কালীগঙ্গা ডেকেছিল ।। সন্তোষ কুমার শীল

কালীগঙ্গা

দেখতে দেখতে কালীগঙ্গার বুকের মধু উথলে ওঠে। ক’দিন যাবত থেকে থেকে দমকা বাতাস বইছিল। সকাল থেকে বৃষ্টির সাথে মিলে তা ঝোড়ো হাওয়া হয়ে বইতে শুরু করে। আর আশ্বিনের জড়সড় কালিগঙ্গা হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠে। সাগর থেকে বয়ে আনা বিপুল জলরাশি দু’কুল ছাপিয়ে নাচতে নাচতে জনপদের দিকে ছুটতে থাকে। হারাধন সারাদিন তার ঝুপড়িতে বসে ক্ষণে ক্ষণে কালীগঙ্গার রূপ পরিবর্তন দেখেছে আর নানা স্মৃতির জাবর কেটেছে। দিনটা তার ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের মত একটা দুর্দিন।

তখনো সাঁঝের আঁধার নামেনি। শেষ বেলায় এক পশ্লা বৃষ্টি হয়ে আকাশ কিছুক্ষণের জন্য পরিস্কার হয়ে উঠেছিল। একখানা ইঞ্জিনচালিত ছোট্ট নৌকা এসে হারাধনের ঝুপড়ির কাছে থামে। বেশ বড়সড় একটা ব্যাগ নিয়ে দুই যুবক-যুবতী তীরে নামে। সাঁঝের নির্জন কালীগঙ্গার বুকে প্রবল আলোড়ন তুলে নৌকাটা চলে যায়। সারাদিন ঠায় বসে থাকা হারাধন প্রথমবারের মত ঝুপড়ির বাইরে আসে। হারাধনকে দেখে প্রথমটায় হয়তো পাগল ঠাওর করে যুবতী সরে এসে যুবকের হাতটা ধরে শঙ্কিত চোখে চেয়ে থাকে। ব্যাপারটা চোখ এড়ায়না হারাধনের। সে আগন্তুকদের নিঃশঙ্ক করতে জিজ্ঞেস করে- এই দুর্যোগের মধ্যে তোমরা যাবে কোথায়?

যুবকের চোখ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বেশভূষাহীন, ঝুপড়ি ঘরে বাস করা লোকের মুখে ‘তুমি’ সম্বোধন বোধহয় প্রত্যাশা করেনি সে। হারাধন বিষয়টা বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ায় না। ঝুপড়ির দিকে হাঁটা দেয়।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিটা আরেকটু ঘন হয়ে নেমেছে। কালীগঙ্গার দুই পাড়ে ঘন হয়ে আঁধার নেমে আসছে। হারাধনকে চলে যেতে দেখে যুবকের মনে শঙ্কা ঘনায়। সে ব্যস্ত দুই পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করে- এখানে থাকার কোন ব্যবস্থা আছে? কোন হোটেল বা আবাসিক বাড়ি হলেও চলবে। কোনো ভাড়া বাড়ি হলেও আপত্তি নেই। আমরা এক রাতের জন্য পুরো মাসের ভাড়া দেব।

হারাধন কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলে- এাঁ একটা ছোট বন্দর। রাতে তো এখানে কেউ থাকে না! তাই থাকার মত ঘর পাওয়া অসম্ভব। তবে বাজারের মধ্যে একটা বড় ঘর খালি পড়ে থাকে। রাতে টহলে আসা পুলিশ মাঝে মাঝে ঘুমায়। এই দুর্যোগের মধ্যে আজ হয়তো তারা আসবে না। সেখানে একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। কিছুদূর সামনে গেলেই বন্দর রক্ষা কমিটির অফিস ঘর। সেখানে গেলে একটা ব্যবস্থা হতে পারে।

যুবতীর চোখের পাতা কেঁপে ওঠে। সে শঙ্কিত গলায় বলে- সেখানে গিয়ে কাজ নেই। আপনি অন্য কোনো ঘরের কথা বলুন না! তার বলার ভঙ্গীতে হারাধন কিছু একটা অনুমান করে নেয়। বলে- অন্য ঘরের কথা আমার জানা নেই। তবে বন্দরের মধ্যে গেলে একটা ব্যবস্থা হবেই।

যুবতী ঝুপড়ির চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলে- আপনার এখানে আজ রাতটা আমরা কাটাতে পারি না?

