মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক চাহিদা ও যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে হারিয়ে যাচ্ছে নদী। স্হলপথ যোগাযোগ ও অপরিকল্পিত শহরায়ন নগরায়ন এর জন্য গতিপথ হারাচ্ছে নদী।প্রখর জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি ও অবাধ বুক্ষ নিধনের কারনে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী।টলটল ঢেউ আর কলকল অতিথি পাখি, দেশি পাখিদের নেই অবাধ বিচরণ।মৃতপ্রায় নদীগুলোর সাথে সহমরণ ঘটছে সবকিছুর। এর মধ্য নদীমাতৃক বাংলাদের পল্লীগীতি জারি শাড়ী ভাটিয়ালি গানগুলোর অপমৃত্যু ঘটছে। নৌকা নিয়ে আর বরযাত্রী আসে না এখন।কে গাইবে বিয়ের গীত, নৌকার শাড়ি? এ যেন এক অদৃশ্য শত্রু নদী ও গানের।
নাব্যতার অভাবে নৌপথ বন্ধ।জলের প্রবাহ নেই নদীতে।সুরের প্রবাহ আসবে কি করে? গীতিকার,কবি,সুরকার,লেখক ও শিল্পীর হৃদয়ে।লয় ছাড়া তাল, তাল ছাড়া সুর ভাবের আবেশে ভাটা, নদীর গানে কাঁটা। প্রাচীন বাংলার সুর সাধনা ও গানের প্রধান উপজীব্য ছিল নদী।জীবনপ্রবাহ আর নদীপ্রবাহ ছিল বিনিসূতার মালা।সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে সুধাই,এবার ভাংগে ও পাড় গড়ে এইতো নদীর খেলা,ও নদীরে বলনা তুই আমারে,ও লো ভাবীজান,এসব কালজয়ী গান আর কি হবে? কে রচিবে? অসুরের বেসুর বৈরি প্রকৃতি কি পারবে? আর একটা আব্দুল আলীমের স্বর্ণকন্ঠ এনে দিতে।আরেকজন জসিমউদ্দিন কি কলম খাতার ঢালি নিয়ে বসবে নদীর গান লিখতে?
হাওর ও নদীবেষ্টিত সংস্কৃতির জেলা নেত্রকোনা। জেলা সদরের অদুরেই রয়েছে ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওলি হযরত শাহ সুলতান কমরউদ্দিন রুমী (রঃ) এর পবিত্র মাজার।মাজারের পাদদেশের দুইশো গজ অদূরেই বয়ে গেছে তিনটি নদী।পশ্চিম থেকে আসা উরাই, ব্রক্ষ্মপুত্রের শাখানদী, উত্তর থেকে আসা মগড়া, গারো পাহাড়ের আর দক্ষিনে হাওর থেকে আসা ষাটওলি নদী।তিনটি নদীর সংগমস্থল এখানে।উভয় দিকে দুটি বড় ব্রিজ নিচে পানিশূন্য ধূ- ধূ বালি আর ধান রোপনকৃত ফসলী জমি।
অথচঃ এখানে বসেই আষাঢ় মাইসে ভাসা পানি, আমার গাঁয়ে যত দুঃখ সয়, ও লো ভাবীজান এসব কালজয়ী গান রচনা করেছেন সাধক উকিল মুন্সী।মরমী জালাল খাঁ তার শেষ শিষ্য শাহ আব্দুল করিমকে নদী ও হাওরের গানের হাতেখড়ি দিয়েছিলেন।কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদও ছুটে আসতেন এই ত্রি-মোহনায়।
আজ নদী আছে নামমাত্র। পানি নেই, স্রোত নেই। কে লিখবে নদীর গান? বাংলার তেরো শত নদীর মধ্য সাতশো মৃতঃপ্রায়। এর মধ্য এই তিনটি নদীও মৃতঃপ্রায়। উরাই, মগড়া, ষাটওলির কলকল ঢেউ নেই।নদীর মতো উদাস করা গানও নেই।সহমরণ নদী ও নদীর গানের।
ঘেটুপুত্র কমলার পালা, নববধূর নাইয়র যাইবা নি লোকজ পালাগানের স্বাদ কি আর পাবে নদীরদেশের নদীর মানুষেরা।মহুয়া আর চান্দু সওদাগরের কাহিনী রাতভর শোনাবে কে? রচিবে কি কোন গান কোন কবি, গাইবে কি গায়ক? নদীভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি ও গান একমাত্র নদীগুলোকে খনন ও দখলমুক্ত করার মাধ্যমেই পূর্ন্যযৌবনা করা সম্ভব। নতুবা সধবা স্বামী কিংবা বিধবা স্ত্রীর মতো মধ্যযুগের কালাকানুনের মতো ভস্ম হয়ে সহমরণ ঘটবে নদী ও গানের।
আরো পড়তে পারেন…
নদী ও নারী: এ যে নিজের সাথে নিজের কথোপকথন
করতোয়া নদী : ৩০ দখলদারের তালিকা ওয়েবসাইটে
আমার সখা নরসুন্দা : মু আ লতিফ (তৃতীয় পর্ব)
শিক্ষক ও নদী রক্ষা আন্দোলন কর্মী
তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ।