জয়া ফারহানা>>
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা যত ব্যস্ত, তার চেয়েও বেশি ব্যস্ত তাদের পারিষদবর্গ। তারা জানেন, পরিবেশকর্মী প্রেসার গ্রুপের দাবি মোতাবেক নদী-বন-পাহাড় রক্ষায় ইশতেহারে যত ভালো কথাই লেখা থাক, ইশতেহারের আদর্শ প্রতিশ্রুতিগুলো ফাইলবন্দিই থাকবে। এমপি সাহেবকে নানা কায়দায় তোয়াজের মাধ্যমে যিনি সাইজ করতে পারবেন, এলাকার বন-নদী-পাহাড়-টিলা-খাল-বিল চলবে তারই ইশারায়, নির্দেশমাফিক। তোষামোদিতে যিনি ফার্স্ট হবেন, বাস্তবে পূরণ হবে তার খায়েশ। এরাই আমাদের নদীগুলোর বালু তুলে তুলে এগুলোকে এমন ব্যথা দিয়েছে যে, এখন হাতে আর এমন কোনো প্যারাসিটামল নেই, যা নদীর ব্যথা দূর করতে পারে।
ভৈরব, রূপসা, কপোতাক্ষ, ইছামতি, মাথাভাঙা, কুমার, নবগঙ্গা, চিত্রা ও বেতনার মতো নদীগুলো ছিল বিশাল। এখন সেগুলোর কোনোটিই আর বড় নদীর সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। ইচ্ছামাফিক বাঁক-খাত-স্রোত পরিবর্তন করিয়ে দেওয়ার কারণে কোনো নদীই আর স্বাভাবিক প্রবাহে নেই। বন্যার সময় আমরা দেখি, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং রাজনৈতিক নেতারা কীভাবে মিলেমিশে নদীর জন্য হন্তারক হয়ে ওঠেন।
পুনর্ভবা, আত্রাই, করতোয়া- এই তিন নদীর মিলিত স্রোতের কারণে যে নদীর নাম হয়েছিল তিস্তা, সেই তিস্তার দিকে আজ আর তাকানো যায় না। রেনেল ও ডেল ওভিলের মানচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, নদীখেকোরা কীভাবে নদীগুলো খেয়ে ফেলেছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার মাত্রা এখন বেশি। ভূমিক্ষয়ের কারণে হোক আর ভূমিধসের কারণে হোক, কোনো নদীই এখন আর খরস্রোতা নেই। কমেছে গতিমাত্রা, কমেছে বেগ, কমেছে প্রবাহ। বাংলাদেশের নদীগুলোর জলপ্রবাহ, গতিপ্রকৃতি, স্বভাবচরিত্র বৈচিত্র্যময়। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে, ভিন্ন ভিন্ন আচরণে অভ্যস্ত নদীগুলো। একেক ঋতুতে একেক রকম জীব-বৈচিত্র্যের সমাহার দেখা যায় তাদের তীরে।
আরো পড়তে পারেন….
তাড়াইলে “রিভার বাংলা নদী সভা” কমিটি গঠন
দুই. ৩০ কোটি বছর আগে কার্বোনিফেরাস যুগের শুরুতে ভারতবর্ষ ছিল দক্ষিণ মেরুর কাছে। মার্কিন বিজ্ঞানী ব্রুস হিজিন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, দশ কোটি বছর ধরে আমাদের পরিচিত এই প্রাচ্যভূমি ৩৭শ’ মাইল উত্তরে ক্রমাগত সরেছে। এভাবে উত্তরে সরতে সরতে সাড়ে চার কোটি বছর আগে আঙ্গারা ভূখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জন্ম হয়েছিল হিমালয়ের। আর হিমালয় থেকে জন্ম নিয়েছে আমাদের প্রিয় নদীগুলো। যে নদী প্রতি বছর আড়াই কোটি বিলিয়ন টন পলি বহন করে জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের। নদীর গর্ভ থেকে জন্ম হওয়ায় নদীমাতৃক বাংলাদেশ। ‘এত জানে তবু নদী কথা বলে না’- বহুল বিখ্যাত এই ধারণা, যা থেকে জন্ম নিয়েছে কত গান, কত কবিতা; সেসব তো আর অকারণে হয়নি। এক ফোঁটা ভূমি নিয়ে কত যুদ্ধ, কত রক্তপাত! আদালতগুলো মামলার পাহাড়ে রূপান্তরিত হওয়ার প্রধান কারণ ভূমি সংক্রান্ত নালিশ-অভিযোগ। ৯০ শতাংশ মামলাই ভূমি নিয়ে। দলিল, পরচা, নকল, নথির একপাতা হারিয়েছে কি হারায়নি, ভূমি মালিকরা ভূমি অফিসের বারান্দায় নির্ঘুম দিনরাত পার করেন। অথচ ভূমির প্রাণ নদীর দলিল-পরচা নকল নদী নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। নদীকে যে বাড়ি বয়ে আনা যায় না। ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির ওপর যে জাতির এত লোভ, সে জাতির কাছে নদী ভালো থাকে না। চিরকাল শুনে এসেছি, জলধারাই বাংলার প্রাণশক্তি। এখানে নদীর সঙ্গে নদী হয়ে মিশে আছে সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি। জলের আশ্রয় এমন শক্তিমান, জল এমন স্নেহবতী যে, এখানে একলা ভেলা ভাসিয়ে বিজয়ী হয়ে ঘরে ফিরতে পারে বেহুলা। বাংলাদেশের সব নদী হাওরের সঙ্গে যুক্ত নয়; কিন্তু সব হাওরই নদীর সঙ্গে যুক্ত। আমরা পেয়েছি প্রায় ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের হাওরাঞ্চল। ছোট-বড় মিলিয়ে দুইশ’ হাওর। জল চলাচলের প্রাকৃতিক বিন্যাস বাধা পাচ্ছে হাওরেও। এই আশ্চর্য ঐশ্বর্যের অভিনব জলাধার হাওর নিয়েই-বা কী পরিকল্পনা আছে হাওরাঞ্চলের সংসদীয় নেতাদের? শীতে হাওরের জল শুকিয়ে গেলে শ্যাওলাপড়া এই জলজ ভূমিতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে পরিযায়ী পাখির দল। শ্যাওলার মধ্যে জমে থাকা সামুদ্রিক কেঁচো, কীট, ফিতা পোকা, কাদায় আটকানো ঝিনুক, শামুক, কচুরিপানায় আটকে থাকা মাছ এদের খাবার। আর বালিহাঁস, রাজহাঁস, পাতারিহাঁস তো আছেই। সব মিলিয়ে জলাভূমিগুলো আমাদের আরেক ঐশ্বর্য। এই হাওরাঞ্চল থেকে যে সাংসদরা নির্বাচিত হবেন, তাদের কি বিশেষ কোনো ভাবনা আছে জলাভূমির প্রাকৃতিক চক্র রক্ষা করার? জানতে চাই।
তিন, পাহাড়গুলো নিজেদের স্বার্থে কেটে সাফ করে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে পাহাড়খাদকরা। কোন অ্যান্টিবায়োটিকে যে পর্বতগুলো ঠিক হবে, তা পর্বতের ডাক্তাররাই জানেন। অনেকে বলেন, আমাদের পাহাড়গুলো নাকি পাহাড় নয়, পর্বত তো নয়ই, টিলামাত্র। হোক টিলা, এরাই আমাদের কাছে পর্বত মর্যাদার। এই পর্বতগুলোকে ঘিরে, নাফ নদকে ঘিরে তিন পার্বত্য জেলায় তৈরি হয়েছে ভিন্নতর আরেক প্রাকৃতিক পরিবেশ। সর্বনাশা চিংড়ি চাষে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হওয়ার, তাতো হয়েছেই। প্রায় একই রকম ক্ষতি হয়েছে নাফের লোনা জল ঘেঁষে থাকা ম্যানগ্রোভ বনেরও। ওই অঞ্চলের লুটেরারা লুট করেছে বন, দখল করেছে সরকারি খাস জমি আর নদী। ঠেকানোর প্রধান দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের। সে দায়িত্ব পালনে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে এদের কেউ কি মনোনয়ন পাবেন? জানতে চাই।
চার. কোন দল ইশতেহারে পরিবেশ নিয়ে কত গালভরা প্রতিশ্রুতির কথা লিখল, তা দেখেই যদি পরিবেশবোদ্ধারা সন্তুষ্ট থাকেন, তাহলে আমাদের ভরন্ত নদীগুলোর ভারানি, দোয়ানি, একানিতে পরিণত হওয়া ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। আমাদের মোহনার বিস্তৃত জলরাশির যে নাব্য, যে লাবণ্য, তা অতীত থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ে পরিণত হওয়াও কেউ রোধ করতে পারবে না। গা ছমছম করা জঙ্গলও আর কোনোদিন ফেরত পাব না আমরা।
পাঁচ. বিপুলা এ পৃথিবী। বয়সও খুব কম নয়। ৪৬০ কোটি বছর। ৪৬০ কোটি বছর আগের শিশু পৃথিবীর উত্তাপ ছিল একশ’ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। পানি তখন বাষ্প হয়ে ঘন মেঘের আবরণে নিরাপত্তা দিত সেই শিশুকে। দুইশ’ কোটি বছর আগে যখন দ্বীপের মতো প্রথম ডাঙা সৃষ্টি হয়, তা কিন্তু জেগে উঠেছিল মহাসমুদ্রের মাঝখান থেকেই। জল সৃষ্টি হয়েছিল বলেই এই পৃথিবী মানুষ বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে। আজকের সাতটি মহাদেশ ৩৮ কোটি বছর আগে ছিল একটিমাত্র মহাদেশ। ২৩ কোটি বছর আগে এই একটি মহাদেশ ভেঙে সাতটি মহাদেশে পরিণত হয়। আজকের স্থলভাগের অবস্থান তৈরি হয়েছিল প্লাইটোসিন যুগে, ১৫ লাখ বছর আগে। এর আগে সমগ্র স্থলভাগ ঘিরে ছিল নীল সমুদ্র প্যানথালসি। গবেষকরা জানাচ্ছেন, জলই চিরদিন রক্ষা করে এসেছে স্থলভাগকে। পৃথিবীর সেই শিশুকাল থেকে। অতএব, জলকে অবহেলা করে স্থলভাগকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। বাইরের শত্রু আর কী ক্ষতি করবে আমাদের? নিজেদের বোকামি ও অজ্ঞতার কারণেই উদ্বাস্তু হবো আমরা। শিশু পৃথিবীর কথা আপাতত না ভাবলেও চলছে; কিন্তু বুড়ো পৃথিবীর ভাবনা না ভেবে আমাদের উপায় নেই নিজেদের স্বার্থে। যে কারণে পরিবেশ বিষয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে কোন দল কী ভাবছে, তা আমাদের নজরে রাখা দরকার। তারও চেয়ে বেশি দরকার নির্বাচিত দল ইশতেহার অনুযায়ী কাজ করল কিনা, আগামী পাঁচ বছর তা নজরে রাখা।
জয়া ফারহানা : কলাম লেখক। সূত্র : সমকাল।মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর ২০১৮।