।। রিভার বাংলা ডট কম ।।
চয়ন চৌধুরী, সিলেট থেকে>>>
সিলেটের প্রাণ সুরমা নদীকে খুবলে খাচ্ছে বালুখেকোরা।
অথচ এই নদী সিলেট শহরকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই অংশে ভাগ করায় এটি কেবল পরিবেশ ও যোগাযোগবান্ধব নয়, সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। যদিও এই দিকগুলোর সুব্যবহার না করে দখল-দূষণের পাশাপাশি অবৈধভাবে যথেচ্ছ বালু উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে এ নদীকে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। সিলেট শহর ও সংলগ্ন এলাকাকে সংযুক্ত করতে সুরমা নদীতে পাঁচটি সেতু রয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ সেতুগুলোর আশপাশ থেকেই অবাধে বালু তোলা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের জাদুকাটা ও হবিগঞ্জের খোয়াই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার প্রতিযোগিতা চলছে বহুদিন ধরে।
আদালত রায় দিয়েছেন, জাদুকাটা নদী থেকে ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে বালু তোলা বন্ধ করতে হবে। সে রায় মানছে না কেউ। মৌলভীবাজারের ছয়টি উপজেলার পাহাড়ি ছড়া-খাল থেকে বালু তোলার ওপরেও আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় এ নিষেধাজ্ঞাও কোনো কাজে আসছে না।
সিলেট বিভাগজুড়েই এভাবে অবাধে নদী-ছড়া-খাল খুবলে খাচ্ছে বালুখেকো চক্র। ফলে নদীভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে। এতে পরিবেশগত সংকট দেখা দিচ্ছে। এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও আদালতে দাঁড় করিয়েছেন পরিবেশ আন্দোলনকারীরা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, উচ্চ আদালতের রায় কার্যকরেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সুরমা নদীর ওপর নির্মিত শাহজালাল সেতু থেকে শুরু করে সদর উপজেলার শাহপরান সেতু পর্যন্ত নদীর দুই তীরে অর্ধশতাধিক স্পটে বালু তোলার যন্ত্র বসানো রয়েছে। স্থানীয়রা জানালেন, ‘ঝামেলা এড়াতে’ দিনের বদলে এসব স্পটে রাতের আঁধারে বালু তোলা হয়। সুরমা নদীর উত্তর পারে নগরীর মেন্দিবাগ থেকে শুরু করে কুশিখাট নয়াবাজার, মীরের চক, মুক্তির চক, মুরাদপুর ও পীরের চক এলাকার বিভিন্ন স্থানে বালু তুলে লাখ লাখ বর্গফুট উঁচু ঢিবি করে রাখা হয়েছে।
মুক্তির চক গ্রামের নদীতীরের বাসিন্দা আবদুল হক জানিয়েছেন, ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে প্রায় প্রতিদিন নদী থেকে বালু তোলা হয়। রানা নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ড্রেজারের সাহায্যে তারা বালু তুলছেন বলে জানিয়েছেন মুক্তির চক নদীতীরে রাখা ড্রেজারের এক শ্রমিক। তিনি জানিয়েছেন, বালু উত্তোলনের পর পাইপ দিয়ে তা নদীতীরের নির্ধারিত স্থানে রাখা তাদের কাজ।
অারো পড়ুন…
বিশ্ব নদী দিবসে রিভার বাংলা’র আয়োজনে কিশোরগঞ্জে নদীর জন্য পদযাত্রা অনুষ্ঠিত
বিশ্ব নদী দিবস: নদীর ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে হবে
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার জানান, সিলেট বিভাগের চার জেলার পাঁচটি নদীর দখল, দূষণসহ সার্বিক বিষয়ে তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। সিলেট ও সুনামগঞ্জে সুরমা, মৌলভীবাজারের ধলাই এবং হবিগঞ্জে সুতাং, সুনাই ও খোয়াই নদী নিয়ে বেলা কাজ করছে বলে জানান তিনি।
অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সুরমা নদীর দক্ষিণ সুরমা অংশে কুচাই এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে বেলার পক্ষ থেকে রিট করা হয়েছিল।
২০১৬ সালে বেলার এই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পরিবেশগত সমীক্ষার পর সুরমা নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ তা বন্ধ হয়নি। এতে দুই তীরের জনপদে ভাঙন ধরার আশঙ্কা রয়েছে। নদীর ওপর নির্মিত সেতুগুলোও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
সিলেট বিভাগে শতাধিক বালুমহাল রয়েছে। তবে এগুলোর বেশিরভাগই আইনি জটিলতায় নিয়মিত ইজারা দেওয়া সম্ভব হয় না। ইজারা নিয়ে প্রভাবশালী চক্র এগুলো আইনের মারপ্যাঁচে বছরের পর বছর ধরে দখল করে রাখছে। ইজারা গ্রহীতাদের অনেকেই নির্ধারিত স্পটের বাইরে থেকেও অবৈধভাবে বালু তুলছেন। নদী থেকে বালু তোলার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যার সুযোগে বালুখেকোরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, অবৈধভাবে বালু তোলা হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, সিলেট জেলায় ৩৫টি বালুমহালের মধ্যে বর্তমানে ১১টি ইজারায় রয়েছে। আরও ৪-৫টি ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়াধীন। বাকিগুলো ইজারা দেওয়া- এরকম বলা হলেও সিংহভাগের ক্ষেত্রেই মামলা-সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন জানিয়েছেন, বালুমহাল বা নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি মূলত জেলা বা উপজেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করে। তার পরও কেউ অভিযোগ করলে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
আলতাফ হোসেন বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বালু উত্তোলকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে অভিযুক্তরা খুব অল্প সাজায় পার পেয়ে যায় জানিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার সুযোগ থাকে। তবে জনবল সংকটের জন্য তাদের পক্ষে সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন বলে দাবি করেন তিনি। সূত্র: সমকাল।প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮।।