২৬ আগস্ট ২০২৩ খ্রি. শনিবার মাঝিরদিয়া গ্রামের শ্রীঘাটে জেলে পরিবারগুলোর নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহের জন্য পানির পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে জেলেদের জীবন সংগ্রামের সাথে সংহতি জানিয়েছে ‘রিভার এন্ড ডেল্ট রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)’। নদী দূষণের কারণে জেলেদের জীবিকা পরিবর্তন, জীবন ধারনজনিত সমস্যা নিয়ে আলোচনার ও পানির পাম্পের আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধনের মধ্যমে দিনটি উজ্জাপিত হয়।
ঢাকার নদীগুলোর মধ্যে তুরাগ অন্যতম। ঢাকার মানুষ খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য তুরাগ নদীর উপর নির্ভরশীল ছিল। আমিষের সিংহভাগ যোগন হতো তুরাগ নদী থেকে। সে তুরাগ নদীতে চলছে দখল ও দূষণের প্রতিযোগিতা। নদী দখল করে পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্প-কারখানা। সেগুলোর বর্জ্য আবার প্রতিনিয়ত দূষিত করছে নদীর পানিকে। এতে জীবিকা হারাচ্ছে হাজার হাজার নদী নির্ভরশীল মানুষ।
ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নের তুরাগ নদীর পাড়ে মাঝিরদিয়া গ্রামে প্রায় দু’শত জেলে পরিবারের বসবাস। এছাড়াও তুরাগ নদীর পাড়ে রাজবংশী সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ হাজার জেলে পরিবার বসবাস করে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর, বছরের এই চার মাস জেলেরা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও বাকি আট মাস নদীর পানি দূষণের কারণে জেলেদের বাধ্যতামূলকভাবে বেকার থাকতে হয়। তুরাগের পানি দূষণের কারণে মাছ না থাকায় জেলেদের অনেকে তাদের পূর্বপুরুষের জেলে পেশা থেকে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়, আবার তাদের অনেকেই এই সময়টাই বেকার জীবন কাটাতে হয়।
বেকার সময়টাই জেলে পরিবারগুলোকে অধিক হারে সুদে ঋণ নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। নদীর পানি দূষণের কারনে এই আট মাস জেলে পরিবারগুলোকে পানি, স্বাস্থ্য, ও বেকার সমস্যা কাধে নিয়ে জীবন চালাতে হয়, তার সাথে চলে ঋণের কিস্তির চাপ নিয়ে বেঁচে থাকার এক কঠিন লড়াই। ঢাকার খুব নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করা এই জেলে সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ নদী দখল-দূষণ কারণে জীবিকা হারিয়ে এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। এছাড়াও জেলে ভাতা, বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাও পাচ্ছে না।
রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)-এর চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ-এর সভাপতিত্বে ও সঞ্চলনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র যুগ্ম সম্পাদক ও বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মিহির বিশ্বাস।
অথিতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তুরাগ নদী সুরক্ষা কমিটির সেক্রেটারি মাসুদ সরদার, আইনজীবী ও গ্লোবাল ল’থিংকারস সোসাইটি-এর প্রেসিডেন্ট রাওমান স্মিতা, কাউন্দিয়া ইউনিয়নের পরিষদের মেম্বার লিজা আক্তার, রিভার বাংলার সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ, ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ-এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল, যোগযোগ বিশেষজ্ঞ ও লেখক খান মো. রবিউল আলম, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানাসহ আরো অনেকে।
মিহির বিশ্বাস তাঁর বক্তব্যে বলেন-তুরাগ পাড়ের রাজবংশী সম্প্রদায়ের জেলেদের সংকটপন্ন নদী দূষণের ফল। নদীর আসল স্টেকহোল্ডার নদী পাড়ের মানুষ, জেলেদেরকে দিন দিন নদী থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনাহারে জীবন কাটালেও তারা হাত পাততে লজ্জা পায়। বৃদ্ধ মায়েরা কান্নাভরা বুক নিয়ে হাসি জড়ানো কন্ঠে বলেছে বছরের নয় মাস মাছ ধরতে পারে না। বেকার যুবকরা বিপথগামী হয়। তাদের পেশা ও জীবন দারুন সঙ্কটে। আরডিআরসি’র মহান উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
তুরাগ নদী সুরক্ষা কমিটির সেক্রেটারি মাসুদ সরদার বলেন- তুরাগ পাড়ের মানুষের সমস্যাগুলোর মধ্যে বিশুদ্ধ পানির অভাব অন্যতম। আরডিআরসি’র উদ্যোগে আমি একাত্ত্বতা জানাচ্ছি এবং ভবিষ্যতে এই উদ্যোগ যাতে আরো দৃঢ়বান হয় সে সমর্থন দিয়ে যাব।
গ্লোবাল ল’থিংকারস সোসাইটি-এর প্রেসিডেন্ট রাওমান স্মিতা বলেন-নদী ও নদী পাড়ের মানুষ নিয়ে কাজ করার জন্য আরডিআরসিকে ধন্যবাদ। মানুষের কথা হচ্ছে বড় শক্তি। কথা যদি সঠিক জায়গা পৌঁছানো না যায় তাহলে সমস্যাও পৌঁছানো যাবে না, তার সমাধানও হবে না। এই অঞ্চলের মানুষ ও পরবর্তী ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই অঞ্চলের মানুষের সমস্যা সমাধানে সবাইকে একসাথ হয়ে কাজ করতে হবে।
রিভার বাংলার সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বলেন-নদী, নদী পাড়ের জনগোষ্ঠী, জেলে, মাঝিদের নিয়ে কাজ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য আরডিআরসিকে ধন্যবাদ। দেশের প্রাণকেন্দ্রের পাশেই একটি এলাকায় অনেক ধরনের সংকট নিয়ে বসবাস করছে, তার সমাধান কি? এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেই, শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, নিরপত্তার ব্যবস্থা নেই, এক ভংকর অনিশ্চিত জীবন-যাপন থেকে পরিত্রাণের প্রয়োজন। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের প্রয়োজন।
কাউন্দিয়া ইউনিয়নের পরিষদের মেম্বার লিজা আক্তার বলেন-এখানকার মানুষদের সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করে যাব। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যত ধরনের সহায়তা দরকার আমরা চেষ্টা করবো নিশ্চিত করতে।
যোগযোগ বিশেষজ্ঞ ও লেখক খান মো. রবিউল আলম বলেন-নদী পাড়ের মানুষ সাধারণত নদীর পানি পান করে থাকে। এতে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর থেকে পরিত্রাণের সহজ উপায় নিরাপদ খাবার পানি। আরডিআরসিকে এমন মহৎ উদ্যোগের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য খাবার পানির ব্যবস্থা করে পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ-এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন- একসময় ঢাকার মধ্যে তুরাগ নদী ও নদীর পাড়ের পরিবেশ সবচেয়ে ভালো ছিল, মানুষের স্বাস্থ্য ভালো ছিল, এই অঞ্চলের মাছ ও শস্য দিয়ে ঢাকা শহরের মানুষদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হতো, নদী পাড়ের মানুষ নদীর পানি পান করত। নদী দূষণের কারণে নদী পাড়ের মানুষের জীবনের যে সংকট তা দেশের আইন, সরকার প্রতিহত করার দায়িত্ব। নদীর মালিক জেলেরা, নদী পাড়ের মানুষ কিন্তু সমাজের প্রভাবশালীরা নিজেদের নদী ভরাট করে নিজেদের মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলো। প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিবেই।
নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা বলেন-ঢাকা শহরের পাশেই একটি এলাকায় শত শত জেলে, মাঝি পরিবারের বসবাস। শতাধিক শিশু শিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা থাকলেও নানা কারণে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। মাঝিরদিয়া গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের খাবার পানি সরবরাহে পাম্প স্থাপনের জন্য আরডিআরসিকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, আমাদের সকলের আন্তরিক চেষ্টায় তৈরী হতে পারে মাঝিরদিয়া গ্রামে একটি বিদ্যালয়।
সভায় মাঝিরদিয়াসহ আশেপাশের গ্রামের জেলে সম্প্রদায়ের প্রায় দু’শতাধিক নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে জীবিকা ও অন্যান্য সমস্যার বিষয় তুলো ধরেন। তারা জানান, তাদের পূর্বপুরুষদের পেশা ছিল জেলে পেশা। এই পেশার উপর তাদের পরিবার জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু পানি দূষণের কারণে নদীতে মাছ না থাকায় তাদের বছরের প্রায় আট থেকে নয় মাস বেকার থাকতে হয়। অনেকে নদী দূষণের কারণে পূর্বপুরুষের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়। আবার অনেকে এই আট-নয় মাস বেকার থেকে ঋণ নিয়ে চলে। কিন্তু তাদের এই সমস্যাগুলো কারো নজরে আসে না।
আরো জানা যায়, জেলেরা আট থেকে নয় মাস বেকার থাকে কিন্তু জেলেদের কোনো ধরনের ভাতা প্রদান করা হয় না। বেকার থাকার কারণে বছরের বেশির ভাগ সময় অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে তারা হিমশিম খায়। এই অঞ্চলে উন্নত শিক্ষা ও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিপথে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে নদীতে সাকার ফিশের প্রভাবে বর্ষা মৌসুমেও তারা মাছ পাচ্ছে না।
তারা জানায়, বছরের বেশিরভাগ সময় তারা অনাহারে, অভাব-অনটনে কাটান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে তারা তাদের সমস্যা তুলে ধরেন। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করছেন না। নদীর পাড়ে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা নির্মাণের অনুমতি দিয়ে সেগুলো থেকে সরকার ট্যাক্স পাচ্ছে কিন্তু দু্র্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নদী পাড়ে মানুষদের। তারাও মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক, তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।
রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ জানান-নদী পাড়ের মানুষ নিয়েই নদী। শুধু নদী নিয়ে গবেষণা করলেই হবে না, নদী পাড়ের মানুষদের জন্যও কাজ করতে হবে।
বর্ষা মৌসুমে নদী ও নদীর আশেপাশে বিলে, নালায় জেলেরা মাছ ধরে। অর্থাৎ যখন বিল, নালা পানিতে ভরা থাকে তখন সেগুলোর মালিক সবাই, বিশেষকরে জেলেদের। কিন্তু শুকনো মৌসুমে অনেকে সেগুলো দখল করে মালিকানা দাবি করে। বিল, নালাগুলো যত দখল হবে ততই সবার মালিকানা কমে আসবে। নদীর পাশের বিল, নালাগুলো ভরাট করা দেশের আইনের বিরুদ্ধে। কেউ সেগুলো ভরাট করতে চাইলে জানিয়ে দিতে হবে এটা তার একার মালিকানা না, এটা সবার মালিকানা, সেখানে জেলেদের মাছ ধরার অধিকার রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এই অঞ্চলের মানুষদের সাহায্য করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, আমাদের কাজ হচ্ছে সরকারি দপ্তরে মানুষের সমস্যা পৌঁছে দেয়া এবং সমাধানের জন্য কাজ করা। এছাড়াও খুব শ্রীঘ্রই এই এলাকার সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্য ফ্রি চিকিৎসা ও ঔষুধের ব্যবস্থার আশ্বাস দেন।