নরসুন্দা নদীর উৎপত্তিস্থল হচ্ছে হোসেনপুরে। নরসুন্দা সেই হোসেনপুরে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে পূর্ব দিকে বয়ে কিশোরগঞ্জের বুক চিরে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মাকরসার জালের মত ছড়িয়ে গেছে। এটি কিশোরগঞ্জ শহরের বুকচিরে প্রবাহিত হয়ে পূবে করিমগঞ্জ হয়ে হাওরের ধনুতে মিশেছে। অ্যদিকে কিশোরগঞ্জ শহর হয়ে যশোদল হয়ে ও ভৈরবের দিকে চলে গেছে। এছাড়াও তাড়াইল, কটিয়াদিসহ জেলার অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। বলা যায় নরসুন্দা কিশোরগঞ্জকেই প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তাই নরসুন্দার সঙ্গে এখানকার জনসাধারণের রয়েছে এক প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাসের অনুভূতি।
নরসুন্দা নদীর নামকরণ নিয়েও এখানকার মানুষের মধ্যে প্রবল আাবেগ কাজ করে। জনৈক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের গৃহপরিচারিকা ‘সুন্দা’ র নামানুসারে এর নাম হয়েছে বলে কিংবদন্তি রয়েছে। সুন্দা একদিন ব্রহ্মপুত্রে ডুব দিয়ে আর ওঠেনি। মনে করা হয়ে থাকে স্বর্গ থেকে সুন্দার নরলোকে আগমন হেতু ‘সুন্দা’র সঙ্গে ‘নর’ যুক্ত হয়ে এ নদীর নাম হয়েছে।
নরসুন্দার সঙ্গে আমার প্রাণের সম্পর্ক। নদীটির উত্তর পাশে প্রায় লাগোয়া আমাদের জন্মভিটা। বাল্যকালে বন্ধুদের নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই নদীতে সাঁতার কাটতাম। বর্ষায় নদী যখন কানায় কানায় ভরে উঠতো তখন গৌরাঙ্গবাজার গেনাদাসুন্দরী ব্রিজের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ার প্রতিযোগিতা হতো বন্ধুদের নিয়ে। আর শীতে জেগে ওঠা বালুচরে দৌড়াদৌড়ির সঙ্গে মার্বেল খেলা ও ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দও কম করিনি। গেনাদাসুন্দরী ব্রিজটি পাকা ছিল না। এর দু’পাশ ছিল লোহার রেলিং ও এর পাটাতন ছিল কাঠের তৈরি। সে অনেকদিন আগের কথা। ব্রিজের উত্তর পাশেই ছিল একটি কদম বৃক্ষ। কদম ফুলের মৌ মৌ গন্ধ ভালোই লাগতো। নরসুন্দা নদীটির স্রােত আখড়াবাজার ব্রিজের দিক থেকে পূবে সোজাসুজি এসে ডান দিকে বাঁক খেয়ে গেনাদাসুন্দরী ব্রিজের নিচে দিয়ে পুরানথানার দিকে প্রবাহিত হতো। এখন আর নদীতে পানিও নেই স্রােতও নেই।
শীতের মৌসুমে গেনাদাসুন্দরী ব্রীজের পূবে পুরান থানার পশ্চিমে নদীতে চর পড়তো। নদীর উত্তর পাশটায় অধিকাংশ এলাকাজুড়ে বালুচর দেখা যেত। সেই বালুচরে আমরা বন্ধুরা মারবেল খেলতাম। সে কী দুরন্তপনা। আবার কখনো কখনো ঘুড়ি উড়াতাম। ছেলেবেলার সেই স্বর্ণালি দিনগুলো আজো বেশ মনে পড়ে।
তবে প্রায় সারা বছরই নদী নাব্য থাকতো। কখনো নদী পানিশূণ্য ছিলো না। বছর জুড়েই নদীপথে কিশোরগঞ্জ শহর থেকে জেলার সর্বত্র যাতায়াত করা সম্ভব ছিলো। বর্ষায় নদীর রূপ বদলে য়েত। ভরা যৌবনা এক অপরূপ রূপে নরসুন্দা আমাদের কাছে ধরা দিত। সেসময় বর্ষা আর বৃষ্টি মিলে নদী অপরূপ হয়ে ওঠতো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলে বাঙালির মন উতলা হয়ে ওঠে। অনেকের মনের অলিন্দে গানের সুর উঁকি দেয়। বৃষ্টির সাথে বর্ষার চিরায়ত সম্পর্কের কথাও আমরা জানি। বাঙালির কাছে বৃষ্টি আর বর্ষার সখ্য চিরাকালীন। মনে পরে ওই সময়গুলোর কথা। আমাদের মন উতলা হয়ে ওঠতো। বৃষ্টির সময় নদীতে ঝাপিয়ে পড়তাম। এ যে কী আনন্দ শুধু অনুভব করা যায়, বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। নরস্ন্দুা পাড়ের মানুষ আমি। আমার হৃদয়জুড়ে জড়িয়ে রয়েছে আমার প্রিয় নদী নরসুন্দা। বর্ষায় থৈথৈ পানি, স্রােতের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এখনো কানে বাজে। শীতে নরসুন্দার ক্ষীণ হয়ে যাওয়া এবং জেগে ওঠা বালুচর আমাকে এখনো টানে। ফিরে যাই সেই শৈশব ও কৈশরের ফেলে আসা দুরন্ত, স্বপ্নময় দিনগুলোতে। এখন নদীর এই হতশ্রী অবস্থা দেখে হৃদয়ে হাহাকার উঠে।
নরসুন্দার প্রাণ ফিরে পেতে এখানকার মানুষ বহুবার সংগ্রাম করেছে। একসময় পৌরমেয়র আবু তাহেরের নেতৃত্বে ‘নরসুন্দা বাঁচাও’ ব্যানারে আন্দোলন হয়েছে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অসীম সরকার বাঁধনসহ সাংস্কৃতিক কর্মীরা মানববন্ধন ও মিছিল করেছে। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য গঠিত ‘পরম’ এর উদ্যোগে অধ্যাপক শরীফ সাদীর নেতৃত্বে তুমুল সংগ্রাম করা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষক, ছাত্র, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, ডাক্তার ও আইনজীবীসহ সর্বস্থরের মানুষ নরসুন্দার সুরক্ষার জন্য পথে নেমেছেন। কারণ নরসুন্দা এখানকার মানুষের স্পন্দন ও ভালোবাসা। এই অঞ্চলের মানুষ এখনো এর প্রাণ ফিরে পেতে চায়।
একরামপুর রেলব্রিজের পূবে হাওরের মানুষ বজরা নিয়ে এখানে এসে নোঙর ফেলতো। দুইপাড়ে দেখা যেত বহু রঙ-রেঙের ছোটবড় নৌকা। এরা নানা কাজে কিশোরগঞ্জ শহরে আসতেন। কেনাকাটা এবং বেড়াবার উদ্দেশ্যেও অনেকেই আসতেন। তবে কোনো পার্বন এলে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যেত। ঝুলনের সময় প্রচুর মানুষ শহরে আসতেন।
রেলব্রিজের দুই পাশেই নদীতে প্রচুর পানি ছিল। এখানে জেলেদের মাছ ধরার খড়া দেখা যেত। জেলেরা খড়ায় মাছ ধরতেন। এই মাছ ধরে তারা সংসার চালাতেন। এখানে একাধিক জেলেদের খড়া দেখা যেত। এখন আর এসব নেই। পানি নেই তাই খড়াও নেই। হাওরের মানুষ এখন নদীপথে যাতায়াত করেন না। একসময় নীলগঞ্জের ফুলেশ্বরী, তাড়াইলের সুতি ও বেতইর নদীতেও পানি ছিল। ফুলেশ্বরী নদীর সাথে বাংলার আদি কবি চন্দ্রাবতীর নামটিও জড়িয়ে রয়েছে। সেই নদীর এখন কোন অস্থিত্ব নেই। এখন বেতইর ও সুতি নদীও বিলীন হতে চলেছে। নৌকার পরিবর্তে এখন প্রায় সর্বত্র সড়কপথ নির্মীত হয়েছে। এখন সড়কে যন্ত্রযান চলাচল করে। মানুষ ও মালামাল সড়কেই পরিবহন করা হয়। নদীর বদলে বিকল্প ব্যবস্থা।