-আমার এখানে! এই দুর্যোগের মধ্যে আমিই ভিজে ভিজে রাত কাটাই। তোমাদের তো অভ্যাস নেই! রাতে ভিজলে হয়তো অসুখ-বিসুখ বাঁধিয়ে ফেলবে।

-কিচ্ছু হবে না। আপনি অনুমতি দিলে বাকিটা আমরা মানিয়ে নিতে পারব।

-তোমরা কি পালিয়ে এসেছো মা? হারাধনের চোখেমুখে প্রশ্রয়ের হাসি ফুটে ওঠে।

যুবক উষ্ণ হয়ে ওঠে- আপনার এসব কথায় দরকার কী? ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে যুবতীর দিকে চেয়ে বলে- চলো, বন্দরের মধ্যে যাই তো! তারপর যা হবার হবে।

কিন্তু যুবকের কথায় যুবতী রাজি হয় না। যুবককে একটা চোখের ঈশারা করে বৃদ্ধ হারাধনের কাছে এগিয়ে এসে বলে- আপনার কেন এমন মনে হল?
দু’জনকে বিস্ময়ে চমকে দিয়ে বলে- মানুষের নিজের জীবনে যা ঘটে অন্য কারো মধ্যে তার ছায়া পড়লে মানুষ অভিজ্ঞতার আলোকে তা বুঝতে পারে। তোমাদের প্রথম দেখে কেন যেন আমার পালিয়ে আসার কথাটাই মনে হয়েছিল।

দু’জনের মুখে আর কথা সরে না। যাকে দেখে প্রথম পাগল ভেবে নাক সিঁটকেছিল তার অনুমান এতদূর নির্ভুল! যুবক দুর্ভাবনায় পড়ে যায়- এখন কি হবে! এর কাছে তো আর নিজেদের লুকানো চলে না! কিন্তু যুবতীর মুখে স্বস্তির ছায়া পড়ে। সে ব্যাগটা ঝুপড়িতে তুলে রেখে বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বলে- আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা দু’জন পালিয়ে এসে আজই বিয়ে করেছি।

-আজ আমার জীবনেও একটা স্মরণীয় দিন, সুখের দিনও বলতে পারো। আচ্ছা, পরে সে সব কথা হবে। ঘরের ভিতর এসো। আমি দেখছি আলো জ্বালার কোন ব্যবস্থা করতে পারি কী না। আঁধার হয়ে এল যে!

রাত বাড়ার সাথে সাথে বাতাসের বেগ প্রবল হয়ে ওঠে আর কালীগঙ্গাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। হঠাৎ হঠাৎ বয়ে যাওয়া দমকা বাতাসে হারাধনের ছোট্ট ঝুপড়িখানা যেন উড়িয়ে নিতে চায়। আবার আকাশ পরিস্কার হয়ে যায়। মায়াবী জোছনা ফোটে। শুধু কালীগঙ্গা তার উচ্ছাস দমন করতে পারে না। সে আনন্দে না ক্রোধে শোঁ শোঁ করে ফুঁসতে থাকে বোঝা যায় না।

হারাধন একটা কেরোসিনের কুপি জ্বেলে দু’জনের সামনে দিয়ে বলে- তোমরা গল্প করো। আমি বাইরে থেকে আসছি।

-এই বৃষ্টির মধ্যে আবার বাইরে যাবেন কেন?

