বিস্তৃত অববাহিকা ও জীবন্ত ব-দ্বীপের দেশ বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক অলঙ্কার হলো নদী। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো এ দেশের অহঙ্কারের সচল ধারা। নদী এ অঞ্চলের লোকজ ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, সামাজিকতা, সংস্কৃতি আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে মেলে ধরেছে স্মরণাতীতকাল থেকে। নদীর অবস্থান, আচরণ, বিস্তৃতি, সামাজিকতা, প্রথাগত ঐতিহ্য এ দেশকে শুধু নদীমাতৃক দেশে রূপান্তরিত করেনি; দিয়েছে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে সমৃদ্ধি। হাজার বছরের বাঙালিয়ানার শিকড় এভাবেই প্রোথিত হয়েছে গভীরে।
বাংলাদেশ যে ঐতিহ্য ধারণ, লালন ও চর্চা করে; অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে নদীর অবস্থান এর সিংহভাগজুড়ে। নদী তাই আমাদের ঐতিহ্য, অস্তিত্বের অংশীদার। নদীকেন্দ্রিক শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, সম্প্রীতি, সংহতিকে সুদৃঢ় ও বিস্তৃত করেছে। জীব-বাস্তুতান্ত্রিকতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
বাঙালির যা ঐতিহ্য, যা ইতিহাস সব নদীমিশ্রিত, নদীআশ্রিত, নদীপ্রশ্রিত। পল্লীগীতি, জারি-সারি, ভাটিয়ালি প্রভৃতিতে নদী বিমূর্ত, নদী জীবন্ত, নদী উপাখ্যান। নদীর জলে অবগাহন, নদীর জলে পরিশুদ্ধি, নদীর জলে চাষবাস, ভূমি উর্বরা, পলিপতন, ভূমির পুষ্টি-বৃদ্ধি যোগাযোগ, যুগে যুগে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। নদী দিয়েছে, আমরা নিয়েছি শুধু। এভাবে নদী অসুস্থ হয়ে বিলীন হয়েছে। তবু আমরা থেমে থাকিনি। আমাদের অভাব পূরণ হয়নি। আমাদের সীমাহীন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নদী তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। আমরা তবুও থামিনি। বেদনা, তাড়না, বিসর্জন, বিপদে নদী আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়েছে। পানিতে ভাসা, সাগর থেকে জাগা অবিরাম বৃষ্টিপাতের দেশ বাংলাদেশ। উজান থেকে বয়ে আসা পলিমাটির দেশ। পৃথিবীর সুবিশাল উর্বরতম ভূমির দেশ বাঙালির বাংলাদেশ। সমতল পলিসমৃদ্ধ মাটির বুক চিরে সোহাগে বয়ে যাওয়া মায়াবী হাজার নদীর দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাঙালির চোখের জল, বাংলার নদীর জলের সঙ্গে একাকার হয়ে জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির মহামিলন ঘটায় এই বাংলাদেশে। হাজার বছরের বাঙালির জীবন কেটে গেছে নদীর জল, চোখের জল, সুখ আর দুঃখের জলে অবগাহন করে। নদী ও নারী, নদী ও জীবন, নদী ও সংস্কৃতি তাই অবিচ্ছেদ্য, অবিভাজিত, পরিপূরক এখানে। বৈচিত্র্যময় নামের ব্যঞ্জনা, ঐতিহ্যময় প্রবাহের রসময়তা বাংলাদেশের নদীকে জীবনমুখী করেছে। জীবনধর্মী করেছে এর প্রতিবেশ, পরিবেশ ও বাস্তুতান্ত্রিকতাকে। বিল-জলাভূমি, হাওর-বাঁওড়, নদী ও মোহনা, সবেতেই বাঙালির জীবনের ছুঁয়ে যাওয়া পরশ। বাঙালিয়ানার জীবনপ্রবাহ। ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে বদলে যাওয়া নদীর রূপ-প্রকৃতি বাংলাকে, বাংলাদেশকে অভাবিতভাবে যে বৈচিত্র্য দান করে, পৃথিবীতে তার তুলনা মেলে কোথায়?