ওই সময় একরামপুর ব্রীজের নিচেও প্রচুর নৌকা নৌকা নোঙর করতো।এদিকে পুরান থানা বাজার থেকে নরসুন্দার যে বাঁকটি মণিপুরিঘাট হয়ে উথারিয়া বিলে মিশেছে এর মধ্যে মণিপুরিঘাট পর্য্ন্ত অংশটি কাটাখাল নামে পরিচিত ছিল।
কাটাখাল অংশটি পরে খননকৃত। এ প্রসঙ্গে একটি সূত্রের দাবি, তৎকালীন প্রামাণিক বাড়ির নন্দ কিশোর প্রামাণিক তাঁর অমর কীর্তি একুশ রত্ন ভবনের উদ্বোধন ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময় যে মহাসমারোহের আয়োজন করেছিলেন, তার জন্যে দূর-দূরান্তের অতিথিদের আগমনের সুবিধার্থে এ খালটি তিনি খনন করেছিলেন।
ভিন্ন একটি মতও রয়েছে। সেটি নিম্নরূপ, জঙ্গলবাড়ি ও জাফ্রাবাদের জমিদারদের নৌবহরের প্রধান ঘাটি ও রাজস্ব আদায়ের প্রধান কার্যালয় ছিল এটি। জলপথে ধুলদিয়ার সঙ্গে সহজ কোন পথ না থাকায় ওই দেওয়ানরাই তাদের সুবিধার্থে পুরানথানা বাঁক থেকে মণিপুরি ঘাট পর্যন্ত নরসুন্দার এ খনন কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন।
মাত্র একশতক সময়ের মধ্যে উৎসকে আমরা নিজেরাই ধ্বংস করেছি। আমরা আর কখনো কী নরসুন্দা হয়ে ব্রহ্মপুত্রে যেতে পারবো? নদী পথে করিমগঞ্জ হয়ে চামড়া বন্দর, তাড়াইল বাজার অথবা হাওরের বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা আর কখনো কী যেতে পারবো? যেমনটি যেতেন আমাদের পূবর্-পুরুষরা।
আরো একটা গল্প আমরা শুনি, একদিন এই নরসুন্দা নদী পথেই বারভূইয়া প্রধান বীর ঈসা খাঁর বজরা বীর দর্পে জঙ্গলবাড়ি দূর্গে যাতায়াত করেতেন। ঈসা খাঁ’র দ্বিতীয় রাজধানী ছিল করিমগঞ্জের এই জঙ্গলবাড়ি। ইতিহাস হচ্ছে, ষোড়শ শতকে ঈসা খাঁ লক্ষন হাজোর রাজধানী জঙ্গলবাড়ি আক্রমণ করে দখল করেন। তারপর তিনি এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণ, দুর্গের সংস্কার সাধন, তিনদিকে পরিখা খনন এবং নরসুন্দার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে দুর্গটিকে একটি গোলাকার দ্বীপের আকার দেন। তখন থেকেই জঙ্গলবাড়ি হয়ে ওঠে জাঁকজমকপূর্ণ ও জমজমাট নগর। নরসুন্দার মত আজ এ ঐতিহাসিক স্থানটিও চরম অবহেলার শিকার।
মু আ লতিফ : আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও লেখক, কিশোরগঞ্জ।
আরো পড়তে পারেন…
স্মৃতিকথা : আমার সখা নরসুন্দা : মু আ লতিফ (দ্বিতীয় পর্ব)
আমার সখা নরসুন্দা : মু আ লতিফ
আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও লেখক, কিশোরগঞ্জ।