-রাতের জন্য কিছু খাবার আনতে হবে। আমি তো রাতে কিছু খাই না! তাই ঘরে খাবার কোন ব্যবস্থা থাকেও না। তোমরা ছেলেপান মানুষ! আমার মত না খেয়ে তো আর রাত কাটাতে পারবে না! কিছু খাবার নিয়ে আসি।

-আমাদের কাছে খাবার আছে। এই দুর্যোগের মধ্যে আর আপনাকে বাইরে যেতে হবে না। তারচেয়ে আমাদের সাথে গল্প করুন।

-কী গল্প আর শুনবে আজ! বলার যা তা তো কবেই ফুরিয়ে গেছে। আজ কি আর মানুষের মধ্যে আছি!

হারাধনের কথায় যুবক চমৎকৃত হয়। এই সময়টা তাদের নিজেদের জন্যও আশা-হতাশা, সুখ-স্বপ্নের দোলাচলে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বৃদ্ধকে দেখে তারা যেমনটা ভেবেছিল লোকটা আসলে তা নয়। মৃত আগ্নেয়গিরি দেখে যেমন তার অতীত অনুমান করা যায় না, তেমনি যে বৃদ্ধকে দেখে তারা ক্ষ্যাপাটে বুড়ো ভেবে তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল সে আসলেই ভিন্ন এক মানুষ। মিনাক্ষীর মানুষ চেনার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে। সে বৃদ্ধের কথায় যাদুর ছোঁয়া পেয়েছে। দারুণ আকর্ষণ বোধ করেছে। তার জন্যই অম্বর এই ঝুপড়িতে রাত কাটাতে সম্মত হয়েছে।
অম্বর বিনীতভাবে বৃদ্ধকে বলে- জনমানবহীন নদীর তীরে এই কুঁড়েঘরে একা একা থাকতে দেখে আমার মনে অনেক কথাই জাগে। জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে কিনা ভেবে পাই না।

-এইটুকু সাহস যার নেই সে প্রেমিকার হাত ধরে পালায় কোন্ ভরসায় জানি না। তোমাকে দেখতে তো সাহসী বলেই মনে হয়!

-ভীরু আমি নই। তবে আপনি মনে কষ্ট পান কিনা সেটা তো না ভেবে পারি না।

-এত স্পর্শকাতর হলে এতদিন হয়তো বাঁচতেই পারতাম না। যাক সে কথা। তুমি কি জানতে চাইছো, বলো!

-আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-সমাজ ছেড়ে আপনি এখানে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন কেন?

-জীবনে কোন কোন প্রাপ্তি এত বেশি হয়ে ওঠে যে তার মূল্য হিসেবে সবকিছু ত্যাগ করা চলে। আমার জীবনে তেমনই এক দান পেয়েছিলাম। কিন্তু যা অমূল্য রক্ষা করাও কঠিন। আমিও তাকে রক্ষা করতে পারিনি। তাই তার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি।

-মহার্ঘ্য একটা জীবন এইভাবে অপচয় করতে আপনার কষ্ট হয় না?

-কোনটা জীবনের সঠিক ব্যবহার আর কোনটা অপচয় তা নির্ণয় করা বড্ড কঠিন! কোন কোন সময় অপচয়টাকেই হয়তো সবচেয়ে আনন্দের বলে মনে হয়। বিশেষ করে আর একটা জীবনের জন্য যদি তা কাটানো হয়।

-আপনি কি অন্য কারো জন্য এই অমূল্য জীবন এভাবে অতিবাহিত করছেন?

-বলতে পারো অনেকটা তাই!

মিনাক্ষী যেন নিতান্ত আপনজনের কাছে আব্দার করে- তার কথা শুনতে আমার খুব ইচ্ছে করে। আমিও তো আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে অম্বরের হাত ধরে চলে এসেছি। আপনার কথা হয়তো আমার জন্য পথ-নির্দেশ হতে পারে।

-তুমি কেন তবে এমন কাজ করলে?

