কোপাই নদীর হেরিটেজ মর্যাদার জন্য আবেদন করবো 

Tuhin Shuvra Mandal

নদীর কথা বললেই কোন্ কবিতার লাইন সবার মনে আসে বলুন তো! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমাদের ছোট নদী। “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,  বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে” দিয়ে লেখা শুরু করেছেন কবি। (যদিও আমাদের ছোটবেলায় পড়া আঁকে বাঁকের বদলে এখন বাঁকে বাঁকে পাওয়া যায়)  বলুন তো কোন্ নদীকে দেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন? ঠিক ধরেছেন। কোপাই নদীকে নিয়েই। প্রাণের কোপাই নদীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘কোপাই’ নামে একখানি কবিতাও আছে।

এখন যখন ফিরে দেখা হচ্ছে সব নদীকে। তখন ফিরে তাকানো যাক কোপাই নদীর দিকে। কেমন আছে কোপাই? তার আগে রবীন্দ্রনাথের নাম দেওয়া এই কোপাই নদী সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য জেনে নেওয়া যাক। ময়ূরাক্ষী নদীর উপনদী কোপাই নদীর উৎপত্তি ঝাড়খন্ডের জামতাড়া জেলার খাজুড়ি গ্রাম থেকে। উৎপত্তির সময় এই নদীর নাম শাল। পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরের বিনুরিয়া গ্রামের কাছে নদীর নাম বদলে হয়েছে কোপাই। লাভপুরে হাঁসুলি বাঁকের কাছে বক্রেশ্বরে মিশে গিয়েছে কোপাই।

এই নদীর অববাহিকাতেই আছে খোয়াইয়ের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য, যা এক বিস্ময়। সেই নদীতে গিয়েই দেখা গেল নদীর হতশ্রী চেহারা। জল নেই। নদী মজে যাওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যদিও এই সময়তে কোপাই নদীতে বেশী জল কোন সময়তেই ছিল না। তার প্রমাণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরের কবিতাটি। আবার কোপাই কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ কলেছেন  “প্রাচীন গোত্রের গরিমা নেই তার….’ অথবা ‘ ছিপছিপে ওর দেহটি” ইত্যাদি।

কোপাই নদী
কোপাই নদী । ছবি: রিভার বাংলা ডট কম

কিন্ত নদীর অসুখ? সেটা কি? উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত একশো দশ কিলোমিটার গতিপথে অনেক জায়গাতেই গজিয়ে উঠেছে ইটভাটা এবং চলছে যথেচ্ছ বালি লুঠ। সেটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেআইনি ভাবে। আর তার ফলে নরীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। নদীর গতিপথও বদলে যাচ্ছে। উৎস স্থল খাজুড়ি, লোকপুর, বীরভূমের বিনুরিয়া এমনকি মোহনায় হাঁসুলি বাঁকের কাছেও ইটভাটা গজিয়ে উঠেছে অবৈধ ভাবে। সমস্যা আরও আছে। সেচ দপ্তরও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাঁধ দিয়ে ক্যানেল করেছে, যাতে নদীর চলার যে স্বাভাবিক ছন্দ সেটাই নষ্ট হচ্ছে। কিছুদিন আগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মলয় মূখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে গবেষক ও ছাত্র- ছাত্রীদের করা সমীক্ষাতে এই কথা গুলোই উঠে এসেছে।

এই তো সেদিন কোপাই নদী পাড়ের স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে দেখা গেল কবিগুরুর আবেগের নদীটির সাথে আর আত্মীয়তা যেন অনুভব করছেন না তারা। নদীটিকে নিয়ে ভাবনা দরকার। দরকার সচেতনতার। আর দরকার তার দিকে দৃষ্টি ফেরানোর। কারণ কে না জানে যে নদী আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি আর জীবনের নাম। যে নদীর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে আছে বিশ্ববরেন্য কবি ও মনীষী ও নোবেল সম্মানে ভূষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম , আর ক’ দিন পরেই যখন দেশে নতুন সরকার গঠিত হবে তখনই কোপাই নদীর হেরিটেজ স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করবো বিশ্বভারতীর উপাচার্য তথা দেশের প্রধান মন্ত্রীর কাছে। তার প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করেছি। এই নদীর জন্য কিছু করতে পারলে তবেই রবীন্দ্রনাথের প্রাণের কোপাই নদীকে মর্যাদা দেওয়া হবে।

আরো পড়তে পারেন…

“বাংলাদেশে কোনো নদীভাঙন থাকবে না”

কবি ইন্দ্রনীল সুমন এর একগুচ্ছ কবিতা

“না ভাটিতে, না উজানে – ফারাক্কার প্রভাব কোথাওই সুখকর হয়নি

……………………………………………………………………….

