আমাদের ছোটো নদী ।। গৌতম অধিকারী

আমাদের
সেই কবে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, আর শৈশববেলায় মন্ত্রের মতো আউড়ে গেছি আমরা, নদীস্রোতের মতোই খলবল করে উঠতে গোটা ক্লাসরুম,
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। পার হয়ে যায় গরু, পাড় হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
আমি অবশ্য জন্মেছি এমন একটি ছোট্ট নদীর পাড়ে, ততোধিক ছোট্ট গ্রামে। কিন্তু নদীর সঙ্গে সখ্য গড়ে-ওঠার মে স্বাধীনতা দরকার, তা তো ছিল না শৈশবের কালে। সেই স্বাধীনতা কিঞ্চিৎ মিলল কিশোরবেলায়। এক নদীকে পেলাম, নাম তার ছোটো ভৈরব। মুর্শিদাবাদ জেলার হরিহরপাড়া আর ডোমকল ব্লকের বিভাজন-রেখা ছোটো ভৈরব আমার নদীপ্রেমপথের প্রথম প্রেমিক। কিন্তু সে প্রেম কিশোরের আবেগমাত্র। আর সেই আবেগটাই পূর্ণতা পেল গোরাগাঙনি নামের এক ততোধিক ছোট্ট নদীকে ঘিরে।
বাড়ির কাছে চূর্ণী ছিল, মাইল তিনেক দূরে। মাঝমধ্যে বন্ধুরা মিলে ছুটেও যেতাম চূর্ণীর কুলে। কিন্তু কেন জানি না, কয়েক পা ফেললেই মে শুকনো নদীটা হা-হা শূন্যতা বুকে মৃত্যুর নিঃশ্বাস ফেলতে, সেই গোরাগাঙনিই হয়ে উঠল আমার আশ্রয়। এখন অবিশ্যি ‘বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ না। শুধু বেঁচে আছে ছেঁড়া ছেঁড়া নদীখাত। আর এলাকার মানুষের মুখে মুখে তার নাম ‘গোরাগাঙনি খাল’, সে না কি নদী নয়।
অনেকেই বলেন, চূর্ণীর খাল গোরাগাঙনি। খাল কেন?- এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তাঁদের কাছে নেই। ধর্মের গাড্ডায় পড়া পাবলিকের মতো গাড়ল-উচ্চারণে আকাশ ফাটিয়ে তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, “ক্যান, ঐ যে পেত্থম ব্যালায় য্যাখন খাল সংস্কারের দাবি ওঠে, তার ফেস্টুনে ল্যাহা ছেল ‘গুড়াগাঙনি খাল সংস্কার করতে হবে’। ভাষাগত ভাবে তখন বোঝাতে গেছি ‘গাঙ’ পুরুষবাচক শব্দের স্ত্রীবাচক শব্দ ‘গাঙনি’, তখন ধেয়ে এসেছে তীব্র গালাগাল, “বেশি বোঝো।”  আর আমার ‘বেশি-বোঝা মন’ নিয়ে সন্ধান চালিয়ে আজ আমি নিশ্চিত জেনেছি গোরাগাঙনি নদী, নদীই। এবং চূর্ণীর অনেক আগেই ছিল গোরাগাঙনির অস্তিত্ব।
চূর্ণীনদী (ফাইল ছবি)
পদ্মার শাখা পুরনো অঞ্জনা সেদিনের রেউই, আজকের কৃষ্ণনগর হয়ে সোজা বেরিয়ে এসেছিল যাত্রাপুর নামের একটি গ্রামের কাছে। এখান থেকে ডানদিকে একটি শাখা বেশখানিকটা পথ পেরিয়ে গঙ্গা-অভিমুখী, মিশেছে সে শিবপুরের গঙ্গাসঙ্গমে। সোজা ধারাটি ছুটে এলো হাঁসখালির কাছে। এখানে এসে তার বহুমুখী গতি। ১৭৪৩ সালে শিবনিবাসের দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র