‘সারান্ডা’ সাতশো পাহাড়ের দেশ। সেই পাহাড়ের রূপ দেখে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি কাশ্মীর দেখতে চান না, কারণ লোকে বলে কাশ্মীরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মানুষ অন্য সব রূপ ভুলে যায়। তিনি সারান্ডা’র পাহাড়-জঙ্গলের রূপ ভুলতে চাননি। তেমনি ভারতের প্রায় সব বড় নদী এবং অসংখ্য ছোট নদী দেখার সুযোগ আমার জীবনে এসেছে নদীর কোন না কোন অবস্থায়। সেই নদীর মধ্যে একটি ‘প্রিয় নদী’ বাছাই করার কোন ইচ্ছা আমার হয় না কখনো। সব নদী দেখার, নদীর একেক গতিতে দেখার একেক রকম আনন্দ। তাই একটি নদীর গুণ মুগ্ধতার বর্ণনা করার চেয়ে ভালো কোন একদিনের ঘটনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা।
দিনটি ছিল ২৫ শে বৈশাখ ১৪১৫ সাল। গঙ্গাসাগর থেকে গুজরাট সমুদ্র উপকূল ধরে একক পদযাত্রার ২০৯ তম দিন। অম্বিকা নদী মোহনার কাছে ছোট গ্রাম নানি বোগাল। বেশীরভাগ গ্রামবাসী মৎস্যজীবী, পদবী তান্ডালে। রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরের পিছনের বারান্দায় সমুদ্র বায়ু সহযোগে রাত্রিযাপন। ভোর হতেই তৈরী হয়ে নেওয়া। অম্বিকা নদীর এক শাখা পার হতে, গতকাল এক হাঁটু কাঁদা পেয়েছি। পূর্ব উপকূলের সেই সোনালী সৈকত এদিকে নয়, মাটি বালি মেশানো সৈকত। মাটির ভাগ বেশী তাই জোয়ারের জলে এই হাঁটু ডুবে যাওয়া কাঁদা। বড় নদীর মোহনা এমনটাই হয় আগেও দেখেছি। কিন্তু গুজরাটের এই অঞ্চলে যেন নরম মাটির ভাগ বেশী। নানি বোগাল পার হওয়ার পর গোড়ালি অবদি কাঁদা হল। ঘন নীল তীব্র নীল গাঢ় নীল, সবুজ সমুদ্র এসব অনেক পিছনে ছেড়ে এসেছি। এখানে জোয়ার ছাড়া সমুদ্রের দেখা পাওয়া যায় না। ঘন্টা দুই হেঁটে অম্বিকা নদীর আরেক শাখায় পৌছালাম। নানি বোগালের পূজারীর পরিচিত লক্ষণ তান্ডালের বাড়িতে ক্ষণিকের বিশ্রাম। পেটানো চেহারা গায়ের রং আবলুস কালো তবে লক্ষণ ভাইয়ের উচ্চতা একটু কম। ভারতে অতিথি তো ‘দেব’ আর দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলের মৎস্যজীবীদের একই রকম আতিথেয়তা, প্রথমে বলেন বসো, জল খাও, ভাত খাও অনেক হেঁটেছো কদিন থেকে যাও আমাদের বাড়িতে লক্ষণ ভাইও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