এভাবে বহুমাত্রিক ঐতিহ্য আমাদের অতীতকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। ঐতিহ্যের উজ্জ্বল আলোয় সমৃদ্ধ, অতীতের প্রেরণায়, আমাদের বর্তমান আরও আলোকিত, আরও বিকশিত হতে পারত। সমৃদ্ধি আমাদের সুউচ্চ শিখরে নিয়ে অফুরন্ত আলোক ছড়াতে পারত অনন্তকাল। আমাদের আলোয় আলোকিত হতো সমসাময়িক ভুবন। কিন্তু তা হয়নি কার্যত। কারণ ঐতিহ্য ও অহঙ্কারে অনুষঙ্গের অনেক অধোগতির সঙ্গে নদী ঐতিহ্যকেও আমরা নির্মূল করতে উদ্যত। পদ্মা, যমুনা, কর্ণফুলী, হালদা, ব্রহ্মপুত্রের মতো আন্তর্জাতিক নদ-নদী এখন বহুমাত্রিক নির্যাতনের শিকার। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নদ-নদীগুলো সীমাহীন আগ্রাসনের শিকার। আমাদের নদ-নদী এবং এদের শাখা-প্রশাখা সঙ্গত কারণেই প্রবাহ সংকটে। নাব্য হারিয়ে অনেক নদীই মৃত্যুর ক্ষণ গুনছে। এরা এখন মুমূর্ষু।
অপরিকল্পনা, অপকর্ম, অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অসঙ্গত কর্মযজ্ঞ, অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন বিলাস আমাদের দেশীয় নদীগুলোকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। বিপদাপন্ন, মহা বিপদাপন্ন অথবা বিলুপ্তির পথে অনেক নদী। দিনে দিনে দুর্দশাগ্রস্ত নদীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী বা মুক্ত জলাশয়ের ওপর অত্যাচার, অবিচার নদীর সংকট বা বিপন্নতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়কে। এভাবে অরক্ষিত নদ-নদী অরক্ষিত করে ফেলছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ এবং জীব-বাস্তুতান্ত্রিকতাকে।
দক্ষিণের চিত্রা, কীর্তনখোলা অথবা কপোতাক্ষ; উত্তরের করতোয়া, তিস্তা অথবা সুরমা, ব্রহ্মপুত্র, আর রূপসা-ভৈরব, কংস, সোমেশ্বরী নিজেদের বিপন্নতাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জানান দিচ্ছে সারা বছর। দখলদার ও ভূমিদস্যুদের দুর্দমনীয় প্রতাপে বিলীন হওয়ার পথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ’খানেক নদ-নদী। পাবনার ইছামতী, কিশোরগঞ্জের নরসুন্দর, বগুড়ার করতোয়া, শাহজাদপুরের বড়াল ও ছোট করতোয়া, নাটোরের নারদ নদ, তাড়াশের বেহুলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, রংপুরের শ্যামাসুন্দরী, নেত্রকোনার সোমেশ্বরী, কুমিল্লার গোমতী, জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ বিলুপ্তির বিহ্বলতায় বিদিশাগ্রস্ত। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে এসব নদ-নদী ভরাট, দখল, দূষণ ও নানাবিধ দানবীয়-অমানবীয় অত্যাচারের শিকার।
নদীর পরিচর্যা কোনোদিন আমরা করিনি। গতি পরিবর্তন, প্রবাহ বাধাগ্রস্ত, প্রবাহ বন্ধ, পানি প্রত্যাহার, বাঁধ নির্মাণ করে নদীর গতিকে রোধ করেছি। নদীকে নদীর হয়ে, নদীর কাছে, নদীরূপে থাকতে দিইনি। আন্তঃ ও আন্তর্জাতিকভাবে নদীকে আমরা হত্যা করেছি। সভ্যতা ভেদ করে আমরা উত্থিত হয়েছি নদীহন্তা হিসেবে।
আমরা নদীকে মেরেছি অথবা মারতে চেষ্টা করেছি রাসায়নিকভাবে, শিল্পবর্জ্য দূষণে, জঞ্জাল প্রভৃতি দিয়ে ভরাট করে। নদীকে মারতে চেষ্টা করেছি নদীর জীব-বাস্তুতান্ত্রিকতাকে নিশ্চিহ্ন করে। আমরা নদীকে মারতে সচেষ্ট তার প্রাকৃতিক পানি প্রবাহকে রোধ, প্রত্যাহার, বাধাগ্রস্ত করে, নাব্যকে নষ্ট করে, নদী দখল করে। নদী হত্যার কোনো প্রক্রিয়াই আমরা অবশেষ রাখছি না। নদীর ওপর স্থাপনা গেড়ে, বাঁধ নির্মাণ করে, রাবার ড্যাম নামের তথাকথিত প্রতিরোধ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে নদীকে আমরা প্রাকৃতিক থাকতে দিচ্ছি না। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণ অধিক উৎপাদনের নামে একটি অদ্ভুত জনপ্রিয় প্রক্রিয়া। নদী হত্যার এ এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবস্থা। নিকট অতীতে কার্প জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাছের প্রাকৃতিক একমাত্র প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীর পানি প্রবাহকে রাবার ড্যামের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ নদীর ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন করে ফেলা হচ্ছে। ওপরের প্রবাহের পলি পতন, সাগর থেকে উঠে আসা লবণাক্ততা; এ দুয়ের প্রাকৃতিক আগ্রাসনকে উস্কে দিচ্ছে জনপদ-জনগণের শিল্পবর্জ্য দূষণ-দখলসহ বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, নাফ থেকে মহানন্দা, অথবা হাড়িয়াভাঙা থেকে সুরমা- কোনো নদীই আজ সুরক্ষিত নয়। কোনো না কোনোভাবে আগ্রাসিত, আচ্ছাদিত, আস্টম্ফালনের চরম শিকারে পরিণত হয়েছে। অত্যাচারিত এসব নদীকে জাতীয়ভাবে নির্যাতনের রাহু থেকে মুক্ত করতে হবে। বহুতান্ত্রিক, বহুমাত্রিক নির্যাতন বৈচিত্র্য থেকে নদীকে মুক্ত করতে হবে।
বিশ্বের দৃশ্যমান উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনে জীববাস্তুতান্ত্রিক বিপন্নতার সংকট আমাদের শঙ্কিত করেনি। বিবেক আমাদের তাড়িত হয়নি। সভ্যতা আমাদের সঠিক মাত্রায় সভ্য করেনি। যেমন শিক্ষা আমাদের শিক্ষিত করেনি। পরিবেশ ভাবনা আমাদের ভাবিত করেনি। সংকটের আবর্তে বাস করেও আমরা শঙ্কিত নই। উদাসীনতা ও কেন্দ্রাভিমুখিনতা আমাদের বিপর্যয়কে ত্ব্বরান্বিত করেছে। আমাদের অপরাধ আছে, বোধ নেই। বিবেক আছে, তাড়না নেই। দৃষ্টি আছে, দর্শন নেই। মন আছে, মননশীলতা নেই। ২৫ হাজার কিলোমিটারের জলপথের নাব্য নিশ্চিহ্ন করে আমরা তাকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারে এনে দাঁড় করিয়েছি। তবুও আমাদের বোধ নেই। রাজধানীর বুকে বুড়িগঙ্গার বীভৎস রূপ দর্শন করেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আমাদের রক্তচাপকে বাড়িয়ে দেয়নি। তুরাগকে দখল-দূষণ থেকে চূড়ান্ত মুক্তি আমরা এখনও দিতে পারিনি। কর্ণফুলীর দুই তীরের দখলমুক্তি সূদুর পরাহত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়াই শিল্পবিলাস তো আছেই। আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সভ্যতার আবরণে ঢাকা পড়ে আছে।
ড্রেজিং দিয়ে উপরন্তু আমরা এর দূষণ ও দখলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছি। আইনের প্রয়োগ থমকে যাচ্ছে বারবার। এভাবে সারা দেশের অনেক নদ-নদীকে আমরা মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছি বিচ্ছিন্ন, বিভিন্ন ও ধারাবাহিকভাবে। মুক্ত জলাশয় ও নদীকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার নৈতিক অবস্থা আমাদের নেই। তবুও অপরাধবোধ এবং কৃতকর্ম যদি আমাদের সচেতন হতে সুযোগ করে দেয়, তবে তার প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ থাকা উচিত। এসব কারণে আমরা ইতিমধ্যে দেশ থেকে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী হারিয়েছি।
নদী আমাদের অস্তিত্বের অংশ, নান্দনিকতার উৎস। নদীকে হত্যা করে আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সচল ধারাকে অবলুপ্ত করতে চাই না। সভ্যতা প্রবহমান, সংস্কৃতি চলমান ধারায় পরিবর্তনের অগ্রদূত। নদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধানতম ধারক-বাহক। নদীকেন্দ্রিক জীবনপ্রবাহের এ ধারাকে সজীব ও জীবননির্ভর করতে হবে। জীবনের বাঁক ও বোধগুলোকে নদীর নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে জীবনকে প্রকৃতি ও জীবনসম্পৃক্ত রাখতে হবে। জীবনের দুঃখ-বেদনা, ভাঙা-গড়ার মতো নদীর ভাঙা-গড়া ও নিরবচ্ছিন্নতাকে জীবনের পরিবর্তনশীল প্রত্যয়ের অনুষঙ্গ করে নদী ও জীবনকে একাকার করে দেখাই আমাদের প্রতিশ্রুতি হওয়া দরকার। আসুন, আমরা নিজেকে নিঃশর্তভাবে নদীর কাছে নিয়ে যাই। নদীকে নদীর মতো করে, নদী ভেবে নদীর কাছে ফিরিয়ে দিই। নদী প্রকৃতি ও জীবন এবং জীববাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। একে অনন্য রাখি আজ ও আগামীর জন্য।
সূত্র: সমকাল, প্রকাশ: ০২ জুন ২০১৯।।