আগে যান ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়া।
পাছু পাছু যান গঙ্গা বেণী এলাইয়া।।
মহাকবি কৃত্তিবাস তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী’-তে ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। পৌরাণিক এই কাহিনিসূত্র যদি মানতে হয় তাহলে তো বলতেই হয় অন্তরীক্ষ-প্রবাহিনী সুরধুনী গঙ্গাও চূর্ণীর মতো মানুষের হাতে সৃষ্ট প্রবাহ। এই অভিমত পাশ্চাত্য অনেক নদী বিশেষজ্ঞেরও। মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের প্রধানতম পুরুষ সূর্যবংশীয় রাজা ভগীরথের মতো চূর্ণী-প্রবাহধারার আদি রূপকল্পক দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্রকে ভাবা যেতেই পারে। ভগীরথের ও গঙ্গা-আনয়নবৃত্তান্তের মিথে বরং অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করা যায়। কেননা, মিথের সঙ্গে মিথ্যার একটা যোগসূত্র তো থেকেই যায়। কিন্তু দেওয়ান রঘুনন্দন এক অনিবার্য বাস্তব। ইতিহাসের মানুষ। যার সম্পর্কে পাথুরে প্রমাণের অভাব নেই। সময় বোধহয় দাবি করছে সেই পাথরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রাণকে পুনর্জন্ম দেবার জন্য।
চূর্ণীতীরের জনপদ, জীবন, সংস্কৃতি বা যেকোনো আলোচনায় রঘুনন্দনের উপস্থিতি অনিবার্য। নদীপ্রবাহ খননের কাজটা যে নিছক শিবনিবাস রাজপুরীর সুরক্ষার জন্য হয়নি, সেটা বোঝা যায়। তাহলে রাজপুরীর চারপাশের পরিখা খনন করেই তিনি তাঁর কর্তব্য সীমায়িত রাখতেন। রাখেননি। বরং দশ মাইল দূরে হাঁসখালির নিকটে প্রবাহিত অঞ্জনার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন মাথাভাঙার মূল স্রোতধারা। স্বপ্ন দেখেছিলেন সম্পদের সঞ্চরণশীল প্রবাহপথের। কারণ রাজা হিসেবে নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র যতই প্রজাস্বার্থের ব্যাপারে উদাসীন থাকুন না কেন,’মসিল দিয়ে তশীল’ করার সেই যুগেও দেওয়ান রঘুনন্দনের পক্ষে উদাসীনব্রত উদযাপন সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না একারণেই যে, তিনি নিজেও উঠে এসেছিলেন এক সাধারণ পরিবার থেকে। ফলে আধুনিক অর্থে ‘দেশপ্রেম’ না হলেও মানুষের প্রতি একটা ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধই যে তাঁকে এই উদ্যোগে প্ররোচিত করেছিল, এমন কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। আপন বুদ্ধি-বিবেচনাবোধকে কাজে লাগিয়ে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠলেও মহাকাব্যিক চরিত্রের মানুষটি চিরকালই থেকে গেছেন সাধারণ। জীবনে সাধারণ, স্বভাবে সাধারণ, কিন্তু স্বপ্নে অসাধারণ। উত্থান তাঁর মহাকাব্যের নায়কের মতো,কিন্তু পতন ট্র্যাজেডির নায়কের মতোই বিষাদকরুণ।
দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ (১৭৫২) কাব্যে। কৃষ্ণনগরের রাজসভার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখা হয়,
“কুল্লমালে রঘুনন্দন মিত্র দেয়ান।
তার ভাই রামচন্দ্র রাঘব ধীমান।।”
রঘুনন্দন মিত্র সম্পর্কে এই উল্লেখ থাকলেও বিস্তারিত পরিচয় নেই। ‘অন্নদামঙ্গল’-এর প্রথম মুদ্রিত রূপ প্রকাশিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে, সম্পাদনা করেছেন ড. মদনমোহন গোস্বামী। দেওয়ান রঘুনন্দনের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি ভূমিকায় লিখেছেন,
“রঘুনন্দন মিত্র কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান
ছিলেন। ইনি নবাবের নিকট হইতে
‘মুস্তৌফী’ উপাধি প্রাপ্ত হন হুগলীর
সাতক্রোশ উত্তরে শ্রীপুরে বাস ছিল।”
ড. গোস্বামী সম্পাদিত গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও রঘুনন্দন মিত্র সম্পর্কে দেওয়া তথ্যটি সঠিক নয়। আমাদের এই ভাবনার সমর্থন মিলবে রঘুনন্দন মিত্র মুস্তৌফির উত্তরপুরুষ ও বিশিষ্ট নদীয়া বিশেষজ্ঞ সৃজননাথ মিত্র মুস্তাফি রচিত ‘উলা বীরনগর’ গ্রন্থে। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে
“কোন কোন লোকের ধারণা আছে যে
উলার রঘুনন্দন মিত্র মুস্তৌফী ও
নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান
বিখ্যাত রঘুনন্দন মিত্র একই ব্যক্তি।
ইহা সম্পূর্ণ ভুল। কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান
বিখ্যাত রঘুনন্দন মিত্র বর্দ্ধমান জেলার
চাঁড়ুলগ্রাম নিবাসী ছিলেন।”
দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র ও উলা বীরনগরের মুস্তাফি বংশের রঘুনন্দন যে এক মানুষ নন, তা প্রমাণের বিকল্প কিছু সূত্রও আমাদের স্বপক্ষে রয়েছে। সৃজননাথ তাঁর গ্রন্থে মিত্র মুস্তৌফি রঘুনন্দনের বিস্তারিত পরিচয় দিয়েছেন। সেই পরিচিতিটিই আমাদের সূত্র হতে পারে। রায়়়গুণাকর ভারতচন্দ্র কৃষ্ণনগরের রাজসভার বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, কুল্লমালে রঘুনন্দন মিত্র দেয়ান। বলা যায় ১৭৫২-তে যখন ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচিত হচ্ছে, তখনও মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান হিসেবে রঘুনন্দন মিত্র উপস্থিত। কিন্তু রঘুনন্দন মিত্র মুস্তাফি উলা ত্যাগ করেন ১৭০৭ সালে এবং বসতি স্থাপন করেন হুগলী জেলার শ্রীপুর গ্রামে। তৃতীয়ত, নদীয়া রাজ্যে কৃষ্ণচন্দ্রের অভিষেক ঘটে ১৭২৮-এ।
এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্য দেওয়ান হিসেবে তাঁর কাজ করার কথা অসম্ভব বলেই মনে হয়। চতুর্থত, অভিজাত বশজ রঘুনন্দন মিত্র মৌস্তাফির শেষ জীবন স্বাভাবিক ও মৃত্যুও হয় স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র বর্ধমান রাজার দেওয়ান মানিকচাঁদ, পরবর্তীতে যিনি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ানও হন, তাঁর চক্রান্তে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
এই বিতর্কের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই চূর্ণীর রূপকার দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্রের পরিচয় খুঁজে পেতে উৎসের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনো প্রাচীন গ্রন্থে রঘুনন্দন মিত্র সম্পর্কে ; বিশেষ করে তাঁর পূর্ব জীবন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় না। শেষ মঙ্গলকাব্য হিসেবে পরিচিত বিজয়রাম সেনের ‘তীর্থমঙ্গল’ (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে রচিত) কাব্যে রঘুনন্দনের স্থাপিত মন্দির সম্পর্কিত উল্লেখ রয়েছে মাত্র-
“ডাহিনে থাকিল বারবাজার মাটিয়ারী।
রঘুনন্দন মিত্রের শিব তথা সারি সারি।।
দ্বাদশ শিব মিত্র করেছেন স্থাপন।
তাহা প্রণমিয়া সবে করিলা গমন।।”
এই মাটিয়ারী বর্ধমান জেলার দাঁইহাঁটের কাছে অবস্থিত।মাটিয়ারীর নিকটবর্তী চাণ্ডুলী গ্রামের মানুষ ছিলেন দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র।Dr.K.K.Dutta স্পষ্ট করে লিখেছেন,
” Matiari, a big village situated just
opposite Dainhat , for the images
of Ramsita of Raghunandan Mitra,
the Dewan of Maharaja
Krishsnachandra of Nadia founded
here twelve sivo images.”
(Studies in the History of Bengal
suba)।
বিজয়রামও ‘তীর্থমঙ্গল’-এ তাঁদের যাত্রাপথের বর্ণনায় কাটোয়া শহরকে অতিক্রম করে মাটিয়ারী পৌঁছানোর কথাই লিখেছেন-
“ছয়দণ্ড বেলা হইল কাটোয়া সহরে।
বাহবলি মাঝিগণ চলিল সত্বরে।।”
ফলে সৃজননাথ মিত্র মুস্তাফির বক্তব্যের অনেক কাছাকাছি আমরা পৌঁছে যাই। অর্থাৎ দাঁইহাঁটের কাছাকাছি রঘুনন্দনের মাটির টান ছিল। আর সেজন্যই স্বদেশে নিজের শিকড় খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন তিনিএবং তীর্থমঙ্গল-এর সূত্র ধরে বর্ধমানের সঙ্গে রঘুনন্দনের সম্পর্ক-নির্ধারণ করাটা কতটা নির্ভরযোগ্য-এ প্রশ্ন তোলার অবকাশও বড়ো কম। বিশেষ করে গ্রন্থটি সম্পর্কে যখন নগেন্দ্রনাথ বসু সিদ্ধান্ত বারিধির মতো মানুষ লেখেন, গ্রন্থটি অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাসের একটি উপাদেয় অধ্যায়।
একইরকম কথা বলেছেন Dr. K.K.Dutta তাঁর লেখা ‘Alivardy and His Times’ গ্রন্থে,
“It is a Contemporary work on travels
of much historical value.”