বাংলায় বলে ‘নদীর পারে বাস ভাবনা বারমাস’ এ নিয়ম শুধু বাংলার কথা নয় এ নিয়ম সর্বত্র, লক্ষণ ভাইয়ের এটি চতুর্থ বাড়ি। ভোজন সেরে নদী পাড়ে পৌছালাম । লক্ষণ ভাই আমার পারানি ইঞ্জিন লাগানো ছোট্টো বোটে অম্বিকা নদী পার হলাম। অম্বিকা নদী ১৩৬ কিমি দীর্ঘ। অববাহিকার অঞ্চল ২৭১৫ বর্গ কিমি। এই নদী তৈরী করেছে গুজরাটের নায়াগ্রা ‘গির জলপ্রপাত ‘। যদিও তাকে দেখা আমার কাজ নয় আমার সাথী, নদী মোহনা -কাঁদা-বালি আর সৈকত। নৌকা নামালো নদীর বুকেই, জল পেরিয়ে বিস্তীর্ণ চড়ায় উঠলাম। গ্রাম কতদূর ঠাওড় করা যায় না, সমুদ্রও কত দূর তাও দেখা যায় না। ছোট বনি গাছের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ডান দিকে আর বাঁদিকে কাঁদা আর কাঁদা। সমুদ্র জোয়ারের সময়ে এসে মাটিকে কাঁদা বানিয়ে আবার চলে যায় কত দূর তার হদিস পাওয়া যায় না ভাটার সময়। একটু পা চালিয়েই হাঁটতে হবে আজ জোয়ারের জল কত উঁচুতে উঠবে গ্রাম কোথায় তা ভাল করে বুঝতে পারছি না, সাবধান হওয়া দরকার। এমন সময় শিস দিয়ে দুই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। লক্ষণ ভাইয়ের বন্ধু সুরেশ ভাই ও তাঁর বন্ধু ।আমার সাথে আলাপ করতে এগিয়ে এলেন। গুজরাটে মোটামুটি সবাই ‘ভাই’, নামের সঙ্গে ভাই জুড়ে সম্বোধন করাই রীতি। শহুরে কথায় বলে টল ডার্ক এন্ড হ্যানসাম সঙ্গে বিনয়ী শব্দ যুক্ত করলে যেমন মানুষ হবেন সুরেশ ভাই তেমনি। গ্রামে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ আর নয় অনেকটা অনিশ্চয়তার পথ চলতে হবে। করর্মদন করে বিদায় নিলাম সঙ্গে ফোন নম্বর আদান-প্রদান। তখনও জানি না এই এই ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া আমার জীবনের সেরা মধ্যে সেরা ফোনালাপ হবে। কিছুদূর যেতে এক তরুণ এগিয়ে এলো মনে হয় জাল বাঁধার কাজ সেরে ফিরছেন? সে জানালো সামনে একটা ‘দ্বীপ’ আছে ( ‘আইল্যান্ড’ শব্দটি ব্যবহার করে ছিল) তাতে উঠে পরবে। সেখানে দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিলে ওপারের ‘অঞ্জল’ গ্রাম থেকে কেউ নৌকা নিয়ে এসে পার করে দেবে। এমনটা বহুবার হয়েছে এই ২০৯ দিনে তাই আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। মিনিট চল্লিশ হাঁটার পর তেমনি একটি ‘আইল্যান্ড’ পেলাম অল্প জল পার হয়ে উঠে পড়লাম, গরম পুরু বালির দ্বীপে। এরপর প্রায় কুড়ি মিনিট চিৎকার- লাফালাফি-কাগজ পোড়ান সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। ওপার থেকে কোন গ্রামবাসী এলো না আমাকে পার করতে। আর আসবেই বা কে এই ভর দুপুরে ? তারপরে আবার জোয়ার আসার সময় হয়েছে। নদী-জল-জাল এর কাজ শেষে ঘরে ফিরেছে জলজীবী মানুষেরা।
