প্রথম নদী চিনিয়েছিল আমায় সহজপাঠ। সে নদী ছিল আমারই দোসর যেন। কুল, করমচা, বাঁশঝাড়ে দৌড়ে বেড়ানো শিশুকালের মতোই সে চেনা চৌহদ্দির ছোট নদী। তাকে চেনে গাঁয়ের হাট, পাড়ার ঘাট। আমারই মত, তার দুনিয়াখানাও বুঝি দিব্যি এঁটে যায় একখানা পুতুলের বাক্সের মাপে। তার হাঁটুজলের পৃথিবীটিতে সে এঁকে দিতে দিতে চলে আঁকিবুঁকি খুশি।
তারপর সহজপাঠ ফুরিয়ে আসে একদিন। আমার মফস্বলের বড় হতে থাকা দিনগুলোয় নদী ছিল না কোন। কালেভদ্রে যাওয়া হত খানিক দূরের দক্ষিণেশ্বরে। সেখানে যে জলধারা আমার কাছে সে ছিল নিতান্তই ভূগোলের দাপুটে নদী। তার বুকে ভেসে যায় পুজোর মানত, পুণ্য লোভীর ডুব, শহরের পাপ। ঘোলাটে সেই ছপছপ, তাকে বেঁধেছে প্রয়োজন পারাপারের ফেরি, ব্যাবসাবাণিজ্যের আড়ত, সভ্যতার সংকট মেটাবার দায়। সে আমার মত এইটুকু তুচ্ছ মানুষের নদী হবে কেমন করে! তাকে কি বলা যায় কক্ষনো আপনার, সে তো এই বিরাট দেশের ভার বইছে, সে রাজনীতি আর ভূগোলের ভাগের পানি। নিজস্ব বলে আদৌ হয় কি কোন নদী? যাকে বলা যায় আমার? সব নদীই তো মোহনার, যেমন সমস্ত দিনই শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার।
মুঠোর মধ্যে ধরা যায় না যাকে, মনের মধ্যে তারই চলে নিত্য চলাচল, আমায় তেমন নদী চেনালেন প্রথম আমার ঠাকুর্দা। তিনিই চেনালেন প্রথম, নদী মানে স্টিমারের বাঁশি, গোয়ালন্দ ঘাট আর প্রবাসের মেসবাড়ি থেকে ঘরে ফেরার ডাক।বাঁধের কাছে, কাঁটাতারের কাছে ধরা দেয় শরীর আর স্মৃতির কাছে মন। আমার দাদুর কাছে ছিল নদীটির মন। তার অনেক নাম, কখনো পদ্মা কখনো মেঘনা।
ধীরেধীরে বুঝি আসলে তারা সবাই এক বুকভরা জল। রাজনীতি নিয়েছিল তাদের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ভূগোলের নিখুঁত নিশান, দাদু ওই মন। সব স্রোত মিলেমিশে যেখানে একাকার নোয়াখালী, বরিশাল, সেখানে মিঠে পানি নোনা হত স্মৃতির ইশারায়, পড়ার টেবলের পাশে দাদুর গল্পে রোজ রোজ দেখি কেমন মিলেমিশে যায় নদী আর ফেলে আসা দেশ। একটু একটু করে বুঝি, ঘরেই থাকে না ঠিক যে, দাবী জানাবার নেই যার উপর কোন রাষ্ট্রীয় অধিকার, কেমন করে সেও হতে পারে একান্ত নিজস্ব, নির্জনের আপনার, সেই নদীকেই তো বলা যায় আমার।
নদী খুঁজতে খুঁজতে তেমন এক, বাড়ে আমার পথের বয়েস।এ দেশের মুখের উপর ঝুঁকে আঁকিবুঁকি কাটে নদী। রেল জানলার এক ঝলকে, ঝমঝমে পেরিয়ে যাওয়া ব্রীজের নীচে হরবখত দেখা হয় তাদের সাথে। শহরের আশপাশে ঘুপচি গলির কিংবা সড়কের মাঝে জড়োসড়ো, সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যেসব ক্লান্ত মলিন জলধারা, তাদের নদী বলতে ইচ্ছে হয় না আমার কক্ষনো। অঝোর না হলে নদী জন্মায় নাকি, মুক্ত উল্লাস ছাড়া তাকে মানায়? তাই একঝলকের পথের নদী কুড়াই আর খুঁজে ফিরি সেই জলধারা, আমার নদী বলে ডাকব যাকে একদিন। বর্ষা এলে দেখি ভেসে যাওয়া মাঠঘাট জুড়ে জন্মায় অজস্র নদী, তারা সব দোয়েলের, ফিঙের, ঘাস ফড়িং এর। দেখি আর ভাবি মানুষের জন্যে এমন নদী জন্মায় না কক্ষনো?
