জলপুরুষ রাজেন্দ্র জি। হ্যাঁ, আমি ওনাকে এভাবেই সন্বোধন করি। এত উঁচুদরের কিন্ত কি সহজ সরল মানুষ! থাকা – খাওয়ার কোন বাহুল্য নেই। কি করে বলতে পারছি এই কথা গুলো? কাছ থেকে দেখেছি যে! সম্প্রতি বালুরঘাটে একটি নদী- কর্মশালায় এসে রাজেন্দ্র সিং এসেছিলেন। তাই লিখতে গিয়ে আগে এসবই মনে পড়লো।
রাজেন্দ্র সিং – ভারতবর্ষের জলপুরুষ হিসাবে যিনি পরিচিত। ওয়াটার নোবেল পুরষ্কার বিজেতা রাজেন্দ্র সিং এশিয়ার নোবেল হিসাবে পরিচিত ম্যাগসেসে পুরষ্কারেও সম্মানিত। পরিবেশের কাজ করতে করতেই রাজেন্দ্র সিং নামটার সাথে পরিচিত হই। তারপর তার কাজ এবং তরুন ভারত সংঘের সম্পর্কে অবহিত হই। তারপর তার সাথে যে হঠাৎই সাক্ষাৎ হয়ে যাবে সেটা ভাবতেই পারিনি। সে কথায় আসছি একটু পরে। তার আগে তরুন ভারত সংঘের জল বিরাদরির কথায় আসি।
আমার মুর্শিদাবাদের বন্ধু মেহেবুব আলম জানালো যে দিল্লীতে তরুন ভারত সংঘের উদ্যোগে “জল বিরাদরি” অর্থাৎ জল নিয়ে সভা হবে, আমি যেন সেখানে যাই এবং নদী ও জল নিয়ে আমার বক্তব্য রাখি। আসলে সে সময় স্বামী সানন্দ অর্থাৎ অধ্যাপক জি ডি আগরওয়াল গঙ্গার অবিরলতা ও নির্মলতার জন্য লাগাতার অনশন করছেন এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার তাকে গুরত্ব দিচ্ছে না। ক্রমশ: খারাপ হচ্ছে জি ডি আগরওয়ালের স্বাস্থ্য।তার সমর্থনেও সভা ছিল। রাজেন্দ্র সিং সেখানে থাকবেন। ফলে না যাওয়ার প্রশ্নই নেই। কেননা ততদিনে জেনে গিয়েছি যে রুক্ষ, শুষ্ক রাজস্থানে মানুষের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করে কি ভাবে জল এনেছেন। কিন্তু বাদ সাধলো আমার কাজের সিডিউল।সামনেই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ কলকাতায়। তারপরই আত্রেয়ীর কথা বলতে ঢাকা যাবো। ফলে মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। খারাপও লাগছে।কিন্তু কিছু করার নেই। সে যাত্রায় আমার এক দিল্লীতে থাকা দিদি জয়িতা ঘোষ আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। সেটা যে কত বড় জরুরী ছিল তা বোঝাতে পারবো না। সে যাত্রায় আর দেখা হলো না।
তারপর আরো একবার। গত জানুয়ারী মাস। রাজেন্দ্র জি তখন সমগ্র ভারতবর্ষের যে রাজ্যগুলি দিয়ে গঙ্গা নদী প্রবাহিত হয়েছে সে সব রাজ্যে গঙ্গা সদ্ভাবনা যাত্রা করছেন।সেই কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে আসবেন। সে সময় তার এই যাত্রার পশ্চিমবঙ্গের একজন কো- অর্ডিনেটর হিসাবে আমিও ছিলাম। তখনই বালুরঘাটে ওনার আসবার কথা ছিল। সে মতো সব ঠিক হয়ে গেল। কোথায় থাকবেন, কোথায় কোথায় নদী দেখবেন, নদী পাড়ের মানুষদের সাথে কথা বলবেন সব ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু অধিক ব্যস্ততার জন্য সেই কর্মসূচি আর হলো না। জেলায় কিংবা বালুরঘাটেও তার আর আশা হলোনা। চূড়ান্ত হতাশ হলাম।
