।। সঞ্জীব দ্রং ।।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ শিরোনামে প্রথম আলো ৪ ফেব্রুয়ারি বিশেষ আয়োজনে সচিত্র প্রতিবেদন করেছে তুরাগ, বালু বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদ–নদী নিয়ে। নদ–নদীর এই করুণ রুগ্ণ দশা দেখে সবার মন ভারাক্রান্ত হওয়ার কথা। এসব নদ–নদী মরে যাচ্ছে। নদ–নদীগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে। নদ–নদী দখলকারী ও দূষণকারীরা তাদের সন্তানদের কথা, পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবে না। নগদ মুনাফাই তাদের মুখ্য। অথচ এই নদ–নদীগুলোকে যত্ন করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া আমাদের কর্তব্য।
শৈশবে নদীর যে রূপ দেখেছি, নদী বলতে চোখের সামনে যে ছবি এখনো ভেসে ওঠে, তার বিচারে এসব নদ–নদী এখন যেন মৃত। সারা দেশেই মানুষের অত্যাচার ও লোভ-লালসার শিকার হয়ে নদ–নদীগুলো মরে গেছে অথবা মুমূর্ষু। এসব নদ–নদী নিয়ে বাংলায় কোনো কবি, গীতিকার নতুন নতুন কবিতা ও গান কীভাবে রচনা করবেন? রবীন্দ্র জৈনের গানের একটি লাইন আছে, ‘চন্দ্র সুরুজ নিয়ে বুকে, বেশ তো আছিস মনের সুখে’। মধুমতী নদীকে নিয়ে গান। ‘চলিস বয়ে কোনখানে/ নাম না জানা উজানে/ কোন পাড়ে ছিলিস রে তুই/ নেমে এলি কার টানে’। পরের লাইনটি আরও হৃদয়স্পর্শী, ‘তোকে নিয়ে আমার জীবন স্নেহ মায়ায় ভরানো’। মধুমতী আর শিল্পীর জীবন স্নেহ–মায়ায় জড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনে টেপরেকর্ডার বাজিয়ে জগন্নাথ হলের ২২৯ নম্বর কক্ষে গানটি শুনতাম। মন উদাসী হয়ে চলে যেত কোন দূরের গ্রামে, যেখানে নদী, নীলাকাশ, মানুষ একাকার। আবেগে বুকটা হু হু করে উঠত। নদী নিয়ে কত গান আছে আমাদের—প্রেমের, আনন্দের, ভালোবাসার, বিরহের। ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়’। এখন তুরাগ নদের দুই কূলে বসে থাকার অবস্থা কি আছে?
ভালো খবর হলো, হাইকোর্ট ৩ ফেব্রুয়ারি নদীকে ‘লিগ্যাল পারসন, জুরিসটিক পারসন ও জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আইনজ্ঞরা বলেছেন, নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেওয়া রায় দেশের ইতিহাসে প্রথম।
তাঁদের মতে, একজন মানুষ যেমন আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান, নদীরও তেমন আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হলো (প্রথম আলো ৪ ফেব্রুয়ারি)। আদিবাসী মানুষের বিশ্ববীক্ষা, জীবনধারা ও সংস্কৃতিতে নদী ও প্রকৃতির প্রাণের কথা হাজার বছর আগেই বলা হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতে মনে করা হয়, জগতের সবকিছু পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মানুষ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত। সবার প্রাণ আছে। সবই মূল্যবান ও পবিত্র। আকাশ, বাতাস, পশুপাখি, লতাপাতা, ফুল, বৃক্ষ, নদী, প্রজাপতি—সবার অভিন্ন নিশ্বাস।
১৮৫৪ সালে চিফ সিয়াটল এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ধরিত্রী আমাদের জননী। নদী আমাদের বোন: দ্য রিভার্স আর আওয়ার সিস্টার্স। তারা আমাদের তৃষ্ণা মেটায়। এই যে নদীর জল ঝিলমিল বয়ে যাচ্ছে, এ শুধু জল নয়, এ আমাদের পূর্বপুরুষের রক্ত। ঝরনার জলের মর্মরে আমাদের পিতৃপুরুষের আত্মার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সুতরাং তোমরা নদীকে যত্ন করো, যেমন তোমরা তোমাদের বোনদের যত্ন করো।’
এ কথাগুলোর মধ্যে নদী, প্রকৃতি ও পৃথিবী সম্পর্কে আদিবাসীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। টাইটানিক চলচ্চিত্রের বিখ্যাত নায়ক লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও তাঁর রেভেন্যান্ট ছবির জন্য গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার গ্রহণের সময় বলেছেন, ‘আমি এই পুরস্কার বিশ্বের সব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি, যাদের এই ছবিতে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখন সময় এসেছে আদিবাসীদের ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং তাদের ভূমিকে করপোরেট আগ্রাসন ও বহিরাগতদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করার।’ আদিবাসী নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবন ও জগৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্ববীক্ষা নদী রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
হাইকোর্টের রায়ে নদী কমিশনকে দেশের সব নদ-নদী সুরক্ষা, সংরক্ষণ, শ্রীবৃদ্ধিসহ সব ধরনের বহুমুখী উন্নয়নে অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা আশা করব, নদী কমিশন দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আমি যখন ময়মনসিংহ যাই, তখন তুরাগ নদের ধার ঘেঁষে বাঁধের রাস্তা দিয়ে যাই। কোনো গবেষণার দরকার পড়বে না, প্রকাশ্য দিবালোকে কীভাবে নদ দখল হয়ে যাচ্ছে, তুরাগ নদ তার প্রমাণ। নদের ওপরে এত নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার অন্য কোনো জাতি করে কি না আমি জানি না। আদালতের রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিটি শ্রেণি, বিভাগ ও শিক্ষাবর্ষে প্রতি দুই মাসে অন্তত এক দিন নদী বিষয়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টার সচেতনতামূলক ক্লাস নিতে হবে। এতে নদীর প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ইত্যাদি বিষয় থাকবে। দেশের শিল্প–কারখানা, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগেও তিন মাস অন্তর দিনব্যাপী নদীবিষয়ক আলোচনা ও সেমিনার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানি না, এসব ক্লাস ও সেমিনারের কারিকুলাম বা মডিউল কী হবে। সমাজের সর্বস্তরে, প্রতিটি পরিবারে আমাদের সন্তানদের কাছে এই শিক্ষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া হোক: নদীরও জীবন আছে, নদী কথা বলে, নদীরও সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ আছে। নদী ও মানুষ পরস্পর ভাইবোন। মানুষ নদী দখল করবে না, বরং নদীর যত্ন করবে। উভয়ের জন্য, উভয়ের কাছে উভয়ই সমান মূল্যবান। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নদীর পানি দূষণমুক্ত ও স্বচ্ছ রেখে যাওয়া আমাদের সবার কর্তব্য। আমরা অনেক কিছু হারিয়েও আদিবাসী মানুষের জীবনধারা ও বিশ্ববীক্ষা থেকে কত কিছু শিখতে পারি। মানুষ অবোধের মতো প্রকৃতিকে জয় করতে চায়। প্রকৃতিকে পরাস্ত করে জয় করার কিছু নেই। বরং মানুষ ও প্রকৃতি একাকার হয়ে আছে। কেউ কাউকে পরাস্ত করার ভাবনা ভুল। প্রকৃতিকে আপন ভেবে ভালোবাসার শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা আমরা কবে শুরু করব?
সঞ্জীব দ্রং সংস্কৃতিকর্মী ও কলাম লেখক।
সূত্র: প্রথম আলো । প্রকাশ- ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।