জীবন-নদী চলছে আঁকেবাঁকে,
প্রতিটি বাঁকেই যেন কোনো গল্প লুকিয়ে থাকে।
নদী-গল্প শোনাবো তোমায় আজ
জীবন স্রোতের সর্পিলাকার পথে-
হ্যাঁ ঠিকই আজকের বিষয় আমার প্রিয় নদী। আসলে এই প্ৰিয় শব্দটির মধ্যে অদ্ভুত একটা আন্তরিকতা লুকিয়ে থাকে তাই বিষয় যখন প্রিয় নদী সেক্ষেত্রে যার স্রোতের আঁচলে-শাসনের দৃঢ়তায় ছোট থেকে বড় হয়েছি সেই নদীর থেকে প্রিয় আর কেই বা হতে পারে? ঠিক ধরেছেন আমি আমার শহর গঙ্গারামপুর এর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী পূর্ণভবার কথাই বলছি। আমার জন্ম এই জেলাতেই, নদীর প্রতিটা বাঁক, গভীরতা, প্রতিটা রূপ আমার জানা।বাড়ি থেকে নদীর দূরত্ব খুব জোর ১০০ মিটার হবে, বাড়ির ছাদে উঠলেই নদী দেখা যায়।
কিন্তু এই চেনা নদীর সাথে আমার আত্মীয়তা উপলব্ধি করি আমার পাশের জেলা মালদাতে। ২০১০ সাল, শিক্ষকতা পেশায় সবে পা দিয়েছি মালদা জেলার আইহো উচ্চ বিদ্যালয়ে। সাথে তখন নতুন শখ ছবি তোলার। ছুটিরদিনগুলিতে মাঝে মাঝেই বেড়িয়ে পড়তাম সহকর্মীদের সাথে এদিক ওদিক ছবি তুলতে। এমনি একদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম আইহো থেকে একটু দুরে অজানা এক গ্রামে। আমার সহকর্মী আমায় এক নদীর সামনে নিয়ে গিয়ে বললো- ‘এই নদীটা চেনো? এটা তোমাদের পুনর্ভবা নদী।’
আমি কিছু উত্তর না দিয়ে অবাক চোখে দেখছিলাম আমার পরিচিত নদীটিকে। চোখে বাচ্চাদের মতো কৌতূহল। অদ্ভূত এক আত্মীয়তা অনুভব করলাম সেদিন, মনে হলো কাছের কোনো বন্ধুকে অজানা কোনো দূর দেশে হটাৎ খুঁজে পেলাম। আমার শৈশবকাল, বড়ো হবার গল্পগুলি ভেসে ভেসে যাচ্ছিল নদীর জলে। একটু নিচে নেমে জল ছুঁয়ে নদীকে বললাম ‘এই নদী!আমায় চিনতে পারছো তুমি?’
গল্পগুলো ভেসে যাচ্ছিল- বাবার হাত ধরে নদী তীর ধরে কুয়াশা মাখানো সকালে হেঁটে যাওয়া, বর্ষার দুপুরে বরশি নিয়ে ট্যাংরা, পুটি, বাইম মাছ ধরা, বিকেলে বন্ধুদের সাথে নদী তীরে আড্ডা সব ফুটে উঠছিল নদীর জলে। এই নদীর সাথে আমার যে বহুদিনের আত্মীয়তা তা সেদিন টের পেয়েছিলাম সেই অজানা গ্রামটিতে। ফেরার পথে আমার সহকর্মী -ভূগোল বিষয়ক শিক্ষকের কাছ থেকেই শুনেছিলাম আমার প্রিয় নদীর ইতিহাস।পুনর্ভবা বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটির বর্তমান উৎসস্থল দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার শিবরামপুর ইউনিয়ন বিলাঞ্চল। পতিত হয়েছে মহানন্দা নদীতে।
কয়েক বছর পর আমার ট্রান্সফার হয় আমার শহরেই। মজার বিষয় বিদ্যালয়টি ঠিক নদীর ওপারে অবস্থিত ছিল। সেখানে পড়াতে যেতাম নদী পার হয়ে। গ্রীষ্মকালে সাঁকো পার হয়ে, আবার বর্ষায় নৌকাতে। আমার ব্যক্তিজীবন ও কর্ম জীবনেও যে আমার এই প্রিয়নদী একটা যোগসূত্র রচনা করছে সেটা উপলব্ধি করছিলাম। নদীর প্রতি আমার আনুগত্য ক্রমশ বেড়েই চলছিল। এখানে এসে ছবি তোলার সখ আরও পেয়ে বসল। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্যামেরা হাতে বেড়িয়ে পড়তাম নদীর চরে ।কতো রকমের পাখি। পরিযায়ীরাও আসে এই সময়। কিন্তু সব স্মৃতি সুখকর হয় না। নদী গর্ভে নেমে দেখি আমাদের বাড়িগুলোর আবর্জনায় নদীতীর ভর্তি।পাখিগুলো অসহায়। প্লাস্টিক, কাচের বোতলের ওপর ওরা ওদের ছানাগুলোকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই লড়ছে। আর আমার নদী-মা অসহায় ভাবে তাকিয়ে দেখছে কিভাবে মানুষ অবহেলা ছুড়ে দিচ্ছে তার মুখে।
নীরবে প্রশ্ন করলো নদী আমায়- ‘বলতে পারিস এই অবহেলা আর কতদিন? কোনো উত্তর দিতে পড়লাম না। দুরে একটা গঙ্গা ঠাকুরের কাঠামো পড়েছিল। অনুভব করলাম নদীকে ভালবাসি ঠিকই, কিন্তু গুরুত্ব বুঝতে পারিনা। তাই এই অবহেলা।
বর্তমানে পোস্ট-কোভিড পৃথিবীতে মানুষ যখন বেশ কিছু সময় প্রকৃতি ধ্বংস থেকে বিরত থেকেছে অনান্য নদীর মতই আমার নদীটিও একটু প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সময়ের আগেই এইবার জল এসেছে, স্রোত ও আছে, জেলে ভাইরা বলেছে এইবার ভালো মাছও হবে। এখন বিদ্যালয় বন্ধ। আমার চার বছরের ছোট্ট ছেলে। তার হাত ধরে প্রতিদিন আমার প্রিয় নদীর কাছে যাই। ওদের বন্ধুত্ব করাতে।ওকে বলি -‘দেখ বাবা! নদীর প্রাণ চঞ্চলতা দেখ, গভীরতা অনুভব কর, পড়ন্ত বিকেলের জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া সূর্য কিরণের খেলা দেখ!’
ও এতো কিছু বোঝে না, শুধু আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে জলে ভেসে যাওয়া কচুরিপানার ওপর কয়েকটা হলদে রঙের ফড়িং এর খেলা দেখে। রক্তাভ সূর্য কিরণ নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে ওর মুখে মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। আমার মনে হয় প্রকৃতি ওকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ দিয়ে বলছে, ‘অনুরণন! তুমি অনেক বড় হবে। বলতে পারেন এর থেকে প্রিয় কি হতে পারে?
রাজর্ষি চৌধুরী : শিক্ষক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।