বাঁচলে নদী বাঁচবে দেশ : ড. মীজানুর রহমান

কীর্তনখোলার ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ নদীতে মাছ ধরে জীবন যাপন করছে

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান >> 

নদীমাতৃক বাংলাদেশ কথাটির অর্থ, বাংলাদেশ নামক দেশটির মা বা জননী হচ্ছে নদী। গঙ্গার পানির সঙ্গে আসা পলি জমে জমে সৃষ্টি হয়েছিল এই ব-দ্বীপ। এ হচ্ছে বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যা মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মতো কাছাকাছি ধারণা। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঠিকানাও কিন্তু নদী। পাকিস্তানি আধা-ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মধুমতির তীরে জন্ম নেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে বাংলাদেশের জন্য আমরা দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছিলাম তার ঠিকানাও ছিল আমাদের তিনটি প্রধান নদীর নামে। ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’; এটাই ছিল আমাদের রাজনৈতিক ঠিকানা।

বাংলার সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুতেই রয়েছে নদীর প্রচণ্ড প্রভাব। জননী নদী ব-দ্বীপটি জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি, নদী তার প্রবাহ দিয়ে দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যেমন স্নেহময়ী মা দুধ দিয়ে তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখেন। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘কপোতাক্ষ নদ’ সনেটে যেমনটি বর্ণনা করেছেন :

বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, 
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।

এ দেশের শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির সিংহভাগজুড়েই আছে নদী। নদী বাংলাকে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে। ১৯৪৯ সালে নবীনগর থেকে নৌকায় আসছিলেন বঙ্গবন্ধু, সঙ্গে ছিলেন আব্বাস উদ্দিন সাহেব।

বঙ্গবন্ধুর বর্র্ণনা মতে, ‘নদীতে বসে আব্বাস উদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল নদীর ঢেউগুলোও যেন তার গান শুনছে’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ ১১১)। নদী আমাদের আনন্দ-বেদনা-বিরহ সবকিছুতেই ভাগ বসিয়েছে। বিরহের জলকেও ধারণ করেছে নদী। ১৯৫০ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তার কারণে বন্দি থাকা অবস্থাতেই তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। গোপালগঞ্জে দায়ের করা আরেকটি মামলায় হাজিরার সুবিধার্থে কিছু দিন পর তাকে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন ‘খুলনা মেলে’ বরিশাল হয়ে পাটগতি স্টেশন ছুঁয়ে গোপালগঞ্জ যেতে হতো।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘…যা ভয় করেছিলাম তাই হলো, পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওনা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হলো না আমাদের’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ১৭৬)। অনেকটা যেন মান্না দে’র বিখ্যাত গানের মতো, ‘এই কূলে আমি, আর ঐ কূলে তুমি, মাঝখানে নদী ঐ বয়ে চলে যায়।’

নদী বাংলা সাহিত্যের অনন্য অনুষঙ্গ। নদীবিহীন বাঙালি জীবন যেন কল্পনা করা যায় না। এ কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে সত্য। বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টির বেশির ভাগই নদীকেন্দ্রিক। যেমন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, তারাশঙ্করের ‘কালিন্দী’, হুমায়ূন কবিরের ‘নদী ও নারী’, বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ প্রভৃতি। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে নদীময়তার কথা বলে শেষ করা যাবে না। রবীন্দ্রসাহিত্য সাধনার অন্যতম শিল্পসঙ্গী নদী। বাংলাদেশের ‘পদ্মা’ ও ‘গড়াই’ কবিকে তার আত্মদর্শনে সাহায্য করেছিল। পদ্মাতীরেই তিনি তার কবিধর্মের সন্ধান পান। কাজী নজরুল ইসলামের বহু গানেই নদী বিধৌত : ‘মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম নদীর চরে,/যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে…’, কবি তার বিরহের ভারও দিতে চেয়েছেন নদীকে: ‘পদ্মার ঢেউ রে… মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে। এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙ্গা পা আমি হারায়েছি তারে…।’

বলা হয় হাজার নদীর দেশ ছিল আমাদের বাংলাদেশ। বাংলাদেশে এখন নদী ও শাখা নদীর সংখ্যা ২২৫টির মতো। যদিও এর অনেকগুলোই গবেষকদের গবেষণাপত্রের পৃষ্ঠা বৃদ্ধিতেই এখন ভূমিকা রাখছে। অধিকাংশ নদীই দখলে দূষণে শীর্ণ-বিবর্ণ।

আমাদের নগরায়ন-শিল্পায়ন হচ্ছে দ্রুত। মানুষের অনেক পুরনো বিশ্বাস, যে নগরে নদী নেই সেই নগরবাসী অভাগা। যত উন্নয়নই করি না কেন নদী না থাকলে দেশ বাঁচবে না। পদ্মা শীর্ণ-বিবর্ণ হয়ে গেলে আমাদের গর্বের ধন ‘পদ্মা সেতু’ নিয়ে গর্ব করার কিছু থাকবে না। ‘নদী’ ও ‘সংস্কৃতি’ চলক দুটির সংশ্রব বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন নদীর অনুপস্থিতিতে মানুষ পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর প্রকৃতির হয়। নদী প্রকৃতির দান। দুই একটি খাল কাটলেও কোনো নদী আমরা তৈরি করিনি।

নদীকে বেশি শাসন-দূষণ করলে প্রকৃতি পাল্টা ব্যবস্থা নেবেই। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত হুমকি প্রকৃতিরই একটা প্রতিশোধ। নদীকে সুরক্ষা দিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে। নদীবান্ধব অর্থনীতি গড়ার চেষ্টা আজ ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন ও নদীকে দ্বান্দ্বিক অবস্থায় নেওয়া যাবে না।
শিল্পায়নকে অব্যাহত রেখেই টেমস, রাইন, শিকাগো, ডন নদীকে সফলতার সঙ্গেই পুনরুজ্জীবন দেওয়া গেছে। আমরাও পারব বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগকে বাঁচাতে।

সম্প্রতি তুরাগ নদীকে ‘জীবন সত্তা’ হিসেবে রায় দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। অন্যদিকে নদী বাঁচানোর বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান (বিডিপি)-২১০০’ প্রণয়ন করে এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সব সময় মনে রাখতে হবে বাঁচলে নদী, বাঁচবে দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

লেখক : অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।  সূত্র: খোলা কাগজ,  এপ্রিল ১৫, ২০১৯

…………………………………………………………………………………………………………..

আরো পড়তে পারেন…

হালদায় তেল দূষণ, নদী কমিশন নড়ুন-চড়ুন – গওহার নঈম ওয়ারা

এই জয় নদীর পক্ষে লড়াইয়ের জয়

সংশ্লিষ্ট বিষয়