-এাঁ না করলে সত্যকে অস্বীকার করে একটা ঘৃণ্য প্রথা, একটা মিথ্যে অহঙ্কারের মূল্য দিতে হত। আর জীবন থেকে হারাতে হত আমার প্রেম, আমার ভালবাসা- অম্বরকে।

-আমারও সেদিন এমনই একটা সঙ্কট উপস্থিত হয়েছিল। তার মূল্য চুকাতে গিয়ে শুধু আত্মীয়-স্বজনই নয় আমার কুল-ধর্ম সব ত্যাগ করেছিলাম। আর কখনো সমাজ-সংসারে ফিরে যেতে মন চায়নি। কালীগঙ্গাকে আশ্রয় করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবার সঙ্কল্প করে এই নদীর তীরে এসে বাসা বেঁধেছি।

-আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপনার এই নিঃস্বতাকে বরণ করার কাহিনী। এাঁ কী করে সম্ভব হল!

-বৃষ্টি থেমে গেছে। চলো, নদীর ধারে গিয়ে বসি। কারণ, এই নদীতেই তার শেষ নিঃশ্বাস পড়েছিল। তারপর থেকে আমাকেও আশ্রয় দিয়ে রেখেছে এই নদীটাই। এর স্পর্শে আমি তাকে ফিরে পাই।

তখন আমি নিতান্তই তরুণ। বাবার অঢেল ধন-সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি। যা খুশি চাইতাম বাবা চোখের পলকে তাই এনে হাজির করতেন। জীবন তখন বসন্তের বাতাসের মত বয়ে যাচ্ছিল। আমাদের বেশ কয়েকখানা বাওয়ালী নৌকা ছিল। সুন্দরবন থেকে নৌকা ভর্তি সুন্দরী কাঠ এনে দেশের নানা অঞ্চলে বিক্রি করত। মাসের শেষ আবার কখনো বা দুইমাস পর নৌকাগুলো সব একসাথে ঘাটে ফিরে আসত। তখন বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া, উৎসবের ধুম পড়ে যেত। জনাবিশেক বাড়তি লোকে বাড়িটা গমগম করত। আমাদের একজন গোমস্তা ছিল, নাম রাজে আলী। সে সুন্দরবনের বিচিত্রসব গল্প এমনভাবে বলত শুনে শুনে আমার নেশা ধরে যেত। ইচ্ছে হত তখনই গিয়ে নৌকায় চড়ে বসি।

একদিন বাবার কাছে ইচ্ছোঁ প্রকাশ করি। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললেন- তোর মাকে যদি রাজি করাতে পারিস তবে আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।
সমস্যা হল মাকে নিয়ে। সুন্দরবনে যাবার কথা শুনে তিনি এমনভাবে বেঁকে বসলেন যে বাবাও হাল ছেড়ে দিলেন। আমি তখন অৎানা বন, নদ-নদীর নেশায় পাগলপ্রায়। জন্ম থেকে নদী আমাকে ভীষণভাবে টানত। তার অবশ্য একটা কারণ আছে। নদীর বুকে আমি জন্মেছিলাম। ভূমিষ্ট কথাটা আমার ক্ষেত্রে বোধহয় খাটে না। আমার জন্ম হয়েছিল নৌকায় বসে, ভূমিতে নয়।

-সে কী! নৌকায় কেন?

তখন তো আর আজকের দিনের মত ডাক্তার-নার্স ছিল না! আর যারাও বা ছিল তাদের কাছে সন্তান জন্ম দিতে মহিলাদের না যাওয়াই ছিল সমাজের নিয়ম। বাড়িতে বসে প্রসূতি মাতা মারা যাবে সেও ভাল। কিন্তু কোনমতেই ডাক্তারের কাছে যাওয়া চলবে না। তবে আমার জন্মের সময় দেরি করে হলেও মাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল।