মাথাভাঙার অসমাপ্ত কঙ্কনাকৃতি ধারা থেকে একটি খাল কেটে তখন জুড়ে দেন অঞ্জনার বহুমুখের উৎসে, তখন থেকেই বহুমুখগুলো শুকিয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু রইল বেঁচে গোরাগাঙনি। কেননা নীল চাষের রমরমার কালে নীলার সাহেবদের উদ্যোগে গোরাগাঙনি সংস্কার করা হয়েছিল। উদ্যোগটি সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ইংরাজি ১৮৫৪ সালের আগস্ট মাসে ( বাংলা ১০.০৫.১২৬১), ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে এইভাবে,-
নদীয়ার নদী : (সম্পাদকীয় স্তম্ভ, ১০.০৫.১২৬১) নীলকর সাহেবদিগের সভার সুবিদ্বান সম্পাদক শ্রীযুক্ত থিওবোল্ড সাহেব ভাগীরথী, হুগলী,
মাথাভাঙ্গা, রূপনারায়ণ ইত্যাদি নদনদী সকল ‘Nodia Rivers’ নামে বিখ্যাত হইয়া তত্তাবৎ পরিস্কার রাখার কর্ত্তব্যতা বিষয়ে বিবিধ প্রমাণ ও যুক্তি প্রদর্শনপূর্ব্বক আমাদিগের অভিনব লিউটিনাণ্ট গবর্ণর সাহেবের নিকট যে আবেদন পত্র প্রেরণ করিয়াছেন আমরা ইংরাজী পত্রে তাহা পাঠ করিয়া পরম সন্তুষ্ট হইয়াছি।..”
কলকাতার কেন্দ্রীয় মহফেজখানায় সংরক্ষিত থিওবিল্ডের ‘Nodia Rivers’ রিপোর্টে নদী হিসেবে অঞ্জনার মে দুইবার উল্লেখ ও প্রবাহপথের বর্ণনা রয়েছে, তা থেকে প্রমাণ করতে কষ্ট হয় না, হাঁসখালিতে অঞ্জনার বহুমুখী ধারাটি সেই ১৮৫৪ সালেও অঞ্জনা নামেই পরিচিত ছিল এবং গোলা সাহেবদের উদ্যোগে সংস্কারের কারণে কালে-কালান্তরে সেই প্রবাহটি গোরাগাঙনি নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ফলে মৃত নদী গোরাগাঙনিকে লুটের স্বার্থে মতই খাল বলা হোক, আমার অন্তর্ভুবনে সে নদীরূপেই বেঁচে থাকে। তাই বৈশাখে হাঁটু জল না থাকলেও বর্ষা সমাগমে তার রূপ তো নদীমাতার স্বরূপে ধরা দেয় বারবার। গোরাগাঙনি সহজে মরেনি। অনেক অনেকদিন সে বেঁচেছিল আপনার খেয়ালে। সময়ের দুর্বিপাক এখনও অতটা থাবা না বসালেও এখন চূর্ণীসঙ্গমে প্রসারিত হতে শুরু করেছে দীঘল চরভূমি। বৎসরের এই একটা সময় বর্ষাসমাগমে মাসদুয়েক জলকল্লোলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ভরা কোটালের জোয়ারে এখনও গঙ্গার ঘোলা জল ছাপিয়ে যায় চরা, চোরাস্রোত বয়ে যায়। সুবিশাল দহের মতো মুখে জলের ঘূর্ণিপাকে খলখল ছলকে ওঠে গোরাগাঙনির জলধারা। আঁকাবাঁকা পথে সে ঘুরে ঘুরে চলে গাঁয়ের বাঁশবাগান,রান্নাঘর, তুলসীমন্দির, ঈদগাহ্-র সীমানা ছুঁয়ে।
এখনও তার চলার পথে গভীর খাত, দুপাশে বিস্তৃত জলরেখার প্রসার, আর বৃষ্টিবাহিত নতুন জলসম্পদের সম্পন্ন বিস্তার জানান দেয় উচ্ছ্বল যৌবনের সানন্দ দিনগুলোর কথা। জলস্রোতের তীব্রতা দেখা যায় এই বৃষ্টিলালিত সময়েই। কলমী জঙ্গলে ঝড় ওঠে। বিল-বাওড় ভাঙা কচুরিপানার দাম উপচে পড়ে ইছামতীতে। গাজনা, গাড়াপোতা, কমলপুর, শ্যামনগরের চাষীরা ধান পাট বোঝাই করে এখনও এই পথেই নিয়ে আসে হাঁসখালি হাট বা বগুলা বাজারে। চলে দু-চারটে টাবুরে নৌকা, নতুন বৌ নাইওর যায় কিংবা হাটুরে দোকানী পসরা নিয়ে চলে নদীপথেই। কোনো কোনো বিষন্ন বিকেলে ব্রহ্মচারী মেঘের জটাজুট ছায়া নেমে আসে জলের গভীরে।
আদুরে ঘোরাগাঙনির সন্ধে মাঝে মাঝেই মুখর হয়ে ওঠে ‘চই চই।আয়, আয়। চই’ সুরেলা গলার আওয়াজে। কচুরিপানা, কলমীদাম ভেঙে হাঁসেদের প্যাঁক প্যাঁক শব্দ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সান্ধ্য বাতাসে। চপল গ্রাম্য কিশোরী তার দুবলা হাঁসিটাকে কোলে তুলে কত আধো আধো কথা বলে চলে আজও। অনাবিল সেই আদরে নদীটাও যেন খলবল হেসে কথা বলে ওঠে কখনও।
রাতের অন্ধকার যখন ডানা বিছোয় আদিগন্ত চরাচরে, তখন কৌতুকনগরের ঘাটকান্দায় বাঁশের মাচায় বসে হয়তো কোনো গ্রামবৃদ্ধ কমলাকান্ত দাস, যিনি জলবতী গোরাগাঙনির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি হয়তো অন্ধকার ডিঙিয়ে চলা নৌকার মাঝিকে হাঁক ছেড়ে বলেন,- কিডা যায়?
 কমলপুরিরতে আসতিছি গো দাসমশাই়। জুনা মুসল্লির ব্যাটা বক্কর আলি।
 “অ, আব্বা ভালো আছে গো বাবাজি!’
 “শরীলডা জুতির নেইকো। আপনি একদিন আসেন আমাগের বাড়ি।”–সাদর আমন্ত্রণে সাড়া আসে ঘাটকান্দা থেকে, “যাবানে বাবাজি! কদ্দিন দেহিনে জুনা ভাইরে।”
“আসেন আসেন।’- নৌকো এগিয়ে যায় ভাটির টানে। বৈঠাপতনের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিবাগী বাতাসে।
প্রশ্ন এবং উত্তর জলের তরঙ্গভঙ্গে ঘুরে ঘুরে চলে ছোট্ট নদীটার মতোই। তারপর সাময়িক নীরবতার প্রহর পেরিয়ে জলকল্লোলে নীরব হয় সমস্ত মানুষী উচ্চারণ। শুধু নীরব নদী বয়ে যেত ঘুরে ঘুরে। ঘুরে ঘুরে চলে বলেই তো লোকের মুখে ছোট্ট আদুরে  নদীটা ঘোরাগাঙনি।
নীল চালানের সুবিধার্থে নীলকর সাহেবরা একবার খুলে দিয়েছিল ঘোরাগাঙনির মুখ, তাদের উচ্চারণে সে হয়ে গেছে ‘গোরাগাঙনি’। আর একবার তার শরীর থেকে সমস্ত অবরোধের পাপ খসিয়ে আমরা কি পারি না আমাদের ‘এক যে ছিল দেশ’-এর জলবতী চেহারা দিতে। তাহলে বোধহয় গোরাগাঙনি সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নামগুলো ইতিহাসের পাতায় সজীব হয়ে উঠতে পারে, একটিও আবক্ষ মূর্তি না গড়ে, এই কাজটি করাই কি জরুরি নয়?- প্রশ্ন করে নটেশাক। কেননা, সে বুড়িয়ে গেলেও মুড়োয়নি তো!
তাই আমার গল্পটাও চলে বয়ে, নদীর মতন। যেমন একসময় বয়ে যেত গোরাগাঙনি, উৎস থেকে ইছামতীর।

সংশ্লিষ্ট বিষয়