অঞ্জনা-নদী-তীরে চন্দনী গাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল-ধরা – এক কোণে
তারি
কুঞ্জবিহারী।
আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি
দূর,
আছে এক লেজ কাটা ভক্ত
কুকুর।
এটাই তো সত্যি। মানুষের তৈরি মন্দির পোড়ো মন্দিরে পরিণত হয়।পোড়ো মন্দির বিগ্রহের জন্য নয় তা অন্ধ নিকুঞ্জবিহারীর আশ্রয়। সঙ্গী লেজ কাটা ভক্ত। এতো গেলো মানুষের তৈরি ভাঙা-গড়ার চক্র। কিন্ত প্রকৃতির সৃষ্টি নদী কে মানুষ কি ভাবে নদী থেকে খাল -খাল থেকে -শহরের বর্জ্য বয়ে নিয়ে চলা নর্দমা তে পরিণত করতে পারে? তা দেখতে পেলাম কৃষ্ণনগরে।
সমৃদ্ধশালী শহর কৃষ্ণনগর । তাঁদের শহর দ্বিজেন্দ্রলালের শহর। যিনি কবি গুরুর সমালোচনা করতে পারতেন। শুধু কি তাই রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র থেকে গোপাল ভাঁড় থেকে ফেলুদা তাও তো কৃষ্ণ নগরের সরবরাহ। মাটির পুতুল থেকে সরভাজা। শহরের এ বলে আমায় দেখো ও বলে আমায় দেখো। মুশকিলটা শুরু হলো শুধু অঞ্জনা নদীর খোঁজ নিতে। সে তো আছে কিন্তু কোথায় জানা নেই। টোটো চালক বন্ধু থেকে কলেজের অধ্যাপক সাথী, কারো কাছে খবর নেই কোথায় সেই জল ধারা। এই নদীর নাম শোনেনি, পড়েনি এমন বাঙালি ‘ভূ’ বিশ্বে নেই বলে আমাদের ধারণা। কিন্তু তাঁর খবর নেই শহরবাসীর কাছে।
পনেরশো শতকে জলঙ্গী আপন খেয়ালে ভাগীরথী সঙ্গে মেলার আঙ্খায় তীব্র বেগে নতুন পথ খুঁজে নিয়েছিল অঞ্জনা নাম নিয়ে। আকাবাকা পথে প্রায় ৬০ কিমি পারি দিয়েছে। প্রকৃতি এই ভাবে বারবার জীবনলীলা চালিয়েছে। প্রকৃতির নিয়ম চক্রে মানুষ সহ জীবকূল তাদের জীবন প্রবাহে বয়ে চলেছে। বাধ সাধল মানুষ যখন থেকে ভাবলো ‘আমি’ ভাল থাকাই জীবন ।আর সেই ভাবনা যখন শক্তিশালী রাজা ভাবেন তখন আরো বিপদ। বাইরের থেকে আসা যবনদের সঙ্গে যুদ্ধের পর কৃষ্ণনগরের রাজা রুদ্র রায় নদীর উৎস আটকালো। পরে আরেক রাজা খুলে দিল না তার জল পাবার মুখ। তবুও নদী চললো আপন প্রাণদায়িনি আশীর্বাদ ঢেলে। জমিদারি কাজে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঞ্জনা কে দেখলেন মুগ্ধ হয়ে কবিতায় স্থান দিলেন।
আঠেরো শতকের শেষ দিকে নদীকে বশ মানাতে বাংলা জুড়ে চললো আরেক আক্রমণ। আমার শহর, আমার জমিদারি,নীল সাহেবের কুঠি, বাঁচাতে নদীর পাড় বাঁধানোর নটরাজ নৃত্য। প্লাবন ভূমি থেকে নদী বিচ্ছিন্ন হল। জমিদার বা নীল কুঠি সাহেবের অত্যাচার দেশের সম্পদ বিদেশে লুঠ এর খবর সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, বুদ্ধি দিয়ে যাঁদের পেট চলে তারা লিখলেন আমাদের জানালেন অনেক। কিন্তু “পাড় বাঁধের শৃঙ্খল আসলে ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থকে বন্দক” রাখার তেজারতি ব্যবসা তা বুঝতে সময় লাগলো অনেক দিন। বললেন সতীশচন্দ্র মজুমদার ১৯৪২ সালে। কিন্ত এই কথা বলার পরেও এত বছর হয়ে গেল আমরা কি তা জানতে, বুঝতে পারলাম না এখনো। কৃষ্ণনগর শহর বাঁচাতে ১৮৮০ সালে তৈরি হওয়া পাড় বাঁধ অঞ্জনার উৎস মুখকে জলঙ্গী থেকে বিছিন্ন করলো তার খবর (গবেষণা) হলো কি? তাই আজ যখন শহরে জল বাড়ে তখন পাম্প চালিয়ে জলকে বাঁধের ওপার পাঠাতে হয় এই তো উন্নয়ন। ২০০০ সালের বন্যায় রাজ্য জুড়ে নদীর তান্ডবের পর নিকাশী ব্যবস্থার পরিকল্পনা অনেক হলো।কৃষ্ণনগর শহরের নিকাশী সহ জীববৈচিত্রের আধার হতে পারতো এই নদী। কিন্তু তা হল কোথায়? নদীয়া তথা বাংলা জুড়ে সম্প্রতি “নদী বাঁচাও আন্দোলন ” নামক সামাজিক সক্রিয়তা গড়ে উঠছে তখন প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ইতিহাস কে ইতিহাসের মতন করেই বোঝার সময় এসেছে।তথ্য সূত্র : মুদ্রা, জলঙ্গী সংখ্যা।
তিস্তা পাড়ে মানববন্ধন, চার দফা দাবি
নদী রক্ষা আন্দোলন কর্মী, কলকাতা, ভারত।