নিজের দেশ, জন্মভূমি বিশেষত: ফেলে-আসা সময় নিয়ে আলী আকবরের কোন বাড়তি আবেগ নাই। অন্ত:ত দীর্ঘকালের প্রবাস জীবনে নিজের সাথে সে যে একটা রফা করতে পেরেছে অর্থ্যাৎ আর সব প্রবাসীর মত রুটিন মাফিক স্মৃতিচারণা আর দেশপ্রেমের মড়া কান্নায় যে সে শামিল হয়নি এ-নিয়ে প্রচ্ছন্ন একটা গর্বও আছে তার।
কিন্তু এই বার এই মফস্বল শহরটিতে তার জন্মভিটায় এসে সে যেন কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলে। আলী আকবর নিজেই নিজের কাছে একটু যেন লজ্জিত ও বিব্রতও বোধ করে অতীত স্মৃতিচারণায় তার কৌতুহল ও আগ্রহের বাড়াবাড়ি দেখে। অবশ্যি একদিক থেকে দেখলে এই বাড়াবাড়িটুকু তো হওয়ারই কথা। স্মৃতির শহর বলে কথা। এই শহর থেকে বিচ্ছিন্ন সে গত ১৮ বছর।বাপ-চাচাদের ঠেলা-ধাক্কায় কলেজ পেরিয়ে হায়ার এডুকেশনে প্রথমে ঢাকায়, তারপর সেখান থেকে মধ্য ইউরোপের পুরোপুরি উন্নত একটা দেশে। না উচ্চ শিক্ষার জন্য নয়,অত ভালো মাথা আলী আকবরের না। প্রথমে ট্যুরিস্ট হিসাবেই উড়াল দিয়েছিলো সে।
এটাও মায়ের জোরাজুরিতে ; মা চাইতেন না আকবর আর এই পঁচা টাউনে ফিরে আসুক। তো বিদেশের মাটিতে আকবরকে থিতু হতে গিয়ে লড়াই করতে হয়েছে অনেক -তাকে সেখানকার ভাষা শিখতে হয়েছে, কাজ যোগাড় করতে হয়েছে, জলবায়ুর সংগে খাপ খাওয়াতে হয়েছে। ভিন্ন গোলার্ধে সে এক অন্যজীবন,বলা যায় এখানকার পুরো বিপরীত। কয়েক বছর পর ওখানকার নাগরিক হয়ে গেলে একসময় দেশটাকে ভালোই লাগতে শুরু করেছে তার। আর সেটা দিব্যি সে বুঝতেও পারে কয়েক বছর পর পর দেশে আসে যখন। প্রথম কদিন খুব আবেগে – আহ্লাদে কাটে পুরনো বন্ধু বান্ধব, সহপাঠী, আত্মীয় পরিজনের সাথে। তারপরই খুব দ্রুত ফিকে হয়ে আসতে থাকে সবকিছু নানান সৃষ্টিছাড়া বিপরীত ধরণের চিত্রে, অভিজ্ঞতায়। ক্রমান্বয়ে বিস্বাদ লাগতে শুরু করে খাবার, সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যায়,নিছক কোলাহল মনে হয় কলহ। অতি প্রিয়জনকেও মনে হয় অপ্রিয়, অবাঞ্চিত। তখন সে ছটফট করতে থাকে পালাবে কখন, এমনকি ছুটি শেষ হবার আগেই ,রিটার্ণ টিকেটের মেয়াদ এগিয়ে এনে হলেও, ফের উড়াল দেয়। তাও আবার ঢাকা শহর থেকেই,একটেরে পড়ে-থাকা এই মফস্বলে আসবার সময় কোথায় তার ?
এবার অনেক দিন বাদে বার্থ-সার্টিফিকেটের একটা কপি পৌরসভা থেকে নিজে থেকে তুলবার গরজে আসতে হলো তাকে নিজের জন্ম শহরে। ইতোমধ্যে আলী আকবরের বাবা মা গত হয়েছেন। একমাত্র বোন স্বামী নিয়ে কানাডা প্রবাসী , তার দেশ ছাড়ার আগেই। এখানে বাপ-চাচাদের ভিটাবাড়িটা টিন ও কাঠে পুরনো দিনের কাঠামোয় এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ২/১ জন চাচাতো ভাই থাকে পরিবার পরিজন নিয়ে । সম্পত্তির বিলিবণ্টন হয়নি। থাকুক না পড়ে; কে আসবে ঝামেলা করতে! স্কুল-কলেজ জীবনের বন্ধুদের মধ্যে আকবর তার এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলীমকেই খুঁজে পেল। একই পাড়ায় এ-মাথায়,ও-মাথায় ওদের বসতি।
“কি রে তুই তো একেবারে বুড়া অইয়া গেছিস দোস্ত” আকবর বিস্ময়মিশ্রিত হাসি ছড়িয়ে বন্ধুর ঘাড়ে হাত রাখে। “আর তুই তো দেখি সেই রকমই আছিস , এক্কেবারে ফকফকা জোয়ান ”- বন্ধুকে জবাবটা ফিরিয়ে দিতে যেয়ে আলীমের গলায় কোন জড়তা কাজ করে না । বরং ঠুন করে কী একটা ছোটবেলার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে- যেন নিস্তব্ধ ডোবায় পানা সরে গিয়ে খানিকটা আকাশ বেরিয়ে পড়ল । কতদিন পর দেখা !
