‘নদী একটি জীবন্ত সত্তা, এর আইনি অধিকার নিশ্চিত করুন’ এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পালিত হবে বিশ্ব নদী দিবস-২০১৯। এ উপলক্ষে রিভার বাংলা’র আয়োজন ‘নদী দিবসে নদী ভাবনা’। আজ প্রকাশ করা হল এই সিরিজের প্রথম লেখা- ‘ফিরে চলো নদীর টানে’ -লিখেছেন আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যসন্ধানী লেখক ও সাংবাদিক, মু আ লতিফ ।- সম্পাদক
নদীর সঙ্গে মানুষের রয়েছে নিবির সম্পর্ক। নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ভূ-প্রকৃতি,জনপদ, যাতায়াত, কাব্য-সঙ্গীত-সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং সভ্যতা। মানুষের মন-মনন-মনীষা নির্মাণেও নদীর রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা আরো খাঁটি কারণ এটি যে নদীমাতৃক দেশ। এর দেহ বিস্তৃত, পল্লবিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে নদীর আশির্বাদে।
আমরা নদীকে বলতে পারি বাংলাদেশের ফুসফুস বা ধমনি। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য যেমন ফুসফুস গুরুত্ববহ তেমনি এ ভূ-খন্ডের প্রাণ প্রবাহের জন্য নদীর গুরুত্ব ততধিক। মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হলে যেমন তার দেহ অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ হয়। তেমনি নদী ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেশ ক্ষত-বিক্ষত হবে এটাই সহজ হিসাব।
পৃথিবীতে নদী এক অপার সম্ভার। নদীর রূপময়তা ও সৃষ্টিশীলতা মানুষের জন্য পরম আশির্বাদ। এই নদী নিয়ে মানুষের উচ্ছাস-ভালোবাসা অনাদিকাল থেকে। মানুষের বসতি, খাদ্য, বাণিজ্য, আনন্দ-বেদনা এমনকি প্রাণশ্বৈর্যের যোগান দিয়েছে এই নদী। নদীকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে কত গান, কবিতা ও অখ্যান। লোকসাহিত্যের অমূল্যসম্পদ মৈমনসিংহ গীতিকা’র মলুয়া-মহুয়াসহ অসংখ্য পালাগুলো রচিত হয়েছে এই নদীর পললে।
এই যে নদীময়তা জলছল কলকল রব এ নিয়ে কবিদেরও কাব্য-গাথার শেষ নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল, জীবনান্দ দাশ, আবিদ আজাদ, নির্মলেন্দু গুণসহ অসংখ্য কবি নদীকে নিয়ে তাঁদের মনের মাধুরি মিশিয়ে কাব্যেরঢালি সাজিয়েছেন। নদীর প্রাণ প্রবাহ,গতিময়তা, নির্জনতা, প্রমত্ততার বর্ণনায় উঠে এসেছে নদীর আত্মপরিচয়।
শিল্পীর কন্ঠে আমরা তাইতো শুনি,-
এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই হাজরো নদীর অববাহিকায়
এখানে রমণীগুলো নদীর মতন, নদীও নারীর মত কথা কয়।
আমরা আরো শুনি,-
ওনদীরে,
একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই চলার শেষ..
আবার আক্ষেপের সুরও বাজে তাদের কন্ঠে –
বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে- ওগঙ্গা তুমি-
গঙ্গা বইছ কেন?
