জাহাঙ্গীর শাহ ও মাসুদ রানা, গাজীপুর থেকে ফিরে >>
টঙ্গী বিসিক এলাকায় শিল্পকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চলছে চরম অব্যবস্থাপনায়। বর্জ্য ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। কিছু কারখানার নিজস্ব ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) থাকলেও খরচ বাঁচাতে তা সব সময় চালানো হয় না। ফলে শিল্প বর্জ্য নির্গমনের যেন একটাই ঠিকানা, তুরাগ নদ।
এ জন্য বিসিক শিল্পনগর থেকে তুরাগ নদ পর্যন্ত পাকা নর্দমা তৈরি করা হয়েছে। সেই নর্দমা দিয়ে শুধু বিসিক-ই নয়, আশপাশের অন্যান্য কারখানার বর্জ্যও গিয়ে পড়ে তুরাগ নদে। শিল্পবর্জ্যে প্রতিনিয়তই তুরাগের পাশাপাশি আশপাশের পরিবেশও দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে দুর্গন্ধের কারণে টঙ্গী এলাকায় তুরাগের দুই তীরের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বর্ষায় পানির প্রবাহ বেশি থাকায় দুর্গন্ধ একটু কম থাকে।
সম্প্রতি সরেজমিনে টঙ্গী বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা) এলাকায় দেখা যায়, প্রতিটি বড় কারখানার শিল্পবর্জ্য নির্গত হয়ে নর্দমায় পড়ছে। কারখানার পাশ দিয়েই গেছে খোলা নর্দমা। এ যেন বর্জ্য নির্গমনে একটি গোছানো ব্যবস্থা। কিন্তু এই বর্জ্য কোথায় যায়, তা খুঁজতেই বের হয়ে এল তুরাগ দূষণের ভয়াবহ চিত্র। অভিযোগ আছে, টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরের কারখানাগুলো খরচ বাঁচানোর জন্য নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি চালায় না। বিসিক সূত্রমতে, অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে ইটিপি আছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ইটিপি নির্মাণাধীন। কিছুদিন আগে পরিবেশ দূষণ করে এমন ২৮টি কারখানা চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর ১৮টি কারখানা নিজস্ব ইটিপি তৈরি করেছে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর জেলা শাখা সাতটি কারখানাকে ইটিপি নির্মাণের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে সময় দিয়েছে। কিন্তু ওই সব কারখানার মালিকেরা এখনো ইটিপি তৈরি করছেন না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান প্রথম আলোকে বলেন, ১০-১২ বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ঢাকার আশপাশের যেসব এলাকাকে পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন ঘোষণা করা হয়, এর মধ্যে তুরাগ একটি। বিসিক শিল্পনগরের কারখানাগুলো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছেমতো ময়লা-আবর্জনা ও শিল্পবর্জ্য নদে ফেলে।
কয়েক বছর আগে টঙ্গী বিসিকের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ইটিপি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল বিসিক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কেন্দ্রীয় ইটিপি নির্মাণে মালিকপক্ষ কত টাকা দেবে, তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এ বিষয়ে টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, মালিকদের সঙ্গে দর-কষাকষি ও বিভিন্ন অসহযোগিতার কারণে তা হয়নি। বিসিকের কারখানার বর্জ্যে তুরাগ নদ দূষণের কথা স্বীকার করেন তিনি। তবে এ-ও বলেন, শুধু বিসিকের কারখানা নয়, আশপাশের অন্যান্য কারখানার বর্জ্যও পড়ছে তুরাগে।
যেভাবে বর্জ্য ফেলা হয় তুরাগে
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, টঙ্গী বিসিক এলাকার প্রতিটি শাখা সড়কের পাশেই রয়েছে বিশাল খোলা নর্দমা। সেই নর্দমা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ও রঙের শিল্পবর্জ্য নির্গত হচ্ছে। কিছু দূর যেতেই দেখা যায়, বিসিক শিল্পনগর থেকে নর্দমা বের হয়ে পার্শ্ববর্তী পাগাড় এলাকার প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে চলে গেছে। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকার চারদিকেই উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর আধা কিলোমিটারের মতো পথ এগিয়ে গেলে পাঠানপাড়া এলাকায় গিয়ে নর্দমাটি কিছুটা নিচু ও পতিত এলাকায় পড়েছে। সেখান থেকে আরও প্রায় আধা কিলোমিটার এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, পাকা নর্দমায় প্রবাহিত তরল শিল্পবর্জ্য সরাসরি তুরাগ নদে গিয়ে পড়ছে। অবশ্য পাড়ে বড় বড় চোঙা বসিয়ে বর্জ্য তুরাগে পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবেই প্রতিদিন টনের পর টন তরল শিল্পবর্জ্য পড়ছে তুরাগ নদে। এতে তুরাগের পানি কালো রং ধারণ করে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে গত জানুয়ারি মাসেও সরেজমিনে টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরে একই চিত্র দেখা গেছে।
কথা হয় একই এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল হালিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৮-১০ বছর ধরে এভাবেই প্রতিদিন শিল্পবর্জ্য তুরাগে পড়ছে। পুরো পাগাড় এলাকা দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে। এত সুন্দর বাঁধানো নদের তীরে কেউ ঘুরতেও আসে না। তুরাগে গোসল করা বা মাছ ধরা তো অনেক দূরের কথা।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, সেখানে এখন ২১৪টি প্লটে ১৬৩টি কারখানা আছে। আর উৎপাদনরত ১৪৪টি কারখানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বস্ত্র খাতের কারখানা, মোট ৬৮টি। পাশাপাশি নিট ও ওভেন পোশাকসহ ওয়াশিং, ডায়িং, প্যাকেজিং সব কারখানাই আছে। এ ছাড়া প্রিন্টিং ও পাবলিশিং কারখানা আছে ১৮টি। অন্যদিকে কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের ১৮টি, চামড়া ও রাবারের ৮টি, গ্লাস ও সিরামিক খাতের ৭টি কারখানা আছে। এসব কারখানা থেকেই মূলত শিল্পবর্জ্য বেশি নির্গত হয়।
টঙ্গী বিসিকের কারখানা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন শেখ বলেন, যখন কারখানাগুলো হয়েছে, তখন মালিকদের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ে এত সচেতনতা ছিল না। এখন পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। এখন সবাই ইটিপি স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।
সূত্র:: প্রথম আলো, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮।।