কলেজ শেষে হায়ার এডুকেশনে আকবর ঢাকায় পাড়ি জমালেও , আলীম ইন্টারমিডিয়েটে তৃতীয় বিভাগে পাশ দেওয়ার পর এখানেই কিছুদিন বিএ ক্লাশে দৌড়াদৌড়ি করেছিল। পরে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বড়বাজারে বাপ-দাদাদের ধান চালের গদিতে পাকাপাকিভাবে গিয়ে বসেছে। হাওড় এলাকায় ওদের ধান-চাল কেনা বেচার মোকাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
“২/১ দিন তো থাকবি , অনেক গল্প করবার আছে দোস্ত,সত্যি কতদিন পরে তোর সাথে দেখা —-দুপুরে খাবি আমার এখানেই ; চল একটা চক্কর লাগাই, দেখি কারে কারে পাওয়া যায়” – বলে আলী আকবরের পিঠে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে সামনে পা বাড়ায় আলীম।
পাড়াটাও বদলে গেছে কিংবা বলা যায় বদলে যাচ্ছে, আকবর হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করে। নজরুল ডাক্তারের বাড়ির ওদিকটায় যে বাঁশঝাড় নদীটা আড়াল করেছিলো,এখনও যেখানে হাওয়ায় কান পাতলে শেয়াল ডেকে উঠবে সেখানে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে উঠে দাঁড়িয়েছে ক’টি দোতালা বাড়ি। আবার পূবের দিকটায় পৌরসভার রাস্তা বাড়িয়ে ড্রেন বানাতে গিয়ে এক সার সুপারী গাছ কাটা পড়েছে- কতদিন ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় কাঁপতো সুপারীর পাতাগুলি ! বুকের ভিতর সুপারীর পাতার কাঁপন অনুভব করে আকবর। তবে এও ঠিক ড্রেন হওয়াতে জলাবদ্ধতার অপবাদ ঘুচেছে ওদের পাড়াটার। রাস্তা ঠিক হওয়াতে রেলস্টেশনে নেমে ট্রেনযাত্রীরা এখন এ-পাড়ার রাস্তাটাই ব্যবহার করতে পারছে ,আগে অনেকটা পথ ঘুরে গিয়ে মূল শহরে ঢুকতে হতো। অবশ্য ট্রেন যাত্রীদের চলাচলের সময়টুকু বাদ দিলে এখনো যে ফাঁকা আর নীরবই থাকে পাড়াটা- এ-টুকু আকবরের দৃষ্টি এড়ায় না ।
সেদিন আলীমের ওখানে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে রোদ একটু পড়লে ওরা বেরিয়েছিল। আকবরের ইচ্ছা ছিল পৌর গোরস্তানে বাবা মায়ের কবর জিয়ারত করে তারপর নদীর ধারে কোথাও নিরিবিলি গিয়ে একটু বসবে।যদিও নদীর ধারে বসবার বেশির ভাগ জায়গাই এখন উন্নয়ন কর্মীদের দখলে – ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে নদী জুড়ে। কোথাও চলছে পাড় বাঁধাইয়ের আয়োজন- ওয়াকওয়ে হবে। কংক্রিটের ঢালাই কাত হয়ে গড়িয়ে নামছে। বাতাসে উড়ছে ধূলি ও কংক্রীটের কণা। অনেক দূরে কোথাও মেশিন চলছে , এখানে এসে ধূলির সাথে মিশেছে সেই আওয়াজ। গোরস্তানের দিকে না গিয়ে আলীম বাঁ দিকের রাস্তা ধরে আকবরের আগে আগে হাঁটে।“আরে এই জায়গাটা তো এমন ছিল না ”- আকবর আচমকা দাঁড়িয়ে যায়,ফিসফিসিয়ে মাথা নাড়ে। আরে এইখানে নদীর ধার জুড়ে কাঁটাঝোপ ছিলো না ! আরো ছিলো বুনো গাছপালা,কচু-ঘেঁচু, কালো পানির একটা ধারা ! আর বর্ষায় ? বর্ষায় তো ওইখানে গলাপানি-কেবল হিজলের একটা মাঝবয়সী গাছকে দেখা যেতো মাথা জাগিয়ে রেখে নি:শ্বাস নিচ্ছে। এই শহরে থাকলেও আজকাল এদিকটায় তেমন একটা আসা হয় না আলীমের । ভালো করে দেখে পুরনো দিনের হোটেলটা খুঁজে নিতে অসুবিধা হলো না দুজনেরই। ওরা আসছিলো হোটেলের পেছন দিক থেকে। স্টেশন রোডেই আছে হোটেলটা, তবে আশেপাশে ফাঁকা যা ছিলো এখন নানারকম দোকানপাটে খুব ঠাসাঠাসি;উল্টোদিকে একটা কুরিয়ার কোম্পানীর অফিস বসেছে,পাশে একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার। লোকজনের হাঁকডাক,চিৎকার,হল্লা একেবারে ঠেসে ধরেছে পুরনো আমলের কালীবাড়ির চৌকাঠটা। কী নিরিবিলি ছিল এই রাস্তাটা,এখানে কোথাও একটা আশ্রমও ছিলো আকবর মনে করার চেষ্টা করে। তবে আকবর অনুমানে বুঝতে পারে নতুন নতুন অফিস আর দোকানপাট হওয়াতে হোটেল রেস্তোরাঁর ব্যবসাও বেড়েছে। এই যে মেনু মিয়ার হোটেল, আগে এটাই ছিল একমাত্র হোটেল,এখন আরো হোটেল হয়েছে। মেনু মিয়া নাই, তার ছেলে বসে। মেনু মিয়ার মতই মোটাসোটা, স্ফীতোদর, তবে বাপের তুলনায় ছেলে একটু যেন বেশি ফরসা। হঠাৎ মনে হবে শ্বেতী রোগে আক্রান্ত। বিকালের একটু আগে আগে মধ্যবয়সী দুজন খদ্দেরকে দোকানের সামনে উসখুস করতে দেখে ক্যাশকাউন্টারে বসেই হাঁক ছাড়ে সে। বাপের আমলের খদ্দের আকবর ও আলীমকে চিনে ফেলেছে সে। “আঙ্কেল,আসেন আসেন,চলে আসেন। কইরে বেনু,আঙ্কেলদের পিছনের কেবিনটায় নিয়া বহা । আমার বাপের দিনের কাস্টোমার,কেবিনটা মুইছা দে –যান গিয়া বহেন। ”
স্যাঁতস্যাঁতে একটা গলিমত, বাঁয়ে গুমোট রান্নাঘর পেরিয়ে পেছনের কেবিনটায় এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আকবর। লক্ষ্য করে, কেবিনটায়ও কিছু পরিবর্তন এসেছে। সম্ভবত রেঁস্তোরার রান্নাঘর বড় করতে গিয়ে ৩টে জানালা ছেড়ে দিতে হয়েছে। ফলে ডানে-বাঁয়ে খানিক চেপে এসেছে কেবিনটা। “আহা নদীর ওপরে কী খোলামেলা ছিলো এই কেবিনটা,–তোর কি মনে আছে ?” “বাহ মনে থাকবে না কেন, দিন রাত্তির ২৪ ঘন্টার ঠিকানাই তো ছিল এই কেবিনটা ”- আকবর সায় দেয়। দিনগুলি যেন একঝাঁক পায়রা,ছাড়া পেয়ে নিজের মধ্যেই গোত্তা খেয়ে মরচে-ধরা করোটিতে বাধা পেয়ে বারবার ফিরে আসে। আকবর যেন বহুদিন পর একটা লম্বা ঘুম শেষে জেগে উঠছে ! ভোর হয়েছে সেই কখন,অথচ দ্যাখো শীতের জাড় জেঁকে বসে থাকে বেলা ১১টা অবধি। ঘরের পেছন দিকে খোয়া বাঁধানো রাস্তা ধরে ক্যাঁচ ক্যাঁচর শব্দ তুলে আখ-বোঝাই গরুর গাড়ির সারি সুগার মিলের দিকে এগিয়ে যায়। বিছানা তখনো আঁকড়ে পড়ে থাকে আকবর। নিশ্চয়ই ছোট বোন এসে বার দুই ঘুরে গেছে ঘরটায়। কলেজেরশেষ পরীক্ষার পর ওর এখন শুয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কাজইবা কী! কাজ একটা আছে বটে,অই মেনু মিয়ার হোটেল কেবিনে গিয়ে গুলতানি মারা। “মা আইতাছি আমি ”- বলে কাউকে ফিরতি মন্তব্যের কোন সুযোগ না দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাসার গেট পেরিয়ে নিষ্ক্রান্ত হওয়া যায়। আর ওদিকে দ্যাখো ১১টার মধ্যেই মেনুমিয়ার হোটেলের কেবিন জমজমাট। নদীর একেবারে পাড় ঘেঁষে ,নিচের পানির সীমানা থেকেই কংক্রিটের কয়েকটি সরু পিলারের ওপর কেবিনটি রেখে হোটেলের মূল কাঠামোর সাথে জুড়ে দিয়েছিলো মেনু মিয়া, লোকটা সৌখিন ছিল বলতেই হয়। বিকালের সোনা রোদে ঝলমল নদী দেখবে মানুষ,গরম সিঙাড়া মুখে পুরবে , গরুর দুধের চা সেই সাথে। মেনু মিয়ার হাত ধরেই কলিজার পুর দেওয়া গরম সিঙাড়ার প্রবর্তন হয় এই শহরে।“কী খাবি, দোস্ত -” আলীমের প্রশ্নে আকবর যেন আধা বাস্তবে ফিরে আসে, নীরবে তাকিয়ে থাকে। চেপে-ধরা কেবিনটায় আলো একটু ঝাপসা। আকবর ফিরে তাকালেও ঠিক কাকে দেখছে বুঝতে পারে না আলীম। উত্তেেরর প্রত্যাশা না করেই সে গরম মোগলাই পরোটার অর্ডার দেয়। থাক, বন্ধুকে ভাববার সময় দেয় আলীম। প্রবাসী হয়েছে আকবর তাও তো বছর কুড়ি হলো, এর মধ্যে বার দুই এসেছে সে যদ্দুর মনে পড়ে আলীমের।
পুরনো বন্ধুদের মধ্যে যারা আলীমের মত থেকে গেছে এই মফস্বলে এবং এখনও বেঁচে আছে তাদের একত্রিত হওয়ার সুযোগ নাই ; বোধ হয় ইচ্ছাও হয় না তেমন একটা। বরাবর আকবরের সাথে আলীমের ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি ছিল,তাছাড়া অন্যদের আকবর এখন আর কতটা মনে রাখতে পেরেছে সে-ব্যাপারে সে নি:সংশয় নয় বলেই পাড়ার অপর প্রান্ত থেকে আলীমকে খুঁজে বের করেছে। তবে ভুলে থাকা কিংবা ফেলে যাওয়া যে সহজ নয় সে জন্ম ভিটার মাটিতে পা রেখেই বুঝেছিল। এই যেমন এখন কেবিনে দাঁড়িয়ে আকবর ভাবছে,কুয়াশা তখনো কাটেনি অথচ সকাল ১১টা বাজতে না বাজতেই সকলে এসে হাজির হতো কী করে! কেবিনের ৭/৮ টি চেয়ারে দখলের পর ভাগাভাগি চলছে।২টা তারা মার্কা সিগ্রেট হাতে হাতে ঘুরছে – এই হাত ওই হাত ঘুরে মিন্টু জ্বলন্ত সিগ্রেটে ২ টান দেবার পর আকবরের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এরা সবাই কলেজের চৌকাঠ মাড়াতে পারে নি ; আকবরের ধীরে ধীরে মনে পড়ে সেদিনের কিছু কিছু কথা ও ছবি । এই কেবিনে মোল্লা দিনে একবার হাজিরা দিত ,অতপর সারাদিন গার্লস স্কুলের উল্টাদিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো । আকবরের স্কুল টিচার বারিক স্যারের ছেলে মোল্লা, লেখাপড়ায় ভালোই ছিলো , কিন্তু কেন যে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলল ! ওর বাপ ওকে পিটিয়ে হোক,কান্নাকাটি করে হোক- কোনভাবেই আর লাইনে আনতে পারে নি । আজিজের ব্যাপারটা ছিলো আলাদা । কলেজে ১ বছর ক্লাশ করে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল না দিয়ে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলো । লাল এক ধরণের বই পড়ে পড়ে ওর মাথাটাই হয়ে গেছিলো যেন কেমন। খালি বলত্-ো“এই সমাজে কিছুই আর হবে না , মেহনতী মানুষের অধিকার কায়েম করতে হবে” ইত্যাদি । ওর বড় ভাই তখন সদ্য পৌরসভার কাউন্সিলর , বুড়ো বাপ-মার দোহাই দিয়ে কত বুঝিয়েছিলো ভাইকে ,আজিজ শোনেনি ।
“আচ্ছা আজিজের খবর কি ! ওরা কি নীলগঞ্জ রোডের বাড়িটায় আছে এখনো?-মোগলাই পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে আকবর জানতে চায়।
“ ওহ , আজিজ তো এখন পৌরসভার ক্লাশ ওয়ান কন্ট্রাকটর, বিয়ে শাদি করেছে, সে এখন পাক্কা মাওলানা একটা,তবলিগ জামাতে যায় নিয়মিত — তুই দেখলে এখন আর চিনতে পারবি না , তোকেও পারবে না । ”
হুমম ! আকবর পানি খেয়ে মুখ মুছে চায়ে একটা চুমুক দেয়। আলীম নিজ থেকেই স্বপন মল্লিকের খবরটা দেয়। স্বপন মল্লিক ছিলো তাদের আড্ডার সবচেয়ে তুখোড় স্বপ্নবাজ তরুণ। কালীবাড়ি মোড় থেকে আসত সে। রোদে বৃষ্টিতে কোথা থেকে টই টই করে ঘুরে এসে হাজির কেবিনের দরজায়। চা-সিঙাড়ায় ভাগ বসিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতেই বলতো, “আমার তাড়া আছে, দ্যাখ তো ২ টাকা হবে কিনা কারো পকেটে। ” পাখি,ফুল,বাগানে রমনীর কোলাহল ইত্যাদি বাদ দিয়ে কেন যে সে ক্ষুধার জ্বালা ইত্যাদি নিয়ে কবিতা লিখতো তার একটা জবাব বুঝি সবাই পেলো ট্রেনের তলায় স্বপনের কাটা লাশটি দেখে।
ভরা শ্রাবণের নদীতে কত পানি । তখনো আদি ব্রক্ষ্মপুত্রর গোড়ায় বাঁধ পড়েনি। পানি নিয়ে আসতো মাছ.পাখী,গুচ্ছের কচুরিপানা। ভরা বর্ষায় রেল ব্রীজ থেকে লম্বা ডাইভ দিয়ে একেবারে নদীর তলদেশে পৌঁছানো যেত। সেখানে কেবল আলো আর আলো। এমনকি মেনু মিয়ার এই কেবিন থেকে মাত্র ২ হাত নামালেই যে ছোঁয়া যেত পানি সে কথা আকবরের মনে পড়ে। এখন বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহ যে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে তা যে একটা মহাপরিকল্পনার অংশ সে আলীম ও আকবরসহ জীবিত বন্ধুরা যেমন দেখছে তেমনি মৃত বন্ধুরাও দেখে গেছে। শুকিয়ে-যাওয়া নদীটাকে নিয়ে এবার সকলে বসেছে । সকলের লক্ষ্য এই এলোমেলো নদীটার একটা বিহিত করা , একটা পরিকল্পিত নদী গড়ে তোলা। একটা ইচ্ছা নদী কি ? নদীর ধারে বসবে পার্ক,উন্মুক্ত মঞ্চ,ফুডকোর্ট,ওয়াচ টাওয়ার। ইতোমধ্যে নদীর দুই ধারের দোকানপাট,হোটেল-রেস্তোঁরার বাড়তি অংশ ভেংগে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এই ঝুলন্ত কেবিনটাও পড়ছে উচ্ছেদের আওতায়। “হ আমগোরেও নেটিশ দিয়া গেছে ভাইজান ”- মেনু মিয়ার আমলের পুরনো বেয়ারা কথায় কথায় জানান দেয়। এতদিনের স্মৃতিময় আড্ডার এই কেবিনটা উঠে যাবে শুনে খারাপই লাগে আলীম ও আকবরের। যুগপৎ ওরা যেন দেখতে পায় আবছায়ায় ওদের কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া শীতের নদীটি। ওড়ে-যাওয়া ধূলি,কংক্রীটের গুঁড়ো আর বোল্ডারের আওয়াজ যেনো থেমে গ্যাছে ক্ষণকালের জন্য। বিকালের রঙিন মেঘের ছায়া আবির হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ওদের করোটির নিস্তব্ধতায়। আবছায়ায় বয়ে যায় শীতের নদীটি।
“রনজন দা’র কথা মনে আছে তোর !”- আলীমের প্রশ্নে চমকে ফিরে তাকায় আকবর। কোন রঞ্জন দা’র কথা বলছিস ! ওহো আমাদের হারমোনিয়াম দাদা ? যেন রঞ্জন দা’র কথা এই ছোট্ট শহরের কারুর ভুলে যাওয়ার কোন উপায় নাই । কাছারিবাজারে চাউলমহলের লাগোয়া নদীর ধারে রঞ্জন দা -দের কয়েক পুরুষের বসতি। রাস্তার উপরে সামনের ঘরটায় একটা তবলা বাঁধাই-সারাইয়ের দোকান। রঞ্জন দা’র বাপ অবিনাশ কাকু বাঁয়া তবলাটা টাইট দিয়ে একেকবার চাঁটি মারছেন – সে-আওয়াজ রাস্তায় আমাদের সাথী হতো কলেজ পর্যন্ত রোজ; উভয়ের মনে পড়ে। মান্না দে’র গান খুব ভালো গাইতেন রঞ্জন দা। দেখা হলেই খোলা গলায় শুনিয়ে দিত : “ এ তো রাগ নয় গো,এ যে শুধু অভিমান।” আকবরের কানে এসে ধাক্কা মারে :“ও কেন তখন হঠাৎ এমন , ও কেন তখন হঠাৎ এমন খোলা চুলে বাইরে এলো।” সরু গোঁফের হালকা – পাতলা রসিক টাইপের রঞ্জন দা কে পাওয়া যেতো শহরের যে কোন ফাংশনে। শিল্পকলায়,পাড়ার বাৎসরিক বিচিত্রানুষ্ঠানে,কলেজের নবীন বরণে,একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে কোথায় নেই রঞ্জন কুমার ! মহল্লার প্রভাত ফেরি আর সন্ধ্যার বিচিত্রানুষ্ঠানের জন্য ৭ দিন আগে থেকেই অখিল মোক্তারের বৈঠকখানায় রিহার্সালে রঞ্জন দা হারমোনিয়াম নিয়ে হাজির। কৃষ্ঞকায় মুখাবয়বে তাম্বুলরঞ্জিত ঠোঁট দুটি নি:শব্দ হাসি মেলে প্রসারিত। পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে মহড়ায় অক্লান্ত স্বরে কোরাসে গাইছেন : “ ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়। ” বহুদিন প্রবাসী আকবরের স্মৃতিতে ভোরের রাস্তায় খালি পায়ে প্রভাত ফেরিতে শামিল মিছিলের দিনগুলি এসে হানা দেয় । একটা ভ্যানের ওপর বসে হারমোনিয়াম নিয়ে গাইছেন রঞ্জন দা আর তার দল। ভিন পাড়ার মাইকের আওয়াজও এসে পৌঁছেছে , শোনা যাচ্ছে : “শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি ”-মাইকের ত্রুটিতে বারবার বেজে চলছে একই লাইন। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে ভোরের শহর। পাড়া মহল্লা থেকে মিছিল এসে জড়ো হয় ; তাই দেখে কলেজের মাঠসংলগ্ন নদীর তীরে কুয়াশার ছাই রঙা চাদর ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় বছর-জুড়ে ঘুমিয়ে থাকা শহীদ মিনার। এই মিনার বেঁচে থাকে সন্ধ্যা অবধি । সন্ধ্যার বিচিত্রানুষ্ঠান পর্যন্ত চলে মিনারের দাপট ,মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে শোভা পায় শহীদ মিনার , রঞ্জন দা তাঁর শিল্পীবাহিনী নিয়ে গাইতে থাকেন : “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা ”। চর্চা ছেড়ে দিয়েছে বটে,তবু আকবরের কানে এসে ঝাপটা মারে বিচিত্রানুষ্ঠানের সন্ধ্যায় ওর নিজেরই গলায় আবৃত্তির জলদগম্ভীর আওয়াজ : “ বল বীর , চির উন্নত মম শির, শির নেহারি আমারি ”। রাত গভীর হলে নদীর দুই তীরের জনপদ নিয়ে শহরটি ঘুমিয়ে পড়ে ,এমনকি বাসি ফুলের ভারে বিরক্ত শহীদ মিনারটিও।
“তা রঞ্জন দার খবর কি ? বেঁচে আছে তো! ”
“বেঁচে থাকার জন্য কত কিছুই না করতে হয়েছে রঞ্জন দাকে ” আলীম একটা ফিরিস্তি দেয় । বাপ দাদার তবলা বাঁধাইয়ের ব্যবসার যে আর বাজার নাই সে কথা বাবাই তাকে বলেছিল। গানের মাস্টারি ধরলো রঞ্জন দা । এটা তার বাঁধা আয় । এছাড়াও ছিল কিছু মওসুমী কাজ -যেমন স্থানীয় ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসের হয়ে গ্রামে গ্রামে দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়ানোর ভাড়া খাটার কাজ। আবার কালীবাড়ির পূজা মন্ডপেও তার নিয়মিত ডাক পড়তো শ্যামা সংগীত গাইবার। ভালোই চলছিল সবকিছু ।
“দেখা করা যায় না একবার রঞ্জন দার সাথে ? ” আকবরকে এবার একটু অস্থির দেখায় এবং আলীমের প্রশান্ত ভাব ও কিছুটা ধীর লয়ে রঞ্জন উপাখ্যান বর্ননায় সে অস্বস্তি বোধ করে। রঞ্জন দার গল্প আরো খানিকটা এগিয়ে নেয় আলীম। “শোন তারপর — কী , না রঞ্জন দা একদিন হঠাৎ উধাও । নাই , নাই,নাই কোথাও নাই ; সাহাপাড়ার বিপুল সাহা গদিতে এসে আমার কাছে জানতে চাইল – আমি রঞ্জন বাবুর কোন খোঁজ জানি কি না। ওরা নাকি ওদের এক মাসতুতো বোন উর্মিলাকে খুঁজে পাচ্ছে না কাল সন্ধ্যা থেকে। রঞ্জন দার কাছে মেয়েটি গানের তালিম নিতো রোজ সন্ধ্যাবেলা। উর্মিলার বাপ বড়বাজারের সবচেয়ে বড় কাপড়-ব্যবসায়ী ,তার ঘুম হারাম-পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। সদর থেকে স্থানীয় থানাগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
“তারপর ?”-নিজের মধ্যকার কৌতুহল ও জানার ব্যাকুলতায় আকবর নিজেও অবাক হয়।
তারপর আর কী , নটে গাছটি মুড়ালো ? “না আছে আর একটু খানি — তোকে কি এক কাপ কফি দিতে বলবো- এই দোকানে কফি চালু হয়েছে। আলীম কফির অর্ডার দিয়ে গল্পের শেষটুকু নিয়ে আকবরের মুখোমুখি হয়। অসবর্ণ অই সম্পর্ক কোন পক্ষই যে মেনে নেবে না – এ-কথা স্থির জেনেই যে ওরা পালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ-কথা কবুল করলো সবাই। ক’দিন চা-স্টলে,রিকশা ও বাসস্ট্যান্ডে,রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে , রেজিস্ট্রি অপিসের বারান্দায়,পাড়া-মহল্লায় – এই যুগলের পালিয়ে যাওয়াই ছিলো আলোচনার বিষয়বস্তু। একদিকে সকলের চেনা মুখ রঞ্জন কর্মকার,অন্যদিকে একবারে অখ্যাত,ঘরকুনো,অদৃশ্য এক বালিকা। মানুষ নানা ভাবে নিজের মত করে বিনুনী তৈরি করেছে গল্পের । “অনেক দিন কাছারী বাজারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বাঁয়া তবলা সারাইয়ের দোকানটা বন্ধ পেয়েছি।” আলীম এবার গল্পের উপসংহারটুকু টানার চেষ্টা করে। তাকে ক্লান্ত দেখায়,তবে আকবরের কৌতুহল তাকে উজ্জীবিত রাখে। “তারপর একদিন একটা খবর পেয়ে আমি আর বিপুল গেলাম – কোন এক কাপড়ের পাইকার এসে সাহাবাবুদের গদিতে জানিয়েছে – ওরা নাকি নদীপথে গেছে সেদিন সন্ধ্যায় আনেকে দেখেছে তাদের। তো সেই পথ ধরে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে আমরাও গেলাম, যেতে যেতে মাইল পাঁচেক এগিয়ে নদীটা যেখানে বাঁক নিয়ে আবার ফুলেশ্বরী নামে চলতে শুরু করেছে সেখানে চন্দ্রাবতী নামে একটা গ্রাম,মাইজখাপন ইউনিয়ন । তোর জানা থাকবার কথা এই গ্রামে দ্বিজ বংশীদাসের বাড়ি ছিল , তার মেয়ে কবি চন্দ্রাবতী । চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের পুরানা প্রেমের গল্পও তোর জানা থাকবার কথা,মনে আছে কলেজে থাকতে আমরা পিকনিকে এসেছিলাম এখানে ! ফুলেশ্বরীতে তখনো অথৈ পানি। এই ফুলেশ্বরীতেই নাকি জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীকে না পেয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিল ; ২টি শিবমন্দির খাড়া আছে এখনো পুরানা আমলের। তা,রঞ্জন দার এক মেসো থাকে এই গ্রামেই; খবর ছিলো -ওরা নাকি পালিয়ে এসে এই মেসোর ওখানে উঠেছে। না,আমরা সেখানে গিয়েও কোন খোঁজ পেলাম না। রঞ্জন দার মেসোমশাই বলে একজনকে পাওয়া গেলো বটে, কিন্তু তিনি কিছু স্বীকারই করলেন না। নিঝঝুম গাঁয়ের পাশ দিয়ে ফুলেশ্বরীর একটা চিকন ধারা- ওটা আর তাড়াইল পেরিয়ে হাওড়ে গিয়ে মিশতে পেরেছিল কিনা কে বলবে। নাহ ওদের আর খোঁজ মেলে নি । আমরা ফিরে এসেছিলাম। ”
রাত হয়ে আসছিলো । লাগোয়া রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া ও তেলেভাজার ঘ্রান এসে নাকে ঝাপটা মারলে গল্প বলার কিংবা শোনার আগ্রহ বিদায় নেয়। ক্লান্ত কথক ও শ্রোতা পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নীরবতা অথবা অস্বস্তি আড়াল করতে গিয়ে আলীমই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় : “তুই কি কালই যাবি,সকালের ট্রেনে! টিকেট পাইছিস তো , আন্তনগরের ট্রেনের টিকেট বেবাক নাকি কালোবাজারে গেছে।”
“হ, কাল সকালের গাড়িতেই ! চল উঠি এবার ” – আকবর উঠে দাঁড়ায়।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও যেন কাজ হচ্ছে কোথাও কোথাও নদী জুড়ে । সর্বত্রই পানা কচুরি,বাড়িঘরের বর্জ্য,বাজারের জঞ্জাল -কোথাও শুকনো খটখটে,কোথাও সামান্য জল-এরই মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে কাজ চলছে । খানিকটা আলো কোথাও আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার । একটা পরিকল্পিত নদীর সন্ধানে খনন যন্ত্র এগিয়ে চলে -ওপরের মাটি নিচে যায়,নিচের মাটি উপরে আসে – পুরনো কথা চাপা পড়ে আবার নতুন গল্প তৈরি হয় । মাটি-চেরা আওয়াজ কখনো কাছে আসে,কখনো দূরে মিলিয়ে যায়। দুই বন্ধু পাশাপাশি হাঁটে।