বিয়ের পর যুগ কেটে গেছে। কিন্তু মা কোন সন্তান জন্মদিতে না পারায় সবাই দুঃখের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এমন সসময় মায়ের শরীরে আমার আগমনের বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই সবাই খুশিতে আত্মহারা হবার যোগাড়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল আমার জন্মের সময়। দুই দিন প্রসব যন্ত্রণায় মা ছট্ফট্ করে কাটালেন। কিন্তু কোন আশার আলো দেখাতে পারলেন না। গ্রাম্য দাই এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে মুখ কালো করে বিদায় নিলেন। তৃতীয় দিনে বাধ্য হয়ে বাবা সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে একটা মাঝির নৌকা ভাড়া নিয়ে মাকে মহাকুমা সদরে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই হাসপাতাল পর্যন্ত আর যেতে হয়নি। মাঝ পথেই আমার জন্ম হয়। তাই হয়তো নদীর প্রতি আমার আজন্ম টান।
সেই টান আর গোমস্তার মুখে রূপকথার মত গল্প আমার মনে দুরন্ত নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই সব নিষেধ অগ্রাহ্য করে একদিন লুকিয়ে বাওয়ালী নৌকায় চড়ে বসি।

এাঁ ছিল আমার প্রথমবার বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়া। প্রথম দিন ভোর হওয়া পর্যন্ত মনটা একটু কেমন কেমন করছিল। কিন্তু সকাল হতেই চারপাশের জগত তার সব রূপ-রঙ নিয়ে আমায় প্রলুব্ধ করতে থাকে। সময়টা ছিল ভরা বর্ষার মৌসুম। বিচিত্র আকার এবং রঙের মেঘের আড়ালে যখন সূর্য উঁকি দেয় আমাদের নৌকার সারি তখন সবেমাত্র কচা নদীতে পড়েছে। কচা তখন প্রচন্ড উত্তাল। গোমস্তা আমায় ডেকে নিয়ে হালের কাছে উঁচু পাটাতনের উপর বসিয়ে নদীর বর্ণনা দিচ্ছে। সন্ধ্যার আগেই আমরা কচা নদী থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে পানগুছি নদীতে ঢুকে পড়ি। আমার জন্যই এক সময়ের জাঁদরেল বৃটিশ শাসক রবার্ট মোরেলের সমাধির কাছে মোরেলগঞ্জ বন্দরে নৌকা নোঙ্গর করে। তখন সবেমাত্র রাত নামছে। মাস দুই কাটানোর মত টুকিটাকি কেনাকাটা করে রাতের খাবার সেরে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমাদের নৌকা বহরও পানগুছি পিছনে ফেলে ভোলা নদীতে এসে পড়েছে। এই নদীটাই সুন্দরবনের ভিতর ঢুকে গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা বনের ধারে চলে যেতে পারব।

রাজে আলীর গল্পের চেয়েও সুন্দরবনের বৈচিত্র্য আমার মন কেড়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল আমার খাওয়া নিয়ে। নৌকায় যে লোকটা রান্না করত তার প্রতিদিনের মেনু ছিল আলুসিদ্ধ আর ডাল। অথচ বনের ভিতর মাছের ছড়াছড়ি। চাইলেই হাতের কাছে মাছ। কিন্তু সবাই দিনের পর দিন নিরামিষ খেতো। দু’দিন পর গোমস্তাকে বললাম- আমি এসব খেয়ে থাকতে পারব না। আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিন।

লোকটা পড়ল মহাফাপড়ে। মালিকের ছেলের অযত্ন হলে তার চাকুরি থাকবে! আর বনের ভিতর সে আমার জন্য কি ব্যবস্থাই বা করবে! অবশেষে রান্নার লোকটাই একটা পথ বাতলে দেয়- ভোলা নদীর ওপারে খানিকটা দূরেই জনবসতি আছে। সেখানে কোনো ঘরে টাকার বিনিময়ে যদি খাবার ব্যবস্থা করা যায়!

