুষ আজ বিপদে।
এই সময় প্রয়োজন নদী ব্যবহারের ধারণা ও পদ্ধতির গভীর পর্যালোচনা। প্রয়োজন সেই ব্যবহারের ধারণা ও পদ্ধতি বদলের জন্য নতুন পথ খোঁজার। নদী-পরিবেশ-প্রকৃতিসহ নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য দাবীতে দেশ জুড়ে বিভিন্ন প্রতিবাদ আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। হরিদ্বারের কাছে কংখলের মাতৃসদন আশ্রমের সাধু-সন্যাসীনিরা দীর্ঘদিন অবিরল নির্মল গঙ্গার দাবিতে অনশন সত্যাগ্রহ করছেন।
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে সামান্য মধু মেশানো জল গ্রহণ করছিলেন ব্রহ্মচারিণী পদ্মাবতী। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দিল্লীর এ.আই.এম এস. হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একই দাবিতে ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দ ৩০ জানুয়ারি থেকে অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন। গত ২৪ দিন ধরে অনশনরত ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে আশ্রমে ১৪৪ ধারা জারি করে। আদালতের আদেশ অমান্য করে উত্তরাখন্ড সরকার মাতৃসদন আশ্রমের প্রধান স্বামী শিবানন্দ মহারাজের যে পুলিশ পাহাড়া ছিল তা তুলে নেয় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। তার প্রতিবাদে ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দ জল গ্রহণ বন্ধ করেছিলেন। বিজেপি পরিচালিত উত্তরাখন্ড ও কেন্দ্রীয় সরকার এমনভাবে প্রতিটি আন্দোলন প্রতিবাদের কন্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় তাঁদের দাবির সমর্থনে ও বাংলার নদীগুলির প্রাকৃতিক রূপ ফিরিয়ে দিন এই আহ্বানে নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রায় ৬০০কিমির একটি সাইকেল মিছিল সমাপ্ত করেছে। আলিপুরদুয়ার জেলার সঙ্কোশ নদী থেকে মালদার গঙ্গা-পদ্মা ভাঙ্গন কবলিত পারদেওনাপুর গ্রাম পর্যন্ত।
সারাবাংলা জুড়ে বর্তমানে অনেক ছোট বড় নদী অববাহিকার মানুষ নদী বাঁচানোর আন্দোলন গড়ে তুলছেন। এখন প্রয়োজন এই আন্দোলনের মধ্যে সমন্বয় ও নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলা। যাতে আগামী দিনের জল-পরিবেশের সংকট মোকাবিলায় এক বৃহৎ সংগঠিত শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব হয়।

সংশ্লিষ্ট বিষয়