।। সুস্মিতা চক্রবর্তী ।। মহানদী। ছত্রিশগড়ের মালভূমি থেকে নেমে এসে জগৎসিংহপুরের বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত যেতে যেতে ভারতবর্ষের মাটির সাথে বেঁধে নেয় তার ভাঙা গড়ার খেলা, যেমন নেয় সব নদীই তার নিজভূমের সাথে। নদীর নিজভূমটি ঠিক কে? সে কি মানচিত্রে দাগ টেনে দেওয়া আঁকাবাঁকা এক ভৌগোলিক জরিপের সীমানা? নাকি বয়ে যাওয়া এক গতিময় অতল? যে অতল উৎস থেকে পাড়ি দেয় মোহনা আর একইসাথে নিজেও হয়ে ওঠে অজস্র আখ্যান, লোককথা, লোকাচার, ইতিহাস, পুরাণের, বৃক্ষলতাগুল্ম, কীটপতঙ্গ, অরণ্যজীবন আর মানুষের এক মহা সংগম, এক মহা মিলনস্থল। নদীর এই দ্বিতীয় রূপটিই অনিতা অগ্নিহোত্রীর, ‘মহানদী’ উপন্যাসের উপজীব্য।এই গ্রন্থের বারোটি পর্বে তিনি এঁকেছেন এক জলের গল্প যা শুনতে শুধু নদীই নয় যেতে হয় নদীর দুধারে জেগে থাকা এমনকি মুছে যাওয়া জনপদের মানুষ আর তাদের ঘিরে থাকা ভুবনের কাছে। তাঁর নিজের কথাতেই, ‘ প্রায় দু দশকের মত সময় একটি নদীকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি…’ স্বভাবতই সেই আখ্যান যখন গড়ে ওঠে, তখন তার আভাস কিছু বাঁধা শব্দে তুলে ধরার যোগ্যতা আমার মত সাধারণ পাঠকের থাকে না। শুধু বইটি শেষ করে এইটুকুই উপলব্ধি হয় যে বিশেষজ্ঞ এবং পন্ডিতের কাছে নদীকে জানার উপায় আছে অনেক। আমার মত সাধারণ পাঠক তাকিয়ে থাকেন এমন একটি আলেখ্যের দিকেই যা জলের মত সহজ স্বচ্ছ বয়ে যায়। সে জলে ভাসে আর ডোবে নামহীন জীবনের উপাখ্যান। সেখানে যেমন আসে, শাল, বিজা, সাজা, হলুদ, আমলকী গাছেরা, আসে বাসা হারা অজস্র শিয়াল, ডাক হরিণ, লঙ্গুর, ভালুক, হায়না, কুমির ভোঁদড়; তেমনই আসে কুঠেরপালি, নুয়াবলন্ডার দুই সই হিমিরানি আর মালতীর কথাও, হীরাকুঁদ বাঁধের বিরাট যজ্ঞ পর্বে যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাকিজন্মের মতো।
যেসব নদীর সাথে আমাদের হয়ত দেখা হয় না কোন দিন, বা দেখা হলেও নদী বলে ঠিক চিনে নিতে পারি না যাদের তেমনই অজস্র জলধারা সীতানদীর মতো, পিয়ারি, শিওনারায়ণ, জঙ্কের মতো বয়ে যায় এ বইয়ের প্রথম আখ্যান জুড়ে। প্রথম পর্বের নাম বৈদ্যরাজ।পাঠকের পরিচয় ঘটে নদীর কূলে জীবন্ত কিংবা পরিত্যক্ত অজস্র মন্দির, প্রাচীন ভাস্কর্য আর প্রাসাদের সাথে। যে বিচ্ছিন্নতা -অভ্যস্ত দৃষ্টিতে আমরা পাহাড়ে বেড়াতে যাই বা সাগরে, সেই দৃষ্টিকে এ বই ভেঙে দেয়। মহানদীর কাছে যেতে গিয়ে আসলে আমরা যাই ভারতবর্ষের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত নিজস্ব সম্পদের কাছে। তা নিওলিথিক যুগের বসতির চিহ্ন থেকে, রামায়ণ, মহাভারতের স্মৃতি সাক্ষ্য হয়ে আজকের ‘ উন্নয়ন’ চর্চিত পরিবেশ লাঞ্ছিত কাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ বই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা নদী, পাহাড়, অরণ্যের কাছে আলাদা আলাদা করে যেতে পারি না কখনোই, আমরা যাই পথের কাছে। মহানদী একটি পথরেখা মাত্র। সে একা নয়। বৈদ্যরাজের মতো যারা চেনে সীতানদীর অভয়ারণ্য হাতের তালুর মতো, জানে শতাবরী, সর্পগন্ধা, কেকরাসিঙ্গী, জটামাংসীর মতো অজস্র গাছগাছড়ার ভেষজগুণ সেই অরণ্যসন্তানদের জীবনকে নিবিড় ভাবে জড়িয়েই বয়ে যায় নদী।