খুঁজে খুঁজে অবশেষে উপায় পাওয়া গেল। প্রতিদিন দুপুরে ছোট নৌকায় করে আমায় সেই ঘরে দিয়ে যেত আবার সন্ধ্যার সময় ওরা কাজ শেষ করে নিয়ে যেত। কয়েকদিনের মধ্যে আমি নিজেই নৌকা নিয়ে যাওয়া-আসা করতে শুরু করি। আর কিছুদিন না যেতেই আসা যাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়- আমার সে ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়।

আমি ইচ্ছে করেই সেখানে থাকতে শুরু করি। কারণ সেখানেই আমি এক বনদেবীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তাকে নিয়ে সারাদিন নৌকা চড়া, মোষের পিঠে চড়া, কখনো বা মাছ ধরে সময় কাটতো। জনপদের শেষ প্রান্তের এই মানুষগুলোর ছিল নিসর্গের মত উদার মন, অকৃপণ ভালবাসা আর নিজেকে উজারড় করে দেবার মত সরলতা। স্বল্পদিনের পরিচিতা সেই যুবতী কখন তার হৃদয় রত্ন আমায় নিঃশেষে দান করে দেয় তা আমরা বুঝতে পারিনি। আমার ভুবনটাও তার মাঝে হারিয়ে ফেলি।

সুদিন হোক বা দুর্দিন সময় স্থির রয় না। সে তার মত বয়ে চলে। আমাদের যুগল চলা সময়টুকুও চোখের পলক না ফেলতে ফুরিয়ে আসে। এবার যাবার পালা। কিন্তু আমার যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। দুই মাস পূর্ণ হতে চলেছে, কখনো আমায় মা-বাবা কিংবা বাড়ির স্মৃতি পীড়িত করেনি। গোমস্তা রাজে আলী হয়তো সবকিছু অনুমান করে থাকবে। কিন্তু সে বারে আমি থাকার কারণেই হয়তো অন্যান্য বারের চেয়ে গাছ কাটা হয় অনেক বেশি আর লাভও হয় প্রচুর। তাই পালিয়ে সুন্দরবনে যাবার কষ্টটা বাবা নিমেষেই ভুলে যান। আর পরের বারে বনে যেতে কোন বাধা রইল না।
প্রথম প্রেমে পড়া যুবক-যুবতী রূপের নেশায় অথবা মোহে পড়ে যেসব ভুল করে ফেলে সবই আমরা করেছিলাম। আর তার পরিণাম হয় ভয়ঙ্কর। কিছুদিন যেতে কিশোরী দেহে মাতৃত্বের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রূপসার বাবা গিয়ে রাজে আলীকে ধরে।

-মেয়েটির নাম ছিল বুঝি রূপসা?

-হ্যা। পৃথিবীকে ওই নামে শুধু তাকেই মানায়। এমন রূপ আর পোড়া দুই চোখে সারা জীবনে দেখতে পেলাম না।
-তারপর কি হল?- অম্বর কৌতুহলী প্রশ্ন করে।

অভিজ্ঞ রাজে আলী অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে মালিকের ছেলেকে বাঁচিয়ে আনে। বলতে গেলে সারাজীবন নেমক খেয়েছে। সেই প্রতিদান দিয়ে প্রভুর ছেলেকে ঘরে নিয়ে আসে। আর আমাকে বাড়ি নিয়ে আসতেই শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। আমি তো হতবাক! কিন্তু বাবা-মার মুখ আশ্চর্য রকম ভারী। তাদের কাছে কিছু বলতেও সুযোগ পাই না। অবশেষে রাজে আলীর শরণাপন্ন হয়ে জানতে পারি রূপসার বিয়ে হয়ে গেছে।

