।। জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী ।। “ দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মত নদী একটা নির্দিষ্ট ব্যপ্তির মধ্যে ক্রমাগত সঞ্চরণশীল থাকে। যে ব্যপ্তির মধ্যে নদী সতত গতিশীল থাকে তাকে বলে নদীর ‘মিয়েন্ডার বেল্ট’। নদীর ‘মিয়েন্ডার বেল্ট’কে তার খেলাঘর বলা যায়। যেখানে সে সক্রিয় থাকে। এই এলাকা কৃষি কাজে ব্যবহার করা গেলেও রেলপথ বা সড়কপথ নির্মাণের যোগ্য নয়। মানুষ না বুঝে নদীর খেলাঘরে ঢুকে পড়লেই বিপদ আসতে বাধ্য।”- সদ্য প্রকাশিত “দুই বাংলার নদীকথা” নামে বইতে বাংলার নদী নিয়ে তাঁর চার দশক ব্যাপী নিরলস গবেষণা ও চর্চার নির্যাসকে তুলে এনেছেন নদী বিজ্ঞানী কল্যাণ রুদ্র।
নদী আমাদের প্রাণ। নদীকে ঘিরেই পৃথিবীতে আবর্তিত হয়েছে সভ্যতার পদধ্বনি। মানুষ নদীর কাছে নতজানু হয়েছে নিরন্তর। নদীর কাছ থেকে দুহাত ভরে নিতে নিতে রিক্ত করেছেন নদীকে। প্রতিনিয়ত নদীকে নিংড়ে নিয়ে গড়ে উঠেছে জনজীবন। নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে সভ্যতার টিকে থাকা অসম্ভব। আর নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে প্রয়োজন নদীকে জানা এবং বোঝা। নদীর ইতিহাস-ভূগোলকে না জানলে তাকে বোঝা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের বোধগম্য বিজ্ঞানভিত্তিক নদীকে জানার বই দূর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলায় খুব বেশি নেই।
“১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে আমাদের বাংলা দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় ।দেশকে মুসলমান ও অ-মুসলমান অঞ্চলে ভাগ করার জন্য যে সীমারেখা টানা হয় সেই রেখা টি ৫৪ টি নদী অববাহিকাকেও ভাগ করে দিল।” ভাগ হয়ে যাওয়া নদী ব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে দেখে একটি সম্পূর্ণ ধারণা দেওয়ার মতো বই আমাদের হাতে এতদিন ছিল না।
কল্যাণ রুদ্রের “দুই বাংলার নদীকথা” সেই অভাব নিঃসন্দেহে পূরণ করবে। বস্তুত এই নদী বিজ্ঞানী গত চার দশক নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাংলার নদী নিয়ে কাজ করছেন। সে কাজ শুধু মাত্র চার দেয়ালের মধ্যে বসে বই বা পরিসংখ্যান একত্রিত করে করা নয়। বাংলার প্রায় সব নদীকে কাছ থেকে দেখেছেন, চেষ্টা করেছেন তাদের গতিবিধির কার্যকারণ বোঝার। লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, এই বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন হাজারো বার। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ গুলির মধ্যে যেমন আছে তাত্ত্বিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ যা মূলত শিক্ষার্থীদের জন্য লেখা, তেমনই আছে একেবারে সাধারণ মানুষের বোঝার মত করে লেখা প্রবন্ধ। “দুই বাংলার নদীকথা” মূলত সাধারণ বাঙালি পাঠকদের জন্য লেখা, ভাষা সাবলীল, বিষয়বস্তু যেখানে জটিল সেখানেও যথাসাধ্য সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপিত।
বইটিতে রয়েছে বারোটি অধ্যায়- বাংলার নদী প্রসঙ্গে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপের বিবর্তন, গঙ্গা নদীর ইতিবৃত্ত, ভাগীরথী হুগলি-নদীর ইতিবৃত্ত, রাঢ় বাংলার নদী, তরাই- ডুয়ার্স ও বরেন্দ্রভূমির নদী, যমুনা ও মেঘনার অববাহিকা, সুন্দরবনের ভূমি ও নদীর বিবর্তন, বাংলায় বন্যা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাংলার বন্দর নগর, বাংলা লুপ্ত বা মজা নদী, বাংলার নদীর দূষণ।
অসংখ্য ছবি ও স্কেচ-এর সাথে বইটিতে রয়েছে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র। যেগুলি বইটির মধ্যে ভাঁজ করা অবস্থায় আছে। মানচিত্র গুলির মধ্যে রয়েছে রেনেলের মানচিত্র বাংলা বিহার-১৭৮০, দুই বাংলার নদী মানচিত্র, গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা, রেনেলের মানচিত্রে গঙ্গার গতিপথ-১৭৮০, ভাগীরথী-হুগলি অববাহিকা, উত্তরবঙ্গ ও বরেন্দ্রভূমির নদী, অবিভক্ত সুন্দরবনের মানচিত্র।
বইটির অধ্যায় সূচি এবং মানচিত্রগুলির শিরোনাম প্রমাণ করে এধরনের বই বাংলা ভাষায় এর আগে কখনও লেখা হয়নি। গঙ্গা নিয়ে লেখকের দীর্ঘদিনের গবেষণার নির্যাস সহজ সরল ভাষায় উঠে এসেছে। গঙ্গা দূষণ নিয়ে তার উদ্বেগের কথাও গোপন করেননি। “পূর্ণকুম্ভের শহর হরিদ্বার থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত গঙ্গা কোথাও স্নানের যোগ্য নয়”। বক্তব্যের সমর্থনে দিয়েছেন প্রামাণ্য তথ্যসূত্র। বইটির আরেকটি বড় পাওনা দুই বাংলার নদী সম্পর্কিত অজস্র পরিসংখ্যানের সারণি। এইসব তথ্য নদী গবেষকদের মত সাধারণ পাঠকের কাছেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হবে।