বৈদ্যরাজ, মহুল সই, ‘ বেকার, দরিদ্র, ভূমিহীন অথচ শিক্ষিত এক কথাকার ও কবি’ সুবল, গন্ডারাম মাঝি, সুবর্ণপুর আর বরগড়ের তাঁতশিল্পীদের সাথে কাহিনী বয়ে চলে পর্ব থেকে পর্বে। ‘ঘরে ঘরে কেমন করে জন্মায় জাতশিল্পী বুনাকার? ’ কেমনকরেই বা তাঁতের নকশার স্বপ্ন উঠে আসে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে কাঠি কাঠি, ক্ষুধাক্লিষ্ট ডুবন্ত পায়ের থেকে সেই আখ্যান পড়তে পড়তেই আমরা পৌঁছে যাই পঞ্চমপর্ব, প্রত্নবিষাদ এ। বুদ্ধ ভগবান সেখানে বুঢ়ারাজা। যা ইতিহাস নয় যা ‘ লৌকিক বিশ্বাসের সিঁদুর চন্দন’ এই বই তাকেও তুলে আনে সমান মমতায়। দেখি কীভাবে অজস্র গ্রাম্য দেবদেবীর উত্থানের গল্পে জড়িয়ে যায় ইতিহাসের বিবর্তন। আর তাদের ঘিরে উঠে আসে ঝন্টানুয়া বা শিমের নবান্ন, কান্দুলের নবান্নের মত লোক উৎসবের কথাও। সেই উঠোনেই এসে দাঁড়ায় কন্ধমালের নাগাবুঢ়া, সুনাকানিয়া,উকুরাড়ু, চম্পাঘরণ এমন সব কখনো ইসকুলের বইতে ঠাঁই না পাওয়া পাহাড়ের দল।
সম্পদ আর ঐশ্বর্যের পিছু পিছুই আসে অনিবার্য লোভের আগ্রাসনও। নিয়মগিরি পাহাড়ের আদিবাসী দের লড়াই, শুকিয়ে আসা তেল নদী, বাঁধের নীচে বলিপ্রদত্ত জীবন আর জীবিকা আঁকা হয়ে যায় মহানদীর উপাখ্যানে। কাহিনী পৌঁছায়, নির্জন, গভীরে, তার ষষ্ঠ পর্বে।
পড়তে পড়তে মাঝেমাঝে মনে হয়ই যে এক একটি স্বতন্ত্র আখ্যানই দাবী রাখে একটি পরিপূর্ণ উপন্যাস হয়ে উঠবার।বুঝতে পারি বুকের মধ্যে দু দশক ধরে একটি নদীকে বয়ে বেড়াবার মর্মার্থ কী হতে পারে। মনে পড়ে যায় ভূমিকায় লেখা লেখকের কথাগুলি, ” আরো অন্যভাবে কি লেখা হতে পারত ‘ মহানদী’ উপন্যাস- আরো বৃহৎ, আরো বিস্তৃত? কি জানি!… যে বিপুল রহস্য, প্রজন্মবাহিত বেদনা, বঞ্চনার উচ্চারণ, প্রত্ন ব্যঞ্জনা ধারণ করার কথা ছিল এই উপন্যাসের তা কি পূর্ণতা পেল শেষ পর্যন্ত?…’ পূর্ণতা কাকে বলে জানা নেই এই সাধারণ পাঠকের। নীলমাধব, অববাহিকা, টানি ও ভরণি,ময়নাতদন্ত,মোহানা, বাতিঘর যথাক্রমে এ বইয়ের সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ পর্ব শেষে শুধু এই কথাই মনে হয় আবার, ‘হায়, জীবন এত ছোট কেনে? এ ভুবনে?’… কখনো কি দেখা হবে তীর্থের প্রান্তে সে মোহনা? মহানদী, আমার দেশ ভারতবর্ষের আধারে উস্কে দেয় সকল জলধারা আর তাদের জড়িয়ে থাকা অরণ্য, প্রত্নরহস্য, জীববৈচিত্র্য, প্রান্তিক মানুষকে জানার ইচ্ছে। সেইসব জলধারার আলাদা আলাদা কোনো দেশ নেই। তারা এই ভুবনের।
সুস্মিতা চক্রবর্তী : গল্পকার, পশিচমবঙ্গ।
।। রিভার বাংলা-য় প্রকাশিত কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি ।।
পড়তে পারেন সুস্মিতা চক্রবর্তীর আরও লেখা
লাবণ্যবতী একটি স্রোতের নাম ।। সুস্মিতা চক্রবর্তী
আমার নদী…তুই ডাকলেই সাড়া দেয় যারা ।। সুস্মিতা চক্রবর্তী