ফলে আমাদের নিশ্চিত সিদ্ধান্ত দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র ছিলেন বর্ধমানের দাইহাটের নিকটবর্তী চাণ্ডুলী গ্রামের মানুষ। শিবনিবাস অঞ্চলের লোকপ্রবাদে তিনি ‘রাঢ়ের রঘুনন্দনা’ হিসেবে আজও স্মরণীয়।
আধুনিককালে দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র সম্পর্কে ‘ক্ষিতীশবংশাবলী চরিত’ রচয়িতা দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় ও ‘নদীয়া কাহিনি’-র লেখক সুখ্যাত কুমুদনাথ মল্লিক কিছু কথা বললেও তাঁর জীবনের পূর্বকাহিনির কোনো পরিচয় সেখানে নেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর অন্যতম গদ্যলেখক রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং'(১৮১১) গ্রন্থে শিবনিবাস নগর পত্তনের জন্য যে ‘পাত্র’ কে রাজা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি যে দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র– এবিষয়ে আমাদের সন্দেহ নেই। একটু বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কালিকিঙ্কর দে রচিত ‘দুই শতাব্দী পূর্বে নদী পরিবহনে কৃতিত্ব’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে, যা প্রকাশিত হয় ‘বসুমতী’ ( কার্তিক, ১৩৬১) পত্রিকার পাতায়। তাঁর আলোচনা থেকে এই সত্যটুকু বোঝা যায়, রঘুনন্দনের পূর্বপুরুষ হুগলি জেলার কোন্নগরের মানুষ। পরে এঁরা বসতি স্থাপন করেন বর্ধমান জেলার চাণ্ডুলি গ্রামে। মধ্যবিত্ত পরিবারের রঘুনন্দন অল্পবয়সেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অধীনে অত্যন্ত সাধারণ চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৪০ সালে আলীবর্দী খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করার পর বারো লক্ষ টাকা নজরানার দাবিতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে অবরোধ করলে সামান্য কর্মচারী রঘুনন্দন মিত্রের একমাত্র উদ্যোগে তিনি কারামুক্ত হন। এরপরই কৃষ্ণনগর রাজসভায় রঘুনন্দনের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। রঘুনন্দন দেওয়ান নিযুক্ত হন শুধু নয়, হয়ে ওঠেন সর্বক্ষমতাসম্পন্ন দেওয়ান। তাঁর বুদ্ধি ও পরিশ্রমের ফলে নদীয়া রাজ্যের আয় বাড়ে।
কিন্তু ১৭৪২ সালেই শুরু হয় বঙ্গে বর্গীর হামলা। রাজপরিবার ও তাঁদের ধনৈশ্বর্য সুরক্ষিত রাখার জন্য দেওয়ানের পরামর্শে শিবনিবাসে তৈরি হয় নদীয়ারাজের নতুন রাজধানী। এই রাজধানী স্থাপন ও তাকে নিরাপত্তা দিতে চূর্ণীর প্রবাহপথ তৈরির ইতিহাস আমরা আলোচনা করেছি।* শুধু বলার পুরী হিসেবে শিবনিবাস যে কত উন্নত ছিল, সেকথা উল্লেখ করেছেন হেবার। আর ” দুই লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া এই শিবনিবাসেই অগ্নিহোত্র বাজপেয় যজ্ঞ সমাপ্ত হইল এবং এই শিবনিবাস নগরীর পাদমূলে ভগীরথের মতো তিনি [ রঘুনন্দন মিত্র ] বহতা নদী আনিয়াছিলেন”– লিখেছেন কালিকিঙ্কর দে। এই সূত্র ধরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র চূর্ণী প্রবাহপথের রূপকল্পক ও রূপকার।
চূর্ণীপ্রবাহপথের এই রূপকারে জীবনের শেষদিন কিন্তু কোনোভাবেই মর্যাদার ছিল না। একটা ঘৃণ্য চক্রান্তের মধ্য দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। শুধু প্রাণে নয় সম্মানেও তাঁকে নামানো হয় অনেক নীচে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় রঘুনন্দন মিত্রের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল, সেই মহারাজার পুত্র ছিলেন এই চক্রান্তের অংশভাক্। ইতিহাসের সেই ট্রাজিক অধ্যায়টি আপাতত তোলা থাক পরের অংশের জন্য।
চূর্ণী নদীর সৃষ্টি ও রঘুনন্দন মিত্রের ভূমিকা জানতে এই লিংকটি রইল।
চূর্ণীকথা : একটি নদীপ্রবাহের উৎসের খোঁজে – গৌতম অধিকারী
আরো পড়ুন…
ইরাবতী নদীর উপর বাঁধ দিচ্ছে ভারত
দর্শনে নদীর নিত্যতা
পেশা সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। নেশা সাহিত্য সংগঠক। ‘গল্পদেশ’ ত্রৈমাসিক সম্পাদনা।
এছাড়া সম্পাদিত গ্রন্থ : সুলেখা সান্যাল রচনাসমগ্র, গল্প সংগ্রহ : স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, রামায়ণ বিচার : অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।
গবেষণা পত্রিকা ‘কথারূপ’-এর সম্পাদক।