সামনে বিশাল কানাই খাঁড়ি আর আমি শুধু একা। এই বিশাল খাঁড়ির ওপারে আমার শব্দ পৌঁছালো না। পাড় বাঁধের উপর দুই একজনকে দেখতে পেলেও তাঁরা আমাকে লক্ষ্য করলেন না। এতক্ষণে বুঝলাম কিছু একটা ভুল হয়েছে, দ্বীপ ভেবে যার উপর দাঁড়িয়ে আছি তা আসলে দ্বীপ নয় একটা চড়া। এই অঞ্চলে এসে থেকেই দেখছিলাম সমুদ্র অনেক দূরে তাঁকে পাওয়া যায় শুধু জোয়ারের সময়ে।আর তখন এই চড়া গুলি ২০ ফুট জলের তলায় চলে যায়। এটি তেমনি এক চড়া। ঐ ছেলেটির আইল্যান্ড শব্দে ধোকা খেয়েছি। এতক্ষণ তেমন কিছু হয়নি কিন্তু এখন এডরেনালিনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সাহসের কাজ শেষ বুদ্ধির কাজ শুরু। যে গরম বালিতে পা দেওয়া যাচ্ছিল না তার চার ইঞ্চি সরাতেই পেলাম ভেজা বালি। মানে এই সেই জলের তলায় চলে যাওয়ার চড়া। মৎস্যজীবী ভাইয়েরা বারবার সাবধান করে ছিল সবসময় ডান দিক দিয়ে যাবেন মূলভূমি ছাড়বেন না, ছাড়লেই বিপদ। ফুট দশেক এক হাঁটু জল পেরিয়ে যে দিক থেকে এসেছি সেই দিক প্রায় তিরিশ ফুট হয়ে তীব্র বেগে জোয়ারের জল ঢুকছে। এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে উপায়? শেষ চেষ্টা শুধু সাঁতার যতক্ষণ লড়াই ততক্ষণ জিত। তাড়াতাড়ি বালিতে গর্ত করে পিঠের রুক স্যাকটাকে পুঁতে ফেললাম অল্প মাথা উঁচিয়ে। আইডিকার্ডগুলোকে কোমরের পাউচে ঢোকালাম। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে খবরটা অন্তত নামের সঙ্গেই হবে। বিপদে বুদ্ধির ঘন্টা বাঁজলো । পথে আলাপ হওয়া সুরেশ ভাই এর ফোন বাঁজালাম। ‘ভাই ম্যায় পানি সে ঘের গ্যিয়া হ কুুচ কিজিয়ে’।
সে তক্ষনাৎ বললেন, আমি আসছি। মিনিট তিনেক পরে আবার ফোন ‘ভাই ‘ আপনি কি ভাবে আসছেন? সুরেশ ভাই জানালো হেঁটে- আমি বললাম আমার হাতে আর খুব বেশী হলে দশ মিনিট! সে জানালো কি বলছো? বুঝলাম আমার বিপদ তাঁকে ভীষণ ব্যাকুল করেছে। আমি জানালাম ‘অঞ্জল’ গ্রামে যদি চেনা কোন মানুষ থাকেন তাঁকে ফোন করুন, তিনি নৌকা নিয়ে আসতে পারলে হবে, নয়তো বিদায়! এরপর ফোনটা পাউচে ঢোকালাম। আর পরের কাজে মনঃসংযোগ করলাম। শরীর কে হাল্কা, মনকে দৃঢ় আরো দৃঢ় করতে। এই অল্প জীবন আমাকে শিখিয়েছে মৃত্যু দুই ভাবে আসে, এক হঠাৎ করে তাঁকে মোকাবিলা করার কোন পরিকল্পনা করার সময় থাকে না। যে ঘটনাচক্রের মধ্যে আছি তা যদি মৃত্যুকে হারাতে পারে তবে জিৎ না হলে সব শেষ। দুই – পরিকল্পনা ,বুদ্ধি, বিবেচনা সব কলা-কৌশলের প্রয়োগ শেষ শুধু অপেক্ষা। “মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান” শেষ অপেক্ষায় ধৈর্য্য ধরা।আমার তখন সেই অবস্থা। প্রথম ঢেউ পায়ের গোড়ালি ছুলো পরেরটা প্রায় কোমর। আর অপেক্ষা নয় এবার সাঁতার শুরু। এখানে বলতে চাই, যে সেদিন ভগবানকে খুঁজি নি। কোন গ্লানি ছিল না মনে, নিজেকে দোষারোপ করিনি। জীবনের কাটানো ভালো সময় গুলো মনে করতে করতে দুই ফুট- আড়াই ফুটের ঢেউ সামলাতে সামলাতে সাঁতার।২৫০- ৩০০ মিটার লড়াই করার পর হটাৎ জাল বাঁধা একটা বাঁশ পেলাম ।লাফিয়ে উঠে পড়লাম জালে উপর পা রেখে একটু দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সব বায়ু কে নিজের বুকে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, যেনো এক শ্বাসে চলবে বাকি জীবন। এমন সময় দেখলাম দূরে যেন একটা ইঞ্জিন লাগানো নৌকা। সামনে একজন দাঁড়িয়ে আর ইঞ্জিনের কাছে একজন। এর আগে চড়ায় দাঁড়িয়ে ওপারের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের এতো চেষ্টা করেছি, এখন আর নৌকা দেখেও কিছু করতে ইচ্ছা হলো না ।কিন্তু না, নৌকার সামনে যে, সে মনে হয় হাত নাড়লো ।এডরেনালিন আবার দিলো ধাক্কা। হাত টা নাড়লাম আবার সেও নাড়ালো। তারমানে সে আমাকে দেখছে। ঢেউ ঠেলে ঝপাং ঝপাং করে সে আমাকে বাঁচাতে আসছে। মন বলে উঠলো চলো এবারও তবে শ্যামের দেখা হলো না । ততক্ষণে জল আরো বেড়েছে বাঁশটিকে ছাড়তে হলো, কিন্তু মনে আবার সেই তেজ এসে গিয়েছে । ১৩ অক্টোবর ২০০৭ সেই প্রথম দিনের নাছোড়বান্দা মন আবার জেগেছে ।আর একটু লড়াই করতে পারলেই জিত । সুরেশ ভাইয়ের বন্ধু অঞ্জলে সব থেকে সাহসী যুবক বলে যাকে সবাই চেনে সেই মুকেশ ভাই হাত বাড়ালো ‘এসো’। সুরেশ ভাইয়ের ফোন পেয়েই দুপুরের খাবার ফেলে দৌড়ে এসেছেন কলকাতার বন্ধুকে বাঁচাতে। কারণ ঠিক এখানেই ওর প্রিয় বন্ধুকে সে গত বছর হারিয়ে ছিল । আর ১০০ মিটার গেলেই খাড়ির জল পাক খায়। তাই দেরি করেনি। সঙ্গে ছোট ভাই খাড়ির পারে পৌঁছে বলছিল দেখা যখন যাচ্ছে না তবে হয়ত সব শেষ, ছেড়ে দাও। কিন্তু না মহেশ ভাইয়ের কথা “চল না দেখি কি হয় ?” তাই আবারো জিত। বলিতে ব্যাগ পুঁতে রাখার সিদ্ধান্ত টা ঠিক হয়নি, ফাঁকা বোতল-ম্যাটরেস এইসবের প্লবতা ব্যাগ কে ভাসিয়ে তুলেছে সেটাকেও পাওয়া গেলো। সব কিছু ফিরে এলো সঙ্গে বলার মত গল্প নিয়ে। সন্ধ্যার সময় জামাই বাবু দুলাল দা ফোন করলো আজ বাড়িতে বড় উৎসব জেঠু-বড়মার পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী। বাড়ির সকলে আনন্দ করছে আর আমি মাতলাম মহেশ ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে বেঁচে থাকার উৎসবে।
…………………………………………………………………..
আরো পড়তে পারেন…
স্বপ্ন দেখি দুই দেশে একসাথে নদী- পরিবেশের পাঠশালা গড়ছি
নরসুন্দার নাব্যতা ফিরে পাওয়ার এখনই সময়
লাবন্যমতী একটি নদীর নাম
……………………………………………………………………..
নদী রক্ষা আন্দোলন কর্মী, কলকাতা, ভারত।