বাংলাদেশে নদী যেন নদীতীরের মানুষের জীবনের স্বরলিপি। নদীর কাছে মানুষের ঋণের শেষ নেই। নদী ছাড়া মানুষ বাঁচে না। নদীর জলে মানুষ খুঁজে পায় প্রশান্তি। কবি আহসান হাবীব নদীকে তাঁর কবিতায় এই ভাবে সাজিয়েছেন –
তোমার কি মনে পড়ে- সেই নদী যে নদীর
ঘাটে
হাজার বৎসর ধরে আমাদের একান্ত স্বজন
বহুজন
ক্লান্ত মুখ ধুয়েছে এবং
বিস্রামের সব সুখ নদীর জলের মতো গায়ে
মেখে
ঘুমিয়েছে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন-
নদী আছে থাক, ভালোই তো, নদী থাকুক
আমি কি করব? এইভাবে নিজেকে বুঝাই
যখন ভেতর থেকে সহসা নির্গত হয় নদী।
শুধু কবিরা নয়। নদীর প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষের জীবন গতিময় নিরন্তর তার পথচলা। নদীরও গতি নিরবধি। নদীর সঙ্গে তাই মানুষের এতো মিল, এতো সখ্যতা। যেখানে নদী নেই, সেখানে যেন প্রাণ নেই- উষ্ণ ধুধু বালুচর। যেখানে নদী নেই সেখানে বৃক্ষ-গুল্ম নেই, প্রকৃতির শোভা নেই, আকাশ আছে, কিন্তু আকাশের প্রতিচ্ছবি নেই। নদী হারিয়ে তাইতো মানুষের এত কান্না, এত হাহাকার।
হাহাকারটা শুরু হয়েছে নদীর থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে। যতই মানুষ নদী থেকে দূরে সরে আসছে মানুষের দুর্দশা ততটাই বাড়ছে। নদীর কথা না ভেবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুষণ, দখল ও বাঁধ নির্মাণ কাল হয়েছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনী শক্তি ক্ষয়-ক্ষতিগ্রস্থ ও নিঃশেষ হচ্ছে। শস্য-শ্যামল, সুজলা-সুফলা বাংলার মুখ আজ বিবর্ণ, বিধ্বস্থ। নদীর অভাবে জলপথে নির্মল বাতাসে ভ্রমণের সুযোগ আমরা হারিয়েছি। স্থল পথে গাড়িতে চড়ে দূষণে-দুর্ভোগে পড়ে জীবনকে করছি ছাড়খাড়। রোগ-শোক,জরা-যন্ত্রনায় আমাদের জীবন আজ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নদীকে ছেড়ে আমরা হারিয়েছি জীবনের সব প্রশান্তি। বাজার অর্থনীতি আর লুটেরা পুজিপতিরা মানুষের জীবনকে শিকোয় তুলেছে। তারা রাস্তা বানায়, বাঁধ দেয়, তারা উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে। নদীর স্বাভাবিক গতিকে রূদ্ধ করে বিপর্যয় ডেকে আনে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের নামে জলসাঘর নির্মাণ করে। প্রতি বছর রাস্তা নির্মাণ ও মেরামতের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর সিকিভাগ অর্থ দিয়ে আমাদের গ্রামীণ নদীগুলোকে খনন করে নাব্য করা সম্ভব। তাহলেই আমরা নদীপথে নৌকায় বা স্টিমারে জেলা শহর থেকে উপজেলায় দুষনমুক্ত নির্মল বাতাসে যাতায়াত করতে পারবো। সুন্দর ও বাহারি নৌকাগুলো নদীতে ভাসবে- কি আনন্দ, মন ভরে উঠবে। যাত্রাপথে নদীর দু’পাশের সবুজ-শ্যামলিমাময় গ্রামগুলো আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকবে। অথচ আমরা চড়ছি স্কুটারে-গাড়িতে। যেখানে পদে পদে মৃত্যু হানাদেয়। ধুলা-বালিতে দুষণে আমাদের জীবনকে হুমকীর মুখে ঠেলে দেয়্। এতসব অসঙ্গতি ও নির্মম কঠিন বাস্তবতা তারপরও নদীগুলো খনন হয় না কেন, এর অন্তরায় কারা, আমাদের জানতে হবে।
‘নদীর কাছে এসো’র ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে অন্যত্র
এখনই সময় সাবধান হওয়ার। যে নদী আমাদের সেচের পানি দিয়ে শস্য ফলাতে সাহায্য করে তাকে ধ্বংস করা যাবে না। যে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে নির্মল বাতাসে আমরা আমাদের গন্তব্যে যেতে পারি সেই নদীকে বাঁধ দিয়ে মারতে আমরা দেব না। নদীমাতৃক বাংলাদেশে আবহমানকাল ধরে বয়ে যাওয়া নদীগুলোকে আমাদের বাঁচাতে হবে। নদীর কাছে আমাদের ফিরে যেতেই হবে। এ জন্যে আমাদের প্রত্যেককেই আরো সচেতন এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। নদী দখল, দূষন বন্ধ করার জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
মহামান্য হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত স্বত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছ্। নদীরও বেঁচে থাকবার অধিকার রয়েছে। কেউ নদী দখল করতে পারবে না। নদী ভরাট করে কোনো স্থাপনা করা যাবে না। মানুষ যতই সচেতন হবে আইনী স্বীকৃতি ততই মজবুত হবে। আসুন আমরা নদীর প্রতি কৃতজ্ঞ হই এবং নদীর কাছে ফিরে যাই। তাহলেই বিশ্ব নদী দিবসের ভাবনা ‘ফিরে চলো নদীর টানে’ সার্থক হয়ে উঠবে।
আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও লেখক, কিশোরগঞ্জ।