।। রিভার বাংলা ডট কম ।।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ‘নদী ভাঙন’ একটি বাস্তবতা। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। সম্প্রতি ‘পদ্মা’র ভাঙন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা। বহু বছর পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নদীর ভিন্ন জীবন কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। নাসার সেই প্রতিবেদন ও নদীভাঙন রোধে করণীয় প্রসঙ্গে সমকাল অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেন সার্ভিসেস’ (সিইজিআইএস)-এর ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও নদী-বিশেষজ্ঞ ড. মমিনুল হক সরকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাসলিমা তামান্না
সমকালঃ নাসার প্রতিবেদন বলছে, পদ্মার ভাঙনে ১৯৬৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি জমি বিলীন হয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবির ভিত্তিতে নাসা প্রতিবেদনটি তৈরি করে। দেশে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ আছে কি?
মমিনুল হক সরকারঃ দেশে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। সিইজিআইএস এ নিয়ে অনেক কাজ করেছে। ২০০৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পদ্মার ওপর অনেক কাজ হয়েছে। পদ্মার গতিপথ, প্রকৃতি সব কিছু নিয়েই গবেষণা হয়েছে।
সমকালঃ সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়া নদী ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে। বিলীন হয়ে গেছে বিশাল এলাকা। এই ভাঙন কি রোধ করা সম্ভব ছিল না?
মমিনুল হক সরকার : এবারই নতুন নয়; ওই এলাকায় আগেও নদী ভাঙন হয়েছে। কিন্তু এখন প্রচার মাধ্যমের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঘটনাটি বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। নদী তো আর এক জায়গায় থাকে না, যেখানে পলি উঠানো হয় নদী সেখানেই যায়। কেউ যদি মনে করেন যে, চর জেগেছে এবং তা একইরকম থাকবে; তাহলে সেটা ভুল। ১০ বছর পর পুরোটাই আবার নদীতে চলে যেতে পারে।
সমকালঃ নড়িয়ায় ভাঙন নিয়ে আপনাদের কোনো পূর্বাভাস ছিল কি?
মমিনুল হক সরকারঃ নড়িয়ায় ভাঙনের ধরণ দেখে বুঝেছি, আমরা যে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম সেটাই হয়েছে। যেভাবে ভাঙন বাড়ার কথা সেভাবেই বেড়েছে। পূর্বাভাস নিয়ে আসলে সরকার খুব বেশি পদক্ষেপ নিতে পারে না। যেটা পারে তা হলো, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ। এতে যেখানে ৩০০ মিটার ভাঙার কথা সেখানে হয়তো ২০০ মিটার ভাঙে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে ভাঙন ঠেকানো যায়।
সমকালঃ নদী ভাঙনে প্রতি বছর শত শত লোক নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। পূর্বাভাসের মাধ্যমে তারা কিভাবে উপকৃত হতে পারে?
মমিনুল হক সরকারঃ পূর্বাভাস পেলে দুর্গত লোকদের আগেভাগেই সতর্ক করা যায়, সহযোগিতা করা যায়। তখন তারা বাড়িঘর থেকে জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে পারে। ফসল কেটে ফেলতে পারে। তিন বছর ধরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক আমাদের পূর্বাভাস নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। তবে নদী ভাঙন রোধে স্থানীয় লোকজনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে, নদী ভাঙনের কবলে পড়লে তারা কি করতে পারে। যারা ভাঙনের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে তাদেরকে কিভাবে নিরাপত্তার আওতায় আনা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে হবে। আবার যারা নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছে তাদের সহযোগিতায় পরিকল্পনা নিতে হবে।
সমকালঃ নদী ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে সমন্বয়ের বিষয়টি কিভাবে দেখেন।
মমিনুল হক সরকারঃ নদী ভাঙন রোধ বিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়নে সাধারণত অনেক সময় লেগে যায়। তবে এ ধরনের কাজে সমন্বয় নিশ্চয় প্রয়োজন। একক কোনো বিষয়ের সঙ্গে নয়; অনেক কিছুর সঙ্গেই সমন্বয় প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ সিরাজগঞ্জের কথা বলা যায়। ২০০৪-০৫ সালে সিরাজগঞ্জে নদী ভাঙন দেখা দিলে সরকার ভাঙন রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলল। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেড় থেকে দুই বছর চলে গেল। ততদিনে দেখা গেল, ভাঙন আর আগের জায়গায় নেই, অন্যদিকে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড তখন শুকনা জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। তাদের যুক্তি হলো, নদী যদি আবার এখানে আসে তখন সেটি কাজে লাগবে। বিষয়টা হলো, ভাঙন রোধে নদীকে আগে বুঝতে হবে। তারপর সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পুরো প্রক্রিয়াতেই পরিবর্তন আনতে হবে।
সমকালঃ ফারাক্কার কারণে দেশে নদীভাঙন কতটা প্রভাবিত হচ্ছে। তিস্তা বাঁধসহ অন্যান্য বাঁধও কি নদীভাঙনের কারণের সঙ্গে যুক্ত?
মমিনুল হক সরকারঃ নদী ভাঙনের সঙ্গে যদি ফারাক্কার কোন প্রভাব থেকেও থাকে তবে তা খুব দৃশ্যমান নয়। বিভিন্ন স্থাপনার কারণে নদীর পানিপ্রবাহ পরিবর্তন হচ্ছে। আর পানিপ্রবাহ পরিবর্তন হলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হবেই। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে এটা হয় না। তাই শুষ্ক মৌসুমে নদী বেশি ভাঙেও না। নদীপ্রবাহে বড় পরিবর্তন আসে বর্ষাকালে।
সমকালঃ আপনি বললেন নদীপ্রবাহ পরিবর্তনের কারণে ভাঙন দেখা দেয়। আর কোন কারণ রয়েছে কি?
মমিনুল হক সরকারঃ দুটি কারণে আমাদের এখানে নদী ভাঙে। কিছু জায়গা যেমন, ময়নামতি, সিলেটের পাহাড়, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল বাদে দেশের ডেলটা এরিয়ায় যে পলি আমরা দেখি তা কয়েকশ’ থেকে কয়েক হাজার বছর আগের। আর মাটি শক্ত হওয়ার জন্য ১০ হাজার বছরই যথেষ্ট, যদিও তা নির্ভর করে মাটির গঠনের ওপর। মাটি যদি কর্দমাক্ত হয় এবং তার মধ্যে কিছু ক্যালসিয়াম কার্বোনেট থাকে তাহলে ওই মাটি আঠালো হয়। ভাঙনে এ ধরনের মাটি ক্ষতগ্রস্ত হয় কম। গবেষণায় জানা গেছে, গঙ্গা ও পদ্মায় কোথায় কোথায় এ ধরনের কর্দমাক্ত মাটি আছে। কর্দমাক্ত মাটি নদীর গতিপথও নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে বালুকা বা পলিকণা যেখানে থাকে সেখানে নদীভাঙন বেশি হয়। গবেষণার মাধ্যমে ওইসব জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে।
আসলে নদীর গতিপথ নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া দরকার। তবে গত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে যেভাবে নদী ভেঙেছে, এখন তা আড়াই ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। আগে নদী ভাঙন রোধ যতটা কঠিন ছিল এখন ততটা না। এনিয়ে সরকারের দীর্ঘস্থায়ী অনেক পরিকল্পনাও আছে। নদীকে কিভাবে আরও বেশি কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে, পরিকল্পনা চলছে। নদীর গতিপথ বুঝে পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই তা কাজে লাগবে।
নোট: সাক্ষাৎকারটির গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রকাশ করা হলো- সম্পাদক।