কিশোরগঞ্জ শহর থেকে আনুমানিক ১৫ কিলোমিটার দূরেই ব্রহ্মপুত্র নদ। ছেলেবেলায় নরসুন্দায় সাঁতার কাটতে কাটতেই একবার মনে হলো যাই না একবার ব্রহ্মপুত্র নদ দেখে আসি। সাইকেলে চড়ে ক’জন বন্ধু চলে গেলাম হোসেনপুর। ব্রহ্মপুত্র স্বচক্ষে দেখলাম। প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্রের বিশালতা দেখে অবাক হলাম। এর বিশালতা, ঢেওয়ের গর্জন এবং বড় বড় নৌকা দেখে চমকিত হয়েছিলাম। ছেলেবেলায় এটা ছিল আমাদের জন্য এক কৌতুহলি অভিযান ও নতুন অভিজ্ঞতা।
সেদিন ব্রহ্মপুত্রের বিশালতা দেখে মনটাও যেন একলাফে বড় ও বিশাল হয়ে উঠেছিল। এখন পরিণত বয়সে এসেও সেই নদের স্বপ্ন দেখি। এখনো কল্পনা করি নরসুন্দা নদীপথে আমরা আবার হোসেনপুরে ব্রহ্মপুত্র নদে যাব। আমাদের পূর্ব পুরুষ যেমনটি গিয়েছেন। আমরা নদী পথে করিমগঞ্জ হয়ে কিশোরগঞ্জ শহর হতে চামড়া বন্দরে চলে যাব। নরসুন্দায় নৌকা ভাসিয়ে চলে যাব তাড়াইল বাজারে। কিশোরগঞ্জ হতে নদীপথে চলে যাব ধুলদিয়া হয়ে নিকলী, অস্টগ্রামসহ হাওরের অন্যান্য অঞ্চলে। আধুনিকতায়নের মানে নদীরও আধুনিকায়ন; মেরে ফেলা নয় নিশ্চয়?
আমার কথাগুলো অনেকের কাছে স্বপ্নের মত মনে হতে পারে। কিন্তু না- এটা একেবারেই আজগুবি স্বপ্ন বা কল্পনার কথা নয়। আমার শতভাগ বিশ্বাস, যদি স্বচ্ছতা ও সততার সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়- তাহলে তাই বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিভাত হবে।
একসময় শহরের মণিপুরিঘাট ও পুরাণথানা ঘাটে বড় বড় বাণিজ্যিক নৌকা ভিড়তো। বড় বাজারের রায় মহাশয়, রহমান বেপারি, নবদ্বীপ সাহা, গাজী মিয়া, আক্কাস বেপারি, ছফিরউদ্দিন বেপারিসহ বড় বড় ব্যবসায়ীদের মালামাল সবই পরিবহণ করা হতো নৌকায়। ভৈরব, তাড়াইল, নিকলী,ধুলদিয়া, বাজিতপুর, ইটনার হাওর থেকে ব্যবসায়ীদের নৌকা আসতো নদী পথে। জেলার বাইরে থেকে যেমন পাবনা, বরিশাল, ইশ্বরদি, বর্মী, নরসিংদী, আজমিরিগঞ্জ, সিলেটসহ বেপারিদের বাণিজ্যিক নৌকাগুলো চলাচল করতো নরসুন্দা দিয়ে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সড়ক পথের উন্নয়নও প্রয়োজন। তবে কেবলমাত্র বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার নামে আধুনিকায়ন কাম্য নয়। আধুনিকতার মানে এমন তো হতে পারে না- নিজের অস্থিত্বকে বিলুপ্ত করে দেয়া।
অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণের নামে নদীর স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করা হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাকে ব্যবচ্ছেদ করা, ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার মত বোকামি কী কাম্য হতে পারে? নদী পথে সহজে ও সাশ্রয়ী মূল্যে পরিবহণের পথটি আমরা রুদ্ধ করবো কেন? শুধুই একশ্রেণির ব্যবসায়ীরর স্বার্থে? আমরা উন্নয়ন চাই, আধুনিকায়ন অবশ্যই চাই। তবে আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশ ও ভুগোলকে ধ্বংস করে নয়। যথেচ্ছভাবে যারা এ কাজটি করছে তারা আসলে দায়িত্বশীল নয়। এবং এটাই সত্য তারা সাধারণ মানুষের বন্ধুও নয়।
আগে নরসুন্দায় শীতের সময়ও পানি থাকতো। একপাশে ভেসে উঠতো বালুচর। সেই বালুচরে বন্ধুরা সবাই মারবেল খেলতাম। আবার কখনো ছোট ডিংগী নৌকায় চড়ে শখ করে মাছ ধরতাম। আমার এক ভাই ছিলেন। তাঁর নাম আবদুল গনি। তিনি মাছ শিকারে খুবই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। রাতেরবেলায় তিনি নৌকায় চড়ে হ্যাজাকবাতি জ্বালিয়ে উড়ন্তজাল দিয়ে মাছ ধরতেন। সেসময় নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। গনি ভাইয়ের মত আরো অনেককেই সেসময় মাছ ধরতে দেখা যেত। জেলেরা ছাড়াও গনি ভাইয়ের মত অনেকেই সখের শিকারি ছিলেন। তখনকার পরিবেশটাও অন্যরকম ছিল। মানুষের মধ্যে এত আধুনিকতা ও চাকচিক্য ছিলনা। সাদাসিদে জীবন যাপনেই অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্থ ছিল। শহরে জনসংখ্যাও কম ছিল। ফলে সকলের মধ্যে প্রায় জানাশোনা ছিল। সবাই প্রায় মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসতেন।
ছেলেবেলায় গৌরাঙ্গ বাজারের জ্ঞানাদাসুন্দরী ব্রীজের উপর থেকে নদীতে লাফিয়ে সাঁতার কাটতাম। এখনো নরসুন্দার পাড়ে গেলে শৈশব-কৈশোরের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনে পড়ে বর্ষায় জলের টলমল রূপ। জলেভাসা শাপলা-শালুকসহ নানা ফুল ও গুল্মোভরা ছলছল জল। জলের ভেতর নানা প্রজাতির মাছের খেলা করা। এখন জল নেই, জল শূণ্য নদী দূষিত বর্জ্যে ভরে গেছে। গত পাঁচ দশকে নদীর অস্থিত্বকে শেষ করে দেয়া হয়েছে।
আমি নিজের চোখে দেখেছি, রথখোলা মাঠের উত্তরে ঈসা খাঁ সড়কের নদীর ধার ঘেঁষে তখন কোনো দোকান ছিলনা। বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের সড়কের নদী ঘেঁষেও কোনো দোকান বা স্থাপনা ছিলনা। এদুুটো স্থানেই শত শত যাত্রীবাহী নৌকা নোঙর ফেলত। হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা ও ঝুলনযাত্রার সময় পাল তোলা নৌকার বহর বেড়ে যেত। তখন ঘাটে ঘাটে নৌকা শোভা পেত। তৎকালে এখানে ঝুলনযাত্রা খুব জমজমাট, সপ্তাহব্যাপী ও সারারাত ধরে চলত। হাওরের মানুষ বজরা নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে আসা-যাওয়া করতেন। এসব নৌকার মধ্যে অনেকসময় সুন্দর সুন্দর নৌকাও দেখা যেত। নৌকাগুলো কারুময়, শিল্পীর আঁকা ছবিতে বৈচিত্রপূর্ণ থাকতো। বাহারি ও শৈল্পিক নৌকাগুলো সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। আমার মনে পড়ে তৎকালে রথখলায় সার্কাস দলের মাসব্যাপী সার্কাস খুবই জনপ্রিয় ছিল। সার্কাস দলের নারী-পুরুষদের শারীরিক কসরত ও ক্রীড়া নৈপুন্য আমাদের মুগ্ধ করতো। দলে একজন জোকার থাকতেন। তিনি নানা অংগ-ভংগীতে দর্শকদের মাতিয়ে তুলতেন। সার্কাস দলের সাথে থাকতো জীবন্ত বাঘ ও হাতি। এসব প্রত্যক্ষ করে আমরা আন্দোলিত ও একইসাথে আনন্দিত হতাম। রথখলায় বছরে অন্তত একবার যাত্রাপালা হতো। সারারাত ধরে চলতো যাত্রাপালা। সাধারণ মানুষ যাত্রাপালা মন্ত্রমুগ্ধের মত উপভোগ করতেন। নরসুন্দা নদীপথেই সার্কাস ও যাত্রাদলের আসা-যাওয়া ছিল।
একরামপুর রেলওয়ে ব্রীজের দু’পাশেও প্রচুর নৌকা নোঙর করতে দেখা যেত। নদীপথেই যাতায়ত এবং অধিকাংশ মালামাল পরিবহণ করা হতো। তখন এত উন্নত সড়ক পথও ছিল না এবং যানবাহনও ছিল না। তখন মানুষের প্রয়োজনে যাতায়তের সুবিধার্থে নদী খনন করে নেওয়া হতো। কারণ নদীই ছিল সাশ্রয়ী ও সহজ মাধ্যম। পুরানথানা বাজার থেকে নরসুন্দা নদীর বাঁক যেটি মণিপুরি ঘাট হয়ে উথারিয়া বিলের সাথে মিশেছে এর মধ্যে মণিপুরি ঘাট পর্যন্ত অংশটি কাটাখাল নামে পরিচিত ছিল। একটি সূত্রমতে, তৎকালীন প্রামাণিক বাড়ির নন্দকিশোর প্রামাণিক তাঁর অমর কীর্তি একুশ রত্ন ভবনের উদ্বোধন ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময় যে বিরাট সমারোহের আয়োজন করেছিলেন,তার জন্যে দূর-দূরান্তের অতিথিদের আগমনের সুবিধার্থে এ খালটি খনন করেছিলেন। আর একটি মত হচ্ছে, জঙ্গলবাড়ি ও জাফ্রাবাদের জমিদারদের নৌবহরের প্রধান ঘাটি ও রাজস্ব আদায়ের প্রধান কার্যালয় ছিল বর্তমান ধুলদিয়া বা সহস্রাম এলাকায়। কিন্তু জঙ্গলবাড়ির সাথে ধুলদিয়ার জলপথে সহজ কোনো পথ না থাকায় ওই দেওয়ানরাই তাদের সুবিধার্থে পুরানথানা বাঁক থেকে মণিপুরি ঘাট পর্যন্ত নরসুন্দার খনন কাজটি সম্পন্ন করেন।
ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানাযায়, ১৮০০ শতকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ প্রজাসাধারণের অবস্থা সরেজমিন দেখার জন্য ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে দুলু বাজারে এসে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। দুলু বাজারই পরে তাঁর নামানুসারে হোসেনপুর বাজার নাম ধারণ করে। তখন বাজারটি ছিল এতদঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ বাজার। ব্রহ্মপুত্র হয়ে এখানে দেশি-বিদেশি বণিকদের আগমন ঘটতো। এরাই বাণিজ্যবহর নিয়ে নরসুন্দা নদীপথে কিশোরগঞ্জ পাড়ি জমাতেন।
যতদূর জানাযায়, একইসময় মেঘনা পাড়ের উলুকান্দি বিটঘরের দেওয়ান ভৈরব চন্দ্রের নামানুসারে ভৈরব বাজার প্রতিষ্টা পায় এবং ক্রমেই তা বন্দরে রূপ লাভ করে। তