আমি নদী ভালোবাসি। নদী নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরকে আমি সম্মান করি। কারণ, সত্যিকার অর্থেই এটি একটি মহৎ কাজ। নদী হলো ধরণীর প্রাণ প্রবাহ।
মানুষের দেহের শিরায়-উপশিরায় রক্ত কণিকা যেমনটি প্রবাহিত হয়ে থাকে তেমনি নদীও ধরণীর দেহে সজিবতা বইয়ে দেয়। নদী বেঁচে থাকলেই মাটি সতেজ থাকে। তা না হলে মাটি শুস্ক ও মরুভূমিতে পরিণত হয়। নদীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই যারা নদীর নাব্যতা চায়, সুরক্ষার জন্য কাজ করেন তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা স্বাভাবিকভাবেই উৎসারিত হয়।
আমি নদীকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা কেন জানি স্বতস্ফুর্ত এবং কোনো স্বার্থের সংকীর্ণতার কাছে দায়বদ্ধ নয়। এই ভালোবাসা নিখাঁদ ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। নদী বাঁচলে মানুষও সুস্থভাবে বাঁচে, এটা সত্য। তবে আমি নদীকে ভালোবাসী এর বাইরেও অন্য একটি কারণে। কিশোরগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এক সময়ের স্রোতস্বিনী নরসুন্দার লাগোয়া মহল্লায় আমার জন্ম। শৈশব, কৈশর ও যুব বয়সে নরসুন্দাকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি।
শুধু দেখেছি বললে ভুল হবে। আমি প্রাণ ভরে উপভোগ করেছি নরসুন্দাকে সেই সময়। নরসুন্দার প্রবাহমান জলধারার ছল ছল কল কল রব আজো আমার হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। মানষপটে জ্বল জ্বল করে ভাসে এর অপরূপ সৌন্দর্য। হয়তো এটাও আমার নদীকে ভালোবাসার কারণ হতে পারে। আমার না হয় এটিই ভালোবাসার কারণ। আমার প্রশ্ন, নদীকে ভালোবাসেন না এমন কেউ কী রয়েছেন? আনেকেই বলে থাকেন, যে গান ভালোবাসে না, সে খুন করতে পারে। আমার তো মনে হয় নদীকে যে বাঙালি ভালোবাসে না সেও অবলীলায় খুন করতে পারে।
আমি প্রথমেই উল্লেখ করেছি, নদী নিয়ে কাজ হলো একটি মহৎ কর্ম। এও ঠিক, জীবনের প্রয়োজনেই আমাদের নদীর জন্য কাজ করা উচিত। নদীকে সচল রাখা গেলে ধরণীও সচল-সতেজ থাকে। এই পৃথিবী মানুষের বসবাসের জন্য। তাই একে বাসোপযোগী রাখাও আমাদের কর্তব্য। সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্য ও মনের সহায়ক। একে সুরক্ষা দেয়া গেলে জীবন অনেক প্রফুল্ল হয়ে উঠে। প্রকৃতির সৌন্দর্য, নদী, বৃক্ষরাজি, আলো-বাতাস মানুষের জীবনে অতি প্রয়োজীয় অনুসঙ্গ। এর কোনো কিছুতে ব্যত্যয় ঘটলেই বিপত্তি। আমাদের স্বাভাবিক জীবনে এত যে বিপত্তির সম্মুখিন আমরা হচ্ছি এর অন্যতম কারণ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ।
শুধুমাত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে আমরা যত প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করছি ততই আমরা জীবনকে বিপদগ্রস্থ করে তুলছি। এই সত্যটা যতক্ষণ না আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো ততক্ষণ আমাদের স্বস্থি নেই এবং শান্তি হবে সুদূর পরাহত। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণা থেকে আরো প্রমাণিত হয়েছে যে, নদীসহ প্রকৃতির অবাদ ধ্বংসের কারণে মানুষের মস্তিষ্কে এর বিরোপ প্রভাব পড়ছে। মানুষের জীবনী শক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অনেকের মাথায় বিকৃতি দেখা দিয়েছে। আবার অনেকের মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে। কারো কারো মাঝে আত্মহত্যার প্রবনতা লক্ষকরা যাচ্ছে। এটি নিশ্চই আমাদের জন্য উদ্বেগের। এথেকে বাঁচার জন্য আমাদের অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ হচ্ছে নদীমাতৃক দেশ। নদীকে ঘিরে আমাদের জীবন-জীবিকা আবর্তিত। নদীর কাছে আমরা বহুভাবে ঋণি। প্রবাহমান নদী ভূমিকে সতেজ রাখে ও সজিব করে তুলে। ফসলের জন্য নদীর পানি সেচ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি তুলে সেচ দিতে হচ্ছে। ফলে পানির স্থর ক্রমেই আরো গভীরে চলে যাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে নলকূপ দিয়েও পানি উঠানো সহজ হচ্ছে না। অথচ নদীকে সচল রাখা গেলে এসব বিপত্তি মানুষকে মোকাবেলা করতে হতো না। যে নদী মানুষের এত উপকারি আসুন আমরা তার এই ঋণ শোধ করি। এটা আমরা করতে পারি সামান্য উদ্যোগ নিলেই। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি নদীর কোনো ক্ষতি করবো না। নদীতে কোনো বর্জ্য আমরা ফেলবো না। অন্যকেও এ ব্যাপারে সতর্ক করতে সচেষ্ট হবো। নদী যদি কেউ দখল করে, আমরা এর প্রতিবাদ করবো। আমরা সকলে মিলে যদি এই শর্তগুলি মেনে চলি, তাহলে নদীকে রক্ষা করা অসম্ভব কিছু নয়।
পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবো রিভার বাংলার নাম
একবার ভাবুন তো, আপনার পাশের নদীটি যদি নাব্য হয়। এতে যদি কোনো আবর্জনা না থাকে, পানি যদি স্বচ্ছ হয়, কতই না সুন্দর ও মনোরম দেখাবে। আর যদি নদীতে নৌকা চলে এবং সহজেই এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা গুলোতে নৌকায় যাতায়াত করতে পারি- নিশ্চয়ই আমাদের ভালো লাগবে। নদীপথে যাতায়াতে কোনো জট থাকবে না। থাকবে না কোনো দুর্ঘটনার ভয়। ধুলাবালুহীন নির্মল বায়ুতে আমরা যাতায়াত করতে পারবো। যাদের নদী নেই তারা লেক তৈরি করেন বিনোদন ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য। আমাদের নদী আছে, আমরা নদীর উন্নয়ন করে প্রয়োজনে সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করবো। নদীকে মেরে ফেলা আধুনিকতা নয়। আসুন আমরা সবাই নদীকে ভালোবাসি।
আগেও বলেছি, আবার বলছি, নদীর জন্য যারা কাজ করেন তারা মহৎ কাজটিই করেন। আমাদের দেশে এখন অনেকেই নদীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। এর জন্যে সংগঠন হয়েছে, সমাবেশ হচ্ছে। আবার অনেকেই লেখালেখি করছেন। প্রকাশিত হচ্ছে পুস্তক, প্রচারপত্র এবং বের করা হচ্ছে পত্রিকা। সবই হচ্ছে, নদীর গুরুত্বকে অনুধাবন করে এবং নদীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই। আমরা তাদের এসব কাজের জন্য সাধুবাদ জানাই। আসুন আমরা তাদেরকে উৎসাহিত করি এবং সময়ে সময়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও লেখক, কিশোরগঞ্জ।