চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরীয়া। হালদা নদী নিয়ে ১৮ বছর ধরে গবেষণা করছেন। দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্রটিকে রক্ষা করতে সোচ্চার তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলেছেন হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। স্বাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
স্বাক্ষাৎকারটির গুরুত্ব বিবেচনা করে রিভার বাংলা ডট কমের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।- সম্পাদক রিভার বাংলা।
প্রথম আলো: হালদা নদী নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন আপনি। কেন, কখন বা কীভাবে এই গবেষণাকাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন?
মো. মনজুরুল কিবরীয়া: আমার জন্ম হালদাপাড়ের একটি ছোট্ট গ্রামে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এই নদীর সঙ্গে। সেই দিক থেকে একটা আবেগ তো ছিলই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। ২০০১ সালে এমফিল গবেষণার অংশ হিসেবে ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থার (ডিএফআইডি) একটি প্রকল্পে কাজ করার সময় হালদা নদীর সঙ্গে আমার একাডেমিক পরিচয় ঘটে। নবীন গবেষক হিসেবে তখন নদীটিকে নতুনভাবে চেনার সুযোগ হয়। নতুন একধরনের উপলব্ধির মুখোমুখি হই আমি।
প্রথম আলো: সেই উপলব্ধিটি কী রকম?
কিবরীয়া: প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্রে দেশের এক বড় সম্পদ হালদা নদী। কিন্তু মানুষের অজ্ঞানতা, দখল-দূষণ ও পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে নদীটি ধ্বংসের মুখোমুখি। দ্রুত যদি উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তাহলে এই নদীকে রক্ষা করা যাবে না। এর বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে।
প্রথম আলো: ঐতিহ্য মানে হালদা নদী থেকে ডিম আহরণের বিষয়টি?
কিবরীয়া: হ্যাঁ। হালদা হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে রুই, মৃগেল, কাতলা ও কালবাউশ প্রভৃতি কার্পজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করা হয়। এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই হালদার অনন্যতা। মাছের প্রজননক্ষেত্র অনেক আছে, কিন্তু কার্পজাতীয় মাছের ডিম আহরণের সুযোগ বিশ্বে আর কোথাও নেই। আমি গত ১৮ বছর দেশ-বিদেশে আন্তর্জাতিক সেমিনারে এ তথ্য গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছি। কোথাও কেউ এর বিরোধিতা করেনি বা অন্য কোথাও সে রকম নদী আছে বলে দাবি করেনি।
প্রথম আলো: স্থানীয় লোকজন বংশপরম্পরায় এখানকার ডিম আহরণ ও রেণু উৎপাদনের কাজে সম্পৃক্ত। তাঁদের এই আহরণ ও উৎপাদন পদ্ধতি কতটা বিজ্ঞানসম্মত?
কিবরীয়া: পদ্ধতিটি স্থানীয় লোকেরা আয়ত্ত করেছেন বংশপরম্পরায়। এতে ডিম নষ্ট হওয়ার হার বেশি। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা কিছু উন্নত পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন তাঁদের। এসব পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে ডিম নষ্ট হয় কম। কিন্তু পরে দেখা গেল ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে প্রথম দিকে কিছু ডিম নষ্ট হলেও আধুনিক পদ্ধতির চেয়ে মাছের উৎপাদন তাতে বেশি হয়। অর্থাৎ প্রাচীন পদ্ধতিটিই শেষ পর্যন্ত বেশি কার্যকর। অথচ একসময় মনে করা হতো, এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
প্রথম আলো: ২০১৮ সালে এসে হঠাৎ প্রচুর ডিম পাওয়া গেল…
কিবরীয়া: এটা বিস্ময়করভাবে মোড় ফেরার ঘটনা। দখল-দূষণের কারণে ডিম আহরণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছিল। ২০১৬ সালে ডিম আহরণের পরিমাণ যেখানে ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেখানে ২০১৮ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ হাজার ৬৮০ কেজি! এটা সত্যিই বিরাট আশা জাগানিয়া ঘটনা।
প্রথম আলো: এই পরিবর্তনের কারণ কী?
কিবরীয়া: ২০১৭ সালে প্রায় ১৮টি ডলফিন মারা গেছে হালদা নদীতে। এই দুঃখজনক ঘটনা একদিক থেকে ‘শাপে বর’ হয়েছে। ডলফিন মারা যাওয়ার ঘটনায় সরকার, প্রশাসন সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। এরপর সরকার পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মা মাছ শিকার, বালু তোলার ড্রেজার চলাচল ইত্যাদি বন্ধের জন্য পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু আনসার-ভিডিপি নিয়োগ করে তো এসব পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমরা হালদা নদী রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধি সবাইকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়েছি। পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এগিয়ে এল। আমাদের পরামর্শে স্থানীয় ৩০ জন লোককে সার্বক্ষণিক পাহারায় নিযুক্ত করা হলো। তাঁদের স্পিডবোট দেওয়া হলো। এই প্রহরীরা তিন মাসে এক লাখ মিটার জাল উদ্ধার করেছেন। ফলে মা মাছ নিরাপদ ছিল। সব মিলিয়ে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হওয়ায় ডিম আহরণের পরিমাণ বেড়ে যায়।
প্রথম আলো: জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান ৮০০ কোটি টাকা বলে দাবি করছেন আপনারা। এই তথ্যের ভিত্তি কী?