তারপর কোলকাতাতেই ওনার সাথে দুদিন পর সাক্ষাৎ হলো। প্রায় দেড় ঘন্টা নদী নিয়ে আড্ডা, কথোপকথন চললো। ছিলেন বিশিষ্ট পরিবেশ সাংবাদিক জয়ন্ত বসু, পরিবেশ কর্মী শশাঙ্ক দেব, পরিবেশ নিয়ে কাজ করে ‘অক্সফাম’- এর কলকাতা অফিসের দায়িত্ব প্রাপ্ত অশোক কুমার নায়েক।রাজেন্দ্রজির সঙ্গে ছিলেন সঞ্জয় সিং এবং স্নেহাল দন্ডে। যার কথা এতদিন শুনেছিলাম তাকে দেখছি সরাসরি। অদ্ভূত এক ভাললাগায় মন ভরে যাচ্ছিল।কারণ নদীকে ফিরিয়ে আনার বিশালকায় কাজ সম্পর্কে আমি জানতাম। তাই ভাল লাগাটা গভীর ছিল। সেদিন নদী, নদীকে ঘিরে রাজনীতি, গঙ্গাকে ঘিরে ভুল পরিকল্পনা, গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান, ন্যাশনাল ক্লিন গঙ্গা মিশন, নমামি গঙ্গে ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল।তারপর একসাথে বসে খাওয়ার সে স্মৃতি ভোলার নয়।
পরদিন কলকাতায় ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সেমিনারে ওনার বক্তব্য ছিল। অন্যতম বক্তা ছিলেন জয়ন্ত বসুও।সেদিন সৌভাগ্যক্রমে আমিও উপস্থিত ছিল। সেদিন যা বলেছিলেন, বালুরঘাটেও অধিকাংশই সে কথা বললেন। এত জীবন্ত সে কথা এবং এত উজ্জীবিত করে যে সেটা একটা বিষয়।
এবার বালুরঘাটে আসার আগে থেকেই ওনার সাথে কথা হচ্ছিল । এবং গতকাল যখন বালুরঘাটে প্রবেশ করছেন তখন নিজেই ফোন করে বললেন।পরে আরো একবার কথা হলো এবং শেষে দেখা হলো । নদী চেতনা বৃদ্ধি, জল সাক্ষরতা অভিযান, নদীর অসুখ, জলহীনতা, নদী পুনরুদ্ধারে শিক্ষার প্রায়োগিক দিক, নদী সমস্যার সমাধান এসব নিয়ে স্বত:স্ফূর্ত ভাবেই বলছিলেন। নদীর বুকে কি করে জল ধরে রাখা যায় তার দিকনির্দেশ করছিলেন।তখন মনে হচ্ছিল ছোট জায়গায় থেকেও আমরাও কিছু কিছু চাজ করছি যে ভাবনার সাথে ওনার ভাবনা মেলে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল কলকাতায় কাটানো সময়ের কথা।ওনার নদী দর্শনের কথা।নদীর পুনরুজ্জীবনের কথা। রাজেন্দ্রজি আপনি ভাল থাকুন। আর এভাবেই নদীর সেবা করে যান।আমরা আপনার দেখানো পথে নিশ্চয়ই এগিয়ে চলবো, যে পথে নদী জেগে ওঠে, জেগে ওঠে মানুষ।
আরো পড়তে পারেন….
সিলেটে সুরমা তীর পরিষ্কারে ৩ ব্রিটিশ এমপি
দেখে এলাম এশিয়ার প্রথম পানি জাদুঘর : অনন্য এক অভিজ্ঞতার কিঞ্চিৎ বয়ান