দুই বাংলার নদী সম্পর্কিত প্রাচীন তথ্যের জন্য একদিকে যেমন পুরাতন মানচিত্র এবং সরকারি নথিপত্রের বিশ্লেষণ করেছেন তেমনই ভারতীয় উপমহাদেশে ভ্রমণকারী পর্যটকদের মূল লেখা থেকে তুলে এনেছেন প্রাসঙ্গিক তথ্য। বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলিতে নদী পথে যাতায়াতের নানা বর্ণনা পাওয়া যায়, কিন্তু সেসব তথ্য ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচারের খুব বেশি প্রচেষ্টা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি।এই বইতে মঙ্গলকাব্যের সাথে ভৌগোলিক অবস্থানগত তথ্যের সম্পর্ক খোঁজার এবং তা থেকে বেশকিছু ‘মিসিং লিঙ্ক’ এর যোগসুত্র খোঁজার চেষ্টা হয়েছে- “মঙ্গলকাব্যে অজয়, ভাগীরথী, দামোদর, সরস্বতী ও আদিগঙ্গার যে বর্ণনা আছে তা লেখক কবিদের সময়কালের বলেই মনে হয়। সেই সময়ও অজয় একটি বহতা নদী আর তার তীরে অবস্থিত উজানীনগর প্রসঙ্গে মুকুন্দরাম (প্রাক ১৫৯৪) লিখেছিলেন- ‘উজানীনগর অতি মনোহর আছে বহু সদাগর’। ওই নগরটি বন্দর না হলেও পণ্যবোঝাই সমুদ্রগামী জাহাজ ওখান থেকেই যাতায়াত করত,অর্থাৎ অজয়ের গভীরতা তখন জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত ছিল।”
অবিভক্ত সুন্দরবনের ভূমি ও নদীর বিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে বইটিতে। সুন্দরবনের ভূমির গঠনে হিমালয় থেকে বয়ে আসা নদী গুলির ভূমিকার সাথে সাথে বঙ্গোপসাগরেরও যে অপরিসীম গুরুত্ব আছে সেকথা যুক্তি সহ উপস্থাপিত হয়েছে এই অধ্যায়।’সুন্দরবনের জীবনরেখা’ নদীবাঁধ গুলির প্রস্থচ্ছেদ সাধারণ পাঠককে অঞ্চলের প্রধান সমস্যার মর্মার্থ অনুধাবনে সাহায্য করবে সন্দেহ নেই।
বাংলার বন্দর নগর এই বইয়ের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তাম্রলিপ্ত,গাঙ্গে, চম্পকনগরী, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম, চট্টগ্রাম প্রভৃতি বন্দরের ইতিহাস এবং বাঙালির সমুদ্র ও নৌবাণিজ্যের গৌরবময় অতীত তথ্য বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে একত্রিত করা হয়েছে। যেসব নদী কালের গর্ভে তাদের গতিপথ হারিয়েছে তাদের একটি তালিকাও বইটির গুরুত্ব বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। এই অধ্যায়টি আরও একটু বিস্তারিত হলে উৎসাহী পাঠক খুশি হতেন মনে হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নদীগুলিতে দূষণের মাত্রা কতটা সে বিষয়ে দুটি সারণি এবং বিস্তারিত আলোচনা আছে বইটিতে।
বইয়ের মধ্যে থাকা মানচিত্রগুলির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এর মধ্যে দুই বাংলার প্রায় সবকটি নদীকে চিহ্নিত করে আঁকা মানচিত্রটি নিঃসন্দেহে আগামীর নদী চর্চায় এক প্রামাণ্য দলিল রূপে পরিগণিত হবে।
বইটির ছাপা, বাঁধাই এবং বড় মানচিত্রগুলি সহ সামগ্রিক নির্মাণ বাংলা প্রকাশনায় বিরল। আগামীর গবেষক এবং নদী বিষয়ে আগ্রহী সাধারণ পাঠকের কাছে বইটি অবশ্য সংগ্রহযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হবে।
বর্তমান দিনের বড় মাপের বাঙালি বিজ্ঞানী, গবেষক, অধ্যাপকদের বাংলা ভাষায় লেখার ক্ষেত্রে অনীহা লক্ষ্য করা যায়। অথচ জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাথ সাহার মত আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীরা অন্য কাজের সাথে সাথে বাংলা লেখায় যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।কল্যাণ রুদ্রের বাংলার নদী বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ গুলি ইংরেজি ভাষায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমাদৃত। সাথে সাথে বাংলার সাধারণ পাঠকদের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি মূল্যবান বই গত চার দশকে লিখেছেন। “দুই বাংলার নদীকথা” সেই তালিকার উল্লেখযোগ্য, সম্ভবত শ্রেষ্ঠ সংযোজন।
দুই বাংলার নদীকথা- কল্যাণ রুদ্র, সাহিত্য সংসদ, প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০২১, মূল্য ৮০০ টাকা।
লেখক: জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী, সম্পাদক, শুধু সুন্দরবন চর্চা।
।। রিভার বাংলা-য় প্রকাশিত কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি ।।
নদীর বই- জলের লেখাজোকা-য় আরও পড়ুন…
‘মহানদী’, এক সাধারণ পাঠকের অনুভব
জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী : পেশায় শিক্ষক, কিন্তু তাঁর নেশা সুন্দরবন৷ দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় সুন্দরবনের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ৷ সম্পাদনা করছেন সুন্দরবন বিষয়ক ত্রৈমাসিক বাংলা পত্রিকা ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’৷