কয়েক বছর পর। এক সন্ধ্যায় আকবর বসে আছে আমস্টারডামে, খালের ধারে। পুরো শহরটাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে একটা পরিকল্পিত নদী কিংবা খাল। ইউরোপের এই শহরটাকে একটু একটু করে জেনেছে আকবর । একটা শহর ,এমনকি কিভাবে গোটা দেশকে সমুদ্র পৃষ্ঠের নিচ থেকে কেবলমাত্র পানি আটকে রেখে এরা বাসোপযোগী করে নিয়েছে এই ইতিহাস শুনে শুনে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের দক্ষতার উপর যেমন একটা আস্থা তৈরি হয়েছে , তেমনি আবার অতীতের জন্য মোহ বিদায় নিয়ে সেখানে জীবনের পুরোটা জুড়ে পরিব্যাপ্ত হয়েছে বর্তমান। এতটাই বর্তমান যে এখন এমনকি ভালো করে ভবিষ্যতও দৃশ্যমান নয় আকবরের কাছে। এ এক আলাদা ধরণের শূন্যতা, আবার আলাদা ধরণের স্বস্তিও বুঝি – আকবর কখনো উপভোগ করে,কখনো উদযাপন করে। তবু আজ একটু নির্জনতা চাইছিল আকবর। দেশ থেকে আলীমের মৃত্যুর খবরটা আজ বিকালেই পেয়েছে সে। প্রযুক্তির কল্যানে যোগাযোগ অনেকটা সহজ হয়েছে এখন । খবরটা শোনার পর থেকেই একটু নিরিবিলি কোথাও বসতে চাইছিল সে। এদিক ওদিকে কয়েকটা চক্কর দিল সে। রেমব্র্যান্ট স্কয়ারে টই টই করছে মানুষ, ড্যাম স্কয়ারে ভীড় আরো বেশি- একটা সাড়ে ছ’ফিট লম্বা মুখোশপরা মানুষকে ঘিরে ধরেছে একদল আমুদে মানুষ। আর একটু এগিয়ে সেন্ট্রাল স্টেশনের ও দিকটায় ছেয়ে আছে মানুষে আর মানুষে। অনেকের হাতে চেনে-বাঁধা বিশাল সাইজের এক একটা কুকুর। ফুটপাতে এই মেঘলা সন্ধ্যাবেলায় চেপে ধরা শীতের সাথে লড়াই করবার রোখ নিয়ে ছাতার নিচে বসেছে আরো মানুষ। কিছু লোক গিয়ে ঢুকেছে অপেরায়। খ্রীস্টমাসের বর্ণোজ্বল আলোকমালায় সেজেছে খালপাড়ের নগরী – খালের পানিতে তার পরিকল্পিত প্রতিফলনে একটা জ্যামিতিক শোভা তৈরি হয়েছে । খালের একটা ধার বেছে নিয়ে বেঞ্চে বসে নি:সঙ্গ লাগে আকবরের। আলীমের মৃত্যুসংবাদের সূত্র ধরে অনেক দিন পর তাদের শহরে ফেলে-আসা নদীটির কথা মনে পড়ে আকবরের । সেই তাদের মফস্বলের নদীটি এমনি হয়তো কোন পরিকল্পিত খালে রূপ নিয়েছে । এমনি আলো ঝলমল বাড়িঘর,বাগান আর বিপনীবিতানে গমগম করছে মানুষ। কর্তাব্যক্তিরা “লেকসিটির” আইডিয়া তো এই ইউরোপের কোন শহর থেকেই নিয়েছে।
আজ আলীমের মৃত্যু সংবাদটা পাবার পর থেকে আকবর যেন তার পুরনো নদীটাকেই খুঁজছিল অস্থিরভাবে। কিছুই যেন তাকে বাধা দিতে পারে না,যে-অতীতের উপর সে কুলুপ এঁটে বসেছিলো গৌরবের একটা চোরা কুঠুরীতে তা যেন নদীর একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ব্রক্ষ্মপুত্রের বাঁধ ভেঙে যেন পানি চলে এসেছে। ক্ষণকালের জন্য হলেও । আর মেনু মিয়ার হোটেলের জলটুঙ্গিতে প্রথম যৌবনের দিনগুলি আরো টাটকা হয়ে যেন ফিরে আসে। ভিনদেশের মাটিতে সামনের খালটির দিকে তাকিয়ে থেকে আকবর তাদের মফস্বল শহরের হারানো নদীটিকে বয়ে যেতে দেখে উছল ধারায়।আকবর যেন অনুমানে এটুকু অন্ত:ত নিশ্চিত হতে চায়,সেদিন ওদের বুড়ো মেসো ঠিকই ওদেরকে লুকিয়ে রেখে মিথ্যা বলেছিল। ফুলেশ্বরীর ধারা ঠিক থাকলে রঞ্জন-উর্মিলা দক্ষিণগামী নৌকা বেয়ে কবেই মিশে গেছে হাওড় জনপদে -সেই সমুদ্রে আর কে কাকে খুঁজে পাবে ?
আমস্টারডামে এই সময় বাতাসে তীব্র শীষ তুলে হিমজর্জর বৃষ্টি নেমে আসে। বর্ষাতি কিংবা ব্যাগে রাখা ছাতা বের করার আগেই ভিজে যায় আকবর।