বছর দুয়েক আগে। মিজোরাম বেড়াতে গিয়েছি। চলেছি আইজল শহর থেকে চম্পাই জেলা, চম্পাই থেকে যাব আরো নির্জনের আঙুর খেতের দেশ নাহলান( Hnahlan), সেখান থেকে আনারস কমলালেবু চা বাগানের মধ্যে দিয়ে আবার থেনজাওয়াল প্রদেশ। চলেছি আর মাঝেমাঝেই দেখছি মেঘ, রোদ্দুর ঝরছে সোনাঝুরির মতো, সেই পাকদন্ডীর সাথে সাথে চলেছে আশ্চর্য কিছু নাম। তুইরিনি, তুইপুং, তুইভাওয়াল, তুইচ্যাং…তারা সব ছটফটে পাহাড়িয়া নদীদের নাম। ড্রাইভার মণিদাকে শুধাই, সব নামের গোড়াতেই তুই কেন? মণিদা জানায়, মিজো ভাষায় জলের সাথে তাদের তুই তোকারির আত্মীয়তা। মিজো ভাষায় তুই মানে জল।এখানে তুই ডাকলে নদী সাড়া দেয়।
তুই ডাকলে নদী সাড়া দেয়! গাড়ি থেমে যায় একটি ডাকের কাছে। ব্রীজের উপর থেকে দেখি আকাশ নিয়ে খেলতে খেলতে ভেসে যাচ্ছে সব স্বাধীন পাহাড়িয়া জলধারা।একচিলতে রাজ্যটার একুশটি নদী।তার মধ্যে পনেরোটি প্রধান। লম্বাটে আকারের ভূখন্ড মিজোরামের। তার দৈর্ঘ্য বরাবর প্রায় সমান্তরালে এদের চলন। রাজ্যের আয়তনের সাথেই মানানসই তাদের বহর।
তুইরিনির ( Tuirini) দৈর্ঘ্য মোটে ৬০ কিলোমিটার। তুইপুই( Tuipui) মোটামুটি ৮৭ কিমি। তুইচ্যাং ( Tuichang) আর তুইরিয়াল ( Tuirial) অপেক্ষাকৃত দীর্ঘতর। যথাক্রমে, ১২০ আর ১১৭ কিমির আশেপাশে। মধ্যভাগের পাহাড়ে জন্মে নিজস্ব সহজপাঠের গাঁ ঘর, নিবিড় অরণ্যের মধ্যে দিয়ে এরা বয়ে গেছে বরাক নদীর কাছে। সেখানে নিজের ক্ষুদ্র পরিচয়, নাম সব ভাসিয়ে দিয়ে তারা হয়ে উঠেছে বরাক নদীর অখন্ড আত্মা। একটি একটি করে কাঁটাতারের সীমানা গন্ডি পেরোতে থাকলে ক্রমেই যেমন মুছে যায় আমাদেরও দেশ, জাতি, ধর্মের ছোট ছোট নিশানা। বিরাট মহাবিশ্ব চিনে নেয় আমাদের একটাই নামে, এই নীল গ্রহের বাসিন্দা বলে, ঠিক তেমনই। ছোট নদী বড় হলে জল মুছে দেয় তার খন্ড পরিচয়, ক্ষুদ্র অহং।
নিরালার নিজস্ব নদীদের যতবার দেখেছি মিজোরামে, মনে পড়ে গেছে প্রিয় লেখক রাস্কিন বন্ডের কথা, তাঁর ‘Rain in the Mountain’ সিরিজের সেই ছোট্ট পাহাড়িয়া জলধারাটির কথা, কয়েক ফোঁটা থেকে জন্মে যে ছুটে যায় আরো আরো বন্ধুবান্ধবের স্রোতে মিশে, ভারতবর্ষের হৃদয়ের স্পর্শ পাবে বলে গঙ্গার ধারায়, তারপর একদিন অকূল দরিয়ায়। Bond সেখানে তাঁর অনুনকরণীয় শব্দে তুলে আনেন বিন্দু আর সিন্ধুর প্রকৃত স্বরূপ, কবিতার মত গদ্যে মীমাংসা করে দেন কে বড় কে ছোট এই চিরকেলে তর্কটার…” And the ocean, what was it but another droplet in the universe, in the greater scheme of things? No greater than the glistening drop of water that helped start it all, where the grass grows greener around my little spring on the mountain. ” দুদিনের পথিক কুড়িয়ে নিই বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু সেই পরশটুকু মনপেতে।
মে থেকে সেপ্টেম্বরের প্রবল অঢেল বর্ষায় জন্মেছে এই নদীরা। প্রাচুর্য ছড়াতে ছড়াতেই তারা চলেছে, সেই উচ্ছ্বাসে দু পারের অরণ্য নিখাদ সবুজ। মানুষ নিশ্চয়ই আছে তবু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে জনবিরল এইসব পাহাড়িয়া পথের নদীদের ধারে, মনে হয় যেন কেউ কোত্থাও নেই। ঈশ্বর একাই তাকিয়ে আছেন তাঁর নদীটির দিকে। সেই মুগ্ধ বিস্ময় লেগে আছে ঝলমলে উপচানো রোদ্দুরের গায়ে, চিলের ডানার সহজ ভেসে থাকায়, অজস্র সবুজের নিস্তব্ধতায়।তুই বলে ডাকলে সাড়া দেয়, যার দিকে অপলক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন নির্জনের ঈশ্বর তাকেই তো বলা যায় আমার। কুড়িয়ে নিই পথের প্রান্ত থেকে আমার নদীটি, বরাক নদীর ঠিকানায় বয়ে যায় তার শরীর, মন আমার।
ঘরে ফিরে আসি। মনে বাজে তুইরিনি, তুইপুং, তুইরিয়াল। আমার ঠাকুর্দা এনেছিলেন তাঁর নিজস্ব নদী। এতকাল পেরিয়ে আমি। আমার এই শহরের কোন নদী নেই, আছে বাঁধের ফাঁসে আটকানো নদীদের শব। জ্যান্ত ছটফটে দুরন্ত কিছু জলধারা বয়ে যায় নির্জনে আমার ভিতর। তুই ডাকলেই সাড়া দেয়। চোখের সামনেই মূর্তি গড়ে না শুধু, মুঠোয় দেয় না ধরা, যেমন আমার আপন ঈশ্বর তেমনি, ঠিক তেমনি তারা, তারা আপনবেগে পাগলপারা…দাবী জানাব না কক্ষনো তবু আমি জানি চোখ বুজলেই তারা আমার।উৎস থেকে মোহনা তাদের, আমারই কুড়িয়ে আনা।