কিবরীয়া: হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হলে বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও দখল-দূষণ রোধ করার উদ্যোগ ত্বরান্বিত হবে।হালদার অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আমাদের এক ছাত্র গবেষণা করছেন। আমি বিস্তারিত হিসাবে না গিয়ে শুধু মাছের কথাই বলি, হালদা থেকে আহরিত ডিম থেকে যে রেণু উৎপাদিত হয়, সেই রেণু প্রতি কেজির দাম ১ লাখ টাকা। এরপর এই রেণু থেকে অঙ্গুলি পোনা উৎপন্ন হলে এর প্রতিটির দাম পড়ে ১০ টাকা। পূর্ণাঙ্গ মাছের বাজারমূল্য প্রতি কেজি মাত্র ১০০ টাকা হিসাব করে আমরা ৮০০ কোটি টাকার অঙ্কটা বের করেছি। শতকরা ৪০ ভাগ ডিম নষ্ট হবে, এমন একটা হিসাব ধরেই এটা করা হয়েছে। এই ৮০০ কোটি টাকার কথাটা আমরা বলেছিলাম ২০০৭ সালে। তখন প্রথম আলোতে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ব্যাপারটা সবার গোচরে আসে।
প্রথম আলো: আপনারা হালদাকে জাতীয় নদী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলেছেন। কেন?
কিবরীয়া: পৃথিবীর অনেক দেশেই জাতীয় নদী আছে। ভারতে গঙ্গাকে ও মিসরে নীল নদকে জাতীয় নদী এবং পাকিস্তানে সিন্ধু নদকে ‘কওমি দরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও জাতীয় নদী আছে। আমরা বলেছি, হালদাকে জাতীয় নদীর স্বীকৃতি দেওয়া হোক। জাতীয় নদী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার শর্ত কী, এটা যদি আমরা অন্যান্য দেশের উদাহরণ থেকে নিই, তাহলে দেখব, সাধারণত কোনো নদী যদি একটি দেশের অভ্যন্তরে উৎপন্ন হয়ে সে দেশেই প্রবাহিত হয় এবং ওই দেশের জাতীয় পরিচয় বহন করে, তবেই কেবল জাতীয় নদীর অভিধা সেটিকে দেওয়া যায়। এসব দিক বিবেচনা করলে আমাদের দেশের দুটি মাত্র নদী আমাদের নিজস্ব—হালদা ও শঙ্খ। অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিবেচনায় শঙ্খের তুলনায় হালদা এগিয়ে। তাই আমরা এমন দাবি করেছি।
প্রথম আলো: জাতীয় নদী ঘোষণা করা হলে অন্য নদীগুলো গুরুত্ব হারাবে কি না?
কিবরীয়া: জাতীয় নদীর স্বীকৃতি পেলে হালদার মর্যাদা বাড়বে, কিন্তু অন্য নদীগুলো গুরুত্ব হারাবে না। ভারতে ২০০৯ সালে গঙ্গাকে জাতীয় নদী ঘোষণার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে প্রধান করে এবং যেসব রাজ্যের ওপর দিয়ে গঙ্গা বয়ে গেছে, সেই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের সদস্য করে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য গঙ্গাকে রক্ষা করা। হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হলে বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও দখল-দূষণ রোধ করার উদ্যোগ ত্বরান্বিত হবে। তখন এই রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতিকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে বাকি নদীগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও সচেতন হবে সরকারি-বেসরকারি সব মহল। এভাবে একটি নদীবান্ধব প্রজন্ম তৈরি করতে হবে, যারা জানবে নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
প্রথম আলো: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি গড়ে তুলেছেন, এর উদ্দেশ্য কী?
কিবরীয়া: আমি যেমন দীর্ঘকাল হালদা নিয়ে গবেষণা করছি, তেমনি আমাদের ছাত্রছাত্রীরাও এ বিষয়ে আগ্রহী। বুয়েট, চুয়েট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসেন হালদা বিষয়ে জানতে, কাজ করতে। তাঁদের হাতে–কলমে দেখানো, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করতে অসুবিধায় পড়তাম। সরকারকে নানা বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার জন্যও একটি গবেষণাগারের প্রয়োজন ছিল। পিকেএসএফ ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) সহযোগিতায় এই গবেষণাগার গড়ে তুলেছি। এখানে ল্যাবরেটরি স্কুল, নদী জাদুঘর ও পূর্ণাঙ্গ আর্কাইভ আছে।