রিভার বাংলা’র বৈশাখী আয়োজনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রধান নদী আত্রেয়ী নিয়ে লিখেছেন নদী আন্দোলনের সংগঠক তুহিন শুভ্র মন্ডল – সম্পাদক
কবে থেকে নদীকে দেখতে শিখি মনে পড়ে না ঠিকঠাক।তবে হ্যাঁ, নদীকে দেখি অনেকদিন থেকেই। আমার বাড়ি বালুরঘাটে একেবারে খাঁড়ির ধারে।প্রতিদিন সকালে জানলা খুললেই দেখতে পাই তাকে। বলা যেতে পারে ঘুম থেকে উঠে জল দেখি আর জলকে দেখেই ঘুমোতে যাই।এই খাঁড়িই গিয়ে মিশেছে বাড়ির অদূরে দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রধান নদী আত্রেয়ীর সাথে। সেই আত্রেয়ী, যাকে পেরিয়ে মায়ের হাত ধরে পৌছাতাম দাদু-দিদার বাড়ি। মনে পড়ছে বর্ষার সময় নৌকা করে যেতাম। সোজা পথে না গিয়ে নৌকা ঘুরপথে যেত।সময় লাগতো বেশী আর মাঝির পরিশ্রমও হতো বেশী।নদীর জলের টান সেভাবেই নিয়ে যেত।পরে অবশ্য ইঞ্জিন চালিত নৌকা কমবেশী সোজা পথেই যেত।
আত্রেয়ীই আমার ছোটবেলার নদী। আজ থেকে পয়ত্রিশ- ছত্রিশ বছর আগের ছবি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বর্ষার সময় ছাড়া নদীর বিশাল চর।পায়ে হেঁটেই পার হতাম নৌকা থেকে নেমে। সে অন্যপথ। তারপর যখন শিলিগুড়িতে কলেজে পড়ার জন্য গেলাম, পেরিয়ে গেলাম বালাসন আর মহানন্দা।সেটা আজ থেকে তেইশ বছর আগে।তারপর থেকে এই দুটো নদীকে এখনো দেখেই যাচ্ছি।তার কিছু পরেপরেই জীবনে চলে এলো মাগুরমারি, তিস্তা, তোর্ষা আর হলং। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি তখন মাগুরমারির সাথে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়।সেটা মূলত তার নামের কারণে।কেউ কেউ বল প্রচুর মাগুর মাছ নাকি সেখানে পাওয়া যেত, তাই মাগুরমারি।তারপর যখন মাদারীহাটে (বিখ্যাত জলদাপাড়া অভয়ারণ্য) কর্মসূত্রে ছিলাম তখন যাওয়া আসার পথে তিস্তা, করলা আর খুব কাছ থেকে তোর্ষা আর হলং নদী দেখলাম।
এরই ফাঁকে কখন যে নদীর প্রতি আলাদা চোখ তৈরি হলো এখনও বলতে পারিনা।কিন্ত হলো। আর সেই হওয়াটাই জীবনের একটা বাঁকবদল ঘটালো।যেখানে যুক্ত হলো নদীর কথা, পরিবেশের কথা।আর এখন সেটাই জীবন হয়ে গেলো। মনে পড়ে কিছুদিনের জন্য যখন মাদারীহাট ছেড়ে আবার শিলিগুড়ি এসেছিলাম বি.এড করার জন্য তখন আসার আগের দিন বিকেলে হলং নদীর ধারে স্কুটার দাঁড় করিয়ে বলে এসেছিলাম ‘ভালো থেকো হলং’।কি জানি যদি আর না ফিরি এখানে!তারপর অবশ্য ফিরে আসি আবার তখন ডুয়ার্সের বীরপাড়াতে থাকতাম।মুজনাই, ডিমডিমাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ তৈরি হলো।ফলে আমার জীবনে আমি অনেক নদীর কাছাকাছি এসেছি।তখনই কি তাদের গোপন কান্নার কথা আমার বুকের ভিতর গুঁজে দিয়েছিলো নদীরা? নাহলে কেনই বা এখন নদীর জন্য লড়বো।নদীর কথা বলবো?!
এখন আবার ফিরে এসেছি আত্রেয়ীর পাড়ে আমার শহরে।এর সাথেই নিবিড় ভাবে দেখি পুনর্ভবা, টাঙ্গন,শ্রীমতি, ইছামতি, যমুনাকে দেখি।ব্রাহ্মনীকেও। সত্যি কথা বলত কি কষ্ট হয় খুব।এখন আরো অনেক নদী যুক্ত হয়েছে জীবনে।এখন অস্তিত্ব ধরে ঝাঁকিয়ে দেয় নদীর চেতনা। আমরা নদীমাতৃক সভ্যতার কথা বলি অথচ নদীর হাল দিন দিন বেহাল হয়ে চলেছে।সামগ্রিক উদাসীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হতাশাও গ্রাস করছে। কেননা নদীর সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে যে পরিমাণে তৎপরতা আমাদের দেখানো উচিত ছিলো সেটা দেখানো যায়নি।সামগ্রিক পরিকল্পনার অভাব আছে।হঠাৎই কিছু লাইন এলো মনের ভিতর।একটু হতাশা থেকে, চিন্তা থেকে।
ভালো থেকো নদী,
আমার আত্রেয়ী
এছাড়া তোমার জন্য আর কি চাইতে পারি!
দিকে দিকে তোমারই যন্ত্রনা কষ্ট হাহাকার
অসহায় আমি, আমরা যাদের হাতে কোন ক্ষমতা নেই
কিন্ত বুক ভরা কষ্ট আছে আর চোখ ভরা জল
তুমিই তো দিয়েছো নদী
আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি
তুমিই দিয়েছো প্রাণ
জীবনের জয়গান আমরা কি দিয়েছি তোমাকে? তোমাদেরকে?
সীমাহীন অবহেলা তোমার সন্তানেরা?
তারা কি ভালোবাসলো তোমাকে?
তারা তর্পন করে।বিয়ে কিংবা শ্রাদ্ধতে তুমি অপরিহার্য পুজা পার্বনেও তোমারই জয়জয়কার
আর আমরা তোমাকে দিয়েছি দূষণ অলংকার জল নিয়েছি শুষে।প্রাণও কি রেখেছি?
তবু তুমি নীরব।
হয়তো অলক্ষ্যে কাঁদো নাকি তোমার অপদার্থ সন্তান দের দেখে হাসো!!
খুব হতাশ লাগে মাঝে মাঝে।জানো!
রোজ সকালে উঠে একথাই বলি রোজ ভালো থেকো নদী আমার আত্রেয়ী,
ভালো থেকো নদী আমার আত্রেয়ী।
তবে এটা ঠিক হতাশা আর মনখারাপের উল্টো পিঠও আছে।নদী সচেতনতায়, নদী রক্ষায় মানুষ কিন্ত জাগছে। বিভিন্ন দিক থেকেই আওয়াজ উঠছে নদীর কষ্ট ও কান্নার।প্রশাসন কোথাও বাধ্য হচ্ছে কোথাও পরিকল্পনা নিচ্ছে নিজেরাই।আমার শেকড় যেখানে আছে সেই বাংলাদেশেও নদী সুরক্ষায় ব্যাপক কর্মতৎপরতা শুরু হয়েছে ।এসব দেখে একটু একটু করে আশা জাগছে যে এই ভাবে পথ চললে আমরা হয়তো আত্রেয়ী কিংবা আমাদের সকল প্রাণের নদীকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবো।আর বেঁচে যাবে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি।