নদীকথা ।। বিনীতা সরকার

নদীকথা

নদী মানে একটি নিখাদ ভালবাসার ছোঁয়া। নদীর সতত প্রবাহিত জলধারা আমাদের জীবনে আশীর্বাদের মতো। নদী মানে জীবন। এই নদীর সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ, শহুরে সব মানুষেরই জীবন কাহিনী। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রাচীন বাংলার অনেক শহর। এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অনেক নগর, অনেক জনপদ।

তাই নদীকে বাদ দিয়ে জীবন ভাবা যায় না। ফারাক্কার পাশ দিয়ে বহতা গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গকে দু’টি ভাগে ভাগ করেছে। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় জেলা জলপাইগুড়ি। জেলার উত্তর অংশে হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চল। উত্তরের উঁচু অংশের জমির ঢাল দক্ষিনে নেমে এসেছে। এর ফলে এই জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীগুলিই দক্ষিণ বাহিনী।

আর জমির ঢালের উপর ভিত্তি করে কোন কোন নদী দক্ষিণপূর্ব বা দক্ষিণ-পশ্চিম বাহিনী। বড় নদীগুলো বরফ গলা জলে পুষ্ট। সুতরাং সারা বছর জল থাকে। আর ছোট নদীগুলো বৃষ্টি জলে পুষ্ট। ফলে শীতকালে জল থাকে না। এই জেলায় ছোট-বড় নদী মিলিয়ে নদীর সংখ্যা প্রায় আশির কাছাকাছি। তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক, কালজানি ও সংকোশ এই জেলার প্রধান নদী।

আজ আমি তিস্তা নদী সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব। তিস্তা জলপাইগুড়ি জেলার প্রধান নদী। জলপাইগুড়ি শহরের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে তিস্তা বয়ে চলেছে। সিকিমের লাচেন ও লাছাং হিমবাহ থেকে তিস্তার উৎপত্তি। পাহাড়ের মানুষের কাছে তিস্তা যেন কোনো নদী নয়, বরং বাড়ির মেয়ে। এদিকে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং,জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

তিস্তার প্রায় ১২৫ কিলোমিটার পড়েছে উত্তরবঙ্গে। তিস্তার ৫৬ কিলোমিটার পড়েছে জলপাইগুড়ি জেলায়। প্রায় ৫০০০ বছর আগে ঋকবেদে এই নদীকে বলা হয়েছে সদানীর। সত্যি বলতে সদানীরই। সারা বছরই এই নদীতে জল থাকে। তিস্তার প্রধান উপনদী রঙ্গীত। নদী একদিকে যেমন প্রানদায়িনী। অপরদিকে তেমনি প্রাণহারিনী। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে বন্যায় মনে হয় নদীই মানুষকে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ করে। প্রাণবন্ত নদী তিস্তাও যেমন প্রাণদায়িনী আবার সর্বনাশাও।

১৮৭৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিস্তার অববাহিকা অঞ্চলে কম করে দশ-বারোবার বন্যায় প্রচুর প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরপর ১৯৫০, ‘৫২,’৫৪,’৬৮,’৬৯ সালেও প্রচুর বন্যা হয়। ১৯৬৮ সালের ৪ অক্টোবরের বন্যা স্মরণাতীতকালের মধ্যে বীভৎসতম বন্যা বলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত। সেই অবিশ্রান্ত বারিধারার অতর্কিত প্লাবনে শহর জলপাইগুড়ি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। হ্যাঁ সত্যিই নদী বন্যা কখনো কখনো ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। দু’কূল ভেঙে নিঃস্ব করে দেয় মানুষকে। রাস্তাঘাট বাজার প্রতিষ্ঠান জমি সবই নদীর প্রবল স্রোতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মানুষ ও প্রাণিসম্পদ এর মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে নদী। দু’কূল ভেঙে নিঃস্ব করে দেয় মানুষকে।এছাড়া বন্যায় বিভিন্ন রোগের প্রাদূর্ভাবও ঘটে।


আরও পড়তে পারেন……

আমার নদী…তুই ডাকলেই সাড়া দেয় যারা ।। সুস্মিতা চক্রবর্তী

ঘুসকি, একটি সম্ভাবনার নাম ।। কৌশিক বিশ্বাস

সে, আমি ও আত্রেয়ী ।। সুদর্শন ব্রহ্মচারী


তবে এগুলো সত্ত্বেও নদীর উপকারিতাই সবচেয়ে বেশি। নদী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এ দেশকে আরো অপরূপ করে গড়ে তুলেছে। ভরা বর্ষায় নদীর রুপের ঝংকার মুগ্ধ করে তোলে সবাইকে । নদীতীরের সাদা কাশফুল, পালতোলা নৌকো, স্রোতের কলধ্বনি হৃদয় তোলে আলোড়ন। আমরা নদীর কাছ থেকে শুধু দু’হাত ভরে নিয়েছি। দিইনি প্রায় কিছুই। নদীকে শোষন করেছি, দূষণ ঘটিয়েছি, কিন্তু নদীকে সুস্থ করে তোলার মত উদ্যোগ আমরা কেউই তেমন ভাবে গ্রহণ করিনি। অথচ নদী আমাদের কতকিছু দেয়। বর্ষার মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়া যায় এই নদীবক্ষ থেকেই। কৃষি যোগাযোগ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে নদীর উপকারিতা অপরিসীম।

নদী দিয়ে জীবন বাঁচায় জেলেরা। মরুময়তা রোধেও নদীর ভূমিকা ব্যাপক। পার্বত্য অঞ্চল থেকে নির্গত হওয়ার পর নদী নিজের স্রোতে বালি কাঁকড়, ছোট-বড় পাথর বহন করে আনে। এই পাথর ও বালির গৃহ, সড়ক নির্মাণ ও সেতু নির্মাণের কাজে লাগে। বহু লোক নদীবক্ষ থেকে এগুলো সংগ্রহ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। সরকারের এ থেকে কর আদায় হয়।

নদীর কাছে তাই আমাদের আজন্ম ঋণ থেকে যাবে। এখনও সময় আছে নদীর বুকে কান পেতে তাঁর কান্না শোনার, নদীকে প্রকৃত অর্থে ভালবাসার। আমাদের সাংস্কৃতিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক জীবনে নদী রেখে চলেছে অমূল্য অবদান। তাই নদী সংস্কার ও নদী সংরক্ষণে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে।

বিনীতা সরকার : লেখক, শিক্ষক

সংশ্লিষ্ট বিষয়