সম্প্রতি সংগ্রিলা দার্জিলিং আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে অংশ নিতে শিলিগুড়িতে গিয়েছিলেন তুহিন শুভ্র মন্ডল । সেখানে চার দেশের বিশিষ্ট জনেরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে উঠে এল নদীর প্রসঙ্গ। চব্বিশ বছর ধরে শিলিগুড়ির প্রধান নদী মহানন্দা দেখছেন তিনি। ফিরে এসে রিভার বাংলা’র পাঠকদের জন্য মহানন্দার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখলেন –
আজ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে মহানন্দা নদীকে দেখছি ।বলা যায় একেবারে কাছ থেকে দেখছি। ভূগোল ও ফলিত ভূগোলের ছাত্র হওয়ায় প্রথমে মূলত: ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম। পরে পরিবেশ বিজ্ঞান আমার বিষয় হিসাবে যুক্ত হওয়ায় নদীকে পরিবেশ কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখতেও শুরু করেছি। চিরকালই বিশ্বাস করেছি নদী শুধু ক্লাসরুমের বিষয় নয়। নদী কেন্দ্রিক অ্যাক্টিভিজমের শুরু সেখান থেকেই। সেটাও আজ প্রায় পনের বছর হতে চললো। পড়াশুনা ও কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গের নদী গুলিকে একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, পাচ্ছি। নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি অন্যান্য নদীর মত মহানন্দার পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে অনেক। কিন্ত এতদিন নদী যে ভালো নেই কে সেদিকে কেউ দৃষ্টিপাত করেনি। বলা ভালো গত কয়েক বছর ধরে নদী ও পরিবেশ কর্মীদের লাগাতার আওয়াজ তোলার ফলে এখন নদী যে ভালো নেই সেই বিষয়টা সামনে এসেছে।
এই লেখাটা একজন নদী ও পরিবেশ কর্মীর দৃষ্টি থেকে। তবু মহানন্দার বিষয়ে কয়েকটি প্রাথমিক কথা বলে নিই। মহানন্দা একটি আন্ত:সীমান্ত নদী।এর উৎপত্তি হিমালয়ে। দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং- এ ২১০০ মিটার উঁচুতে ছিমলির নিকটে পাগলাঝোরা ফলস্- এ মহানন্দা নদীর উৎপত্তি।মহানন্দা নদীর পারে অবস্থিত দুটি প্রধান শহর শিলিগুড়ি আর ইংরেজবাজার (মালদা)। মহানন্দা নদী মহানন্দা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য, শিলিগুড়ি দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জলপাইগুড়ি স্পর্শ করে মহানন্দা প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার কাছে। সেখান থেকে তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর তারপর আবার ভারতে প্রবিবেশ করেছে মহানন্দা। উত্তর দিনাজপুর, বিহারের কিশানগঞ্জ ও কাটিহার হয়ে প্রবেশ করেছে মালদা জেলায়।( এই লেখায় শিলিগুড়ির মহানন্দার সাথে মালদার একটা অংশও থাকবে)।মহানন্দার মোট ৩৬০ কিমি দৈর্ঘ্যের মধ্যে ভারতবর্ষে ৩২৪ কিমি এবং ৩৬ কিমি রয়েছে।
মোট ড্রেনেজ এরিয়া ২০৬০০ বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে ১১৫৩০ বর্গ কিমি ভারতে বাকীটা বাংলাদেশে।এর বাঁদিকের শাখানদী টাঙ্গন, নাগর এবং ডানদিকের শাখানদী মেচি, কঙ্কাই, বালাসন, কালিন্দ্রি। নদীকে এখন আর শুধু ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবকাশ নেই। নদী এখন আলোচনায় বারবার উঠে আসছে দূষণ, দখল ইত্যাদি নিয়ে।মহানন্দাও এর ব্যতিক্রম নয়।
কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদ দেশের সবচাইতে দূষিত নদীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যার মধ্যে অন্যতম মহানন্দা। কেউ যদি শিলিগুড়ির অংশে (মূলত প্রধান নগর, গুরুং বস্তি) মহানন্দা কে দেখেন তাহলে দেখবেন শহরের সমস্ত নোংরা, আবর্জনা যেন মহানন্দাতেই পরেছে।কত ধরণের প্লাস্টিক যে মহানন্দা নদীতে নিত্যদিন মেশে তার ইয়ত্তা নেই।
আরো পড়তে পারেন…
“নদী হারিয়ে যাচ্ছে বলে এ দেশে নজরুল, সুকান্ত ও জসীম উদ্দীনের মতো কবি আর জন্মাবে না”
পরিবেশ বা নদী যদি সুরক্ষিত না থাকে তো কিসের ভোট? প্রশ্ন তুলছেন নতুন ভোটাররা
“কেমন আছো শিলিগুড়ি” নামে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র করতে গিয়ে আরও কাছ থেকে দেখলাম মহানন্দার ভয়াবহ পরিস্থিতি।সকালবেলার প্রাত:কৃত্য, খাটাল ইত্যাদি নদী দূষণের ভয়ংকরতা সামনে আনে। নদীতে জল থাকেনা বর্ষার সময় ছাড়া। কেন জল নেই এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ।এবং সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। শিলিগুড়িতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ন্যাফ।তারা দীর্ঘদিন প্লাস্টিক ও মহানন্দা দূষণ নিয়ে সরব।কিন্ত বর্তমান অবস্থাতে তারাও হতাশ। ভোটপর্ব মিটলেই আবার আন্দোলনে নামবে। মহানন্দা নদীর পাশেই আছে শ্মশান। সেটাও নদী দূষণের কারণ।
কিছুদিন আগে বার কয়েক মালদহের মহানন্দাকেও কাছ থেকে দেখেছি এবং হতাশ হয়েছি। সেখানেও ভয়ংকর অবস্থা।শিলিগুড়ির অংশের মতই ভয়াবহ।এবং আর একটা বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের তাতে কোন হেলদোল দেখছি না।একটা ভাবনাচিন্তা করছি কিছুদিন থেকেই। বেশ কয়েকবার এ নিয়ে জায়গা পরিদর্শন করেছি, শিক্ষক- শিক্ষিকাদের সাথে কথাও বলেছি তা হলো ছাত্র- ছাত্রীদের মাধ্যমে মহানন্দা কেন্দ্রিক সচেতনতা অভিযান ও নদীর কাছে এসো কর্মসূচী। আশা করছি ভোট পর্ব মিটলে এটার কাজও শুরু করতে পারবো। কয়েক বছর আগে মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান নেওয়া হয়েছিলো। তার বর্তমান অবস্থা কি কেউ জানে না। মহানন্দার জল পান করা দূর এখন স্নানেরও অযোগ্য এবং এই মর্মে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। তাই একদম উপরে লিখেছি মহানন্দা মহা আনন্দে আর প্রবাহিত হয় না।ওর আর কোন আনন্দ নেই, শুধুই নিরানন্দ। তাই ব্যাকরণ গত ভাবে ঠিক না হলেও বলতে পারি মহানন্দার নাম পাল্টে এখন নিরানন্দা রাখা হোক। এবং এই মর্মেই ব্যাপক কর্মসূচি নিতে হবে।যাতে কিনা সবার দৃষ্টি মহানন্দার দিকে ফিরে।