সে পর্যন্ত জীবনে আমি দুঃখ-কষ্ট কাকে বলে জানতে পাইনি। প্রথমবার মনেহল আমার পৃথিবীটা কোন প্রচন্ড আঘাতে কাঁচের মত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলায় ছড়িয়ে গেছে। আমি রূপসাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যাই রূপসাদের বাড়ি। কিন্তু তারা যেন আমাকে আর চেনে না! কারো কাছে রূপসার খোঁজ পেলাম না। আমার সামনে দুটো পথ খোলা- হয় আত্মহত্যা করা নয় যেভাবেই হোক রূপসার কাছে যাওয়া।
অনেক ভেবে ভেবে স্থির করলাম- রূপসার সাথে দেখা না করে আমি মরতেও পারব না। তাই অপেক্ষা করতে হবে। বাবার কাঠের আড়তে বসে গেলাম। কারণ, দেশের নান অঞ্চলের ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ হবে! রূপসাকে খুঁজতে সুবিধা হবে। এমনি করে কখন যে তিন-চারটে বছর উড়ে গেল টের পাইনি। একদিন রাজে আলী আড়তে আসে আমার সাথে কথা বলতে। তখন সে আর আমাদের গোমস্তা নেই। স্বাধীনভাবে কাজ করে। তার কাছে জানতে পাই- রূপসার দুর্দিনে তার বাবা-মাকে সে-ই টাকা-পয়সা দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কিন্তু তার ফল যে এমন হবে তা কে জানত! যে সন্তান গর্ভে নিয়ে রূপসা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল প্রসবের সময় সে মারা যায়। রূপসা বিয়ের পর থেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল। কিন্তু বাচ্চাটা মারা যাবার পর একেবারেই পাগলের মত আচরণ করতে থাকে। স্বামীর কাছে ওই মেয়ের জন্ম-রহস্য বলে দেয়। তারপর একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

রাজে আলীকে অঢেল টাকার বিনিময়ে রূপসাকে খোঁজার ভার দিই। আর আমি ব্যাকুল আগ্রহে তার পথ চেয়ে থাকি। আরও এক বছর প্রায় কেটে যায়। একদিন সকালে রূপসাকে নিয়ে রাজে আলী ফিরে আসে। কিন্তু এ কে! আমিই চিনতে পারছিলাম না! ফুলবাগানে বজ্রপাত হলে কিছুদিন পর বাগানের যে দশা হয় শ্রীহীন রূপসা ঠিক তেমন। কিন্তু আমাকে চিনতে পারে। আমায় দেখে সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রাজে আলী তাকে স্বান্তনা দিয়ে নিজের দোষ সব স্বীকার করে নেয়। বলে- একদিন আমিই তোমাদের দু’জনকে আলাদা করে দিয়েছিলাম। আজ এক করে দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করছি।

মিনাক্ষীর চোখ জলে ভরে ওঠে। বলে- পুরুষের কঠিন প্রাণ! তাই রূপসার অন্তরের কথা আপনারা বুঝতে পারেন না।

-বুঝতে পারি মা! কিন্তু সমাজ বুঝতে দেয় না। তবে সমাজকে আমি অস্বীকার করেছি, শুধু সমাজকে নয় চারপাশের সবকিছুকেই।

রূপসা ফিরে এলে বাবা আর স্নেহশীল পিতা থাকেন না। তিনি হয়ে ওঠেন নির্মম বিচারক, ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণের কর্তা। ফলে রূপসাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর পথ থাকে না। কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়? ব্যবসার সূত্রে বাবার সারা দেশে যাতায়াত, পরিচিতি। মনে এক অদ্ভুত খেয়াল এল। রূপসাকে নিয়ে ভিড়ে গেলাম এক বেদের বহরে। দেশের সব নদ-নদী চষে বেড়ালাম। রূপসা আর আমার জীবন তখন নদীর মতই। কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, কোথায় স্থিরতা কিছুরই ঠিক নেই। শুধু বয়ে চলা। এই শান্ত প্রবাহ তো পরক্ষণেই প্রচন্ড উত্তাল, সবকিছু ভাসিয়ে নেয়া। সেদিন নদীর ভালবাসা বাঁচিয়ে রেখেছিল রূপসা আর আমার ভালবাসাকে। আমরা আবার জীবনে ফিরতে পেরেছিলাম। রূপসা ক্রমশঃ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে থাকে। একদিন নিজেই বলে- এভাবে ভেসে ভেসে আর কতদিন চলবে! তার চেয়ে চলো, কোন নদীর তীরে ছোট্ট একটা কুটির বেঁধে সেখানে দু’জনে জীবন কাটাই।

ভেবে দেখলাম মন্দ হয়না। এতদিন তো নদীতে কাটালাম! এবার নদীর তীরের জীবনটা একটু উপভোগ করি। সর্দারের কাছে অনুমতি নিয়ে চলে এলাম এখানে। এই যে বাঁকটা দেখছো, এর উপরের বাঁকে এসে মিলেছে দু’টি প্রসিদ্ধ নদী- মধুমতী আর বেলুয়া। এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলে উৎপত্তি হয় কালীগঙ্গার। যেমন রূপসা আর আমার জীবন এসে মিলেছে এইখানে। তাই কালীগঙ্গার জন্য মনের ভিতর ভীষণ টান। তারই ডাকে এখানে এসে ঘর বাঁধি।
সময়টা বছরের প্রথম। কালীগঙ্গা সারাদিন শোঁ শোঁ শব্দে বইতে থাকে। একদিন রূপসাকে বললাম- ঘর তো হল, এবার একটু শিকর গেড়ে বসতে হয়! শুধু দু’জনে কি জীবন কাটে! তারচেয়ে নতুন জীবন আসুক। চলো একটা সন্তান নিই।

একথায় রূপসা এত বিচলিত হয়ে ওঠে যে সে যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। বলে চলো, আজ প্রাণ ভরে কালীগঙ্গায় ডুব-সাঁতার খেলি। নদী যেন আমাকে ডাকছে। আমি স্থির থাকতে পারছি না। তোমার কথা পরে ভাবা যাবে। বলে ছুটে গিয়ে নদীতে নামে।

কালীগঙ্গা তখন প্রচন্ড উত্তাল। সাগর থেকে বয়ে আনা নতুন জোয়ারে সে দিগ্বিদিক আত্মহারা। তার মধ্যে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রমশঃ ভিতরে যেতে থাকে রূপসা। প্রথমটায় আমারও বেশ মজা লেগেছিল। কিন্তু এক সময় ভয় ধরে যায়। আমি প্রাণপণে রূপসাকে ডাকতে থাকি। কিন্তু সে তখন প্রবল স্রোতের সাথে হাসতে হাসতে ভেসে চলছে। উপায়ান্তর না পেয়ে আমিও ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ততক্ষণে রূপসা মাঝ নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমি যত চিৎকার করে তাকে ফিরতে বলি সে হেসে বলে- কালীগঙ্গা আমায় ডাকছে। তুমি ফিরে যাও।
আতঙ্কে আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসে। আমি প্রাণপণে রূপসার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফেরে দেখি এক জেলে ডিঙ্গিতে শুয়ে আছি, একা।

চারপাশে ভয়ঙ্কর নীরবতা। শুধু কালীগঙ্গায় উত্তাল ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দে যেন রূপসার অ-হাস্য শোনা যাচ্ছে। ফ্যাকাশে আলোয় দেখা যায় বৃদ্ধ হারাধন কালীগঙ্গার দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে শুধুই শূন্যতা।

রাত কতটুকু বাকি আছে বোঝা যায় না। আকাশে কোন তারারও দেখা নেই। শুধু মেঘের ফাঁকে এক ফালি চাঁদ জেগে আছে। অম্বর মৃদু স্বরে বলে- আপনি নিজের ঘরে ফিরে যেতে পারতেন না? আবার বিয়ে-থা করে সংসারী হতেন!

-তা কি করে হয়! এই কালীগঙ্গা ছেড়ে পৃথিবীর আর কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারব না। এর সাথে মিশে আছে আমার প্রিয়তমা। প্রতিদিন তার মাঝে অবগাহন করি, তার স্পর্শে ধন্য হই। এই কুহক ছেড়ে বাঁচতে চাই না যে! আজ কালীগঙ্গা আর রূপসা আমার মনে অভিন্ন। ওরা দু’জনে এক হয়ে আমাকে গভীর মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে। কী করে আমি সে বাঁধন ছিঁড়ে যাই!

সন্তোষ কুমার শীল: কথাসাহিত্যিক


সন্তোষ কুমার শীল এর আরও লেখা….

প্রাণের দোসর কালীগঙ্গা ।। সন্তোষ কুমার শীল

সংশ্লিষ্ট বিষয়