।। কোপাই ।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

পদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়,

মনে মনে দেখি তাকে।

এক পারে বালুর চর,

নির্ভীক কেননা নিঃস্ব, নিরাসক্ত—

অন্য পারে বাঁশবন, আমবন,

পুরোনো বট, পোড়ো ভিটে,

অনেক দিনের গুঁড়ি-মোটা কাঁঠালগাছ—

পুকুরের ধারে সর্ষেখেত,

পথের ধারে বেতের জঙ্গল,

দেড়শো বছর আগেকার নীলকুঠির ভাঙা ভিত,

তার বাগানে দীর্ঘ ঝাউগাছে দিনরাত মর্মরধ্বনি।

ওইখানে রাজবংশীদের পাড়া,

ফাটল-ধরা খেতে ওদের ছাগল চরে,

হাটের কাছে টিনের-ছাদ-ওয়ালা গঞ্জ—

সমস্ত গ্রাম নির্মম নদীর ভয়ে কম্পান্বিত।

 পুরাণে প্রসিদ্ধ এই নদীর নাম,

 মন্দাকিনীর প্রবাহ ওর নাড়ীতে।

 ও স্বতন্ত্র। লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলে যায়—

 তাদের সহ্য করে, স্বীকার করে না।

 বিশুদ্ধ তার আভিজাতিক ছন্দে

এক দিকে নির্জন পর্বতের স্মৃতি, আর-এক দিকে নিঃসঙ্গ সমুদ্রের আহ্বান।

 একদিন ছিলেম ওরই চরের ঘাটে,

  নিভৃতে, সবার হতে বহুদূরে।

  ভোরের শুকতারাকে দেখে জেগেছি,

 ঘুমিয়েছি রাতে সপ্তর্ষির দৃষ্টির সম্মুখে

  নৌকার ছাদের উপর।

 আমার একলা দিন-রাতের নানা ভাবনার ধারে ধারে

 চলে গেছে ওর উদাসীন ধারা—

 পথিক যেমন চলে যায়

 গৃহস্থের সুখদুঃখের পাশ দিয়ে, অথচ দূর দিয়ে।

তার পরে যৌবনের শেষে এসেছি

তরুবিরল এই মাঠের প্রান্তে।

ছায়াবৃত সাঁওতাল-পাড়ার পুঞ্জিত সবুজ দেখা যায় অদূরে।

এখানে আমার প্রতিবেশিনী কোপাই-নদী।

প্রাচীন গোত্রের গরিমা নেই তার।

অনার্য তার নামখানি

কত কালের সাঁওতাল নারীর হাস্যমুখর

কলভাষার সঙ্গে জড়িত।

গ্রামের সঙ্গে তার গলাগলি,

স্থলের সঙ্গে জলের নেই বিরোধ।

তার এ পারের সঙ্গে ও পারের কথা চলে সহজে।

শণের খেতে ফুল ধরেছে একেবারে তার গায়ে গায়ে,

জেগে উঠেছে কচি কচি ধানের চারা।

রাস্তা যেখানে থেমেছে তীরে এসে

সেখানে ও পথিককে দেয় পথ ছেড়ে

কলকল স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতের উপর দিয়ে।

অদূরে তালগাছ উঠেছে মাঠের মধ্যে,

তীরে আম জাম আমলকীর ঘেঁষাঘেঁষি।

ওর ভাষা গৃহস্থপাড়ার ভাষা —

তাকে সাধুভাষা বলে না।

জল স্থল বাঁধা পড়েছে ওর ছন্দে,

রেষারেষি নেই তরলে শ্যামলে।

ছিপ্‌ছিপে ওর দেহটি

বেঁকে বেঁকে চলে ছায়ায় আলোয়

হাততালি দিয়ে সহজ নাচে।

বর্ষায় ওর অঙ্গে অঙ্গে লাগে মাত্‌লামি

মহুয়া-মাতাল গাঁয়ের মেয়ের মতো—

ভাঙে না, ডোবায় না,

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আবর্তের ঘাঘরা

দুই তীরকে ঠেলা দিয়ে দিয়ে

উচ্চ হেসে ধেয়ে চলে।

শরতের শেষে স্বচ্ছ হয়ে আসে জল,

ক্ষীণ হয় তার ধারা,

তলার বালি চোখে পড়ে,

তখন শীর্ণ সমারোহের পাণ্ডুরতা

তাকে তো লজ্জা দিতে পারে না।

তার ধন নয় উদ্ধত, তার দৈন্য নয় মলিন;

এ দুইয়েই তার শোভা —

যেমন নটী যখন অলংকারের ঝংকার দিয়ে নাচে,

আর যখন সে নীরবে বসে থাকে ক্লান্ত হয়ে,

চোখের চাহনিতে আলস্য,

 একটুখানি হাসির আভাস ঠোঁটের কোণে।

 কোপাই আজ কবির ছন্দকে আপন সাথি করে নিলে,

 সেই ছন্দের আপস হয়ে গেল ভাষার স্থলে জলে,

 যেখানে ভাষার গান আর যেখানে ভাষার গৃহস্থালি।

তার ভাঙা তালে হেঁটে চলে যাবে ধনুক হাতে সাঁওতাল ছেলে;

পার হয়ে যাবে গোরুর গাড়ি

আঁটি আঁটি খড় বোঝাই করে;

 হাটে যাবে কুমোর

 বাঁকে করে হাঁড়ি নিয়ে;

 পিছন পিছন যাবে গাঁয়ের কুকুরটা;

 আর, মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরু

 ছেঁড়া ছাতি মাথায়।।

 

সংশ্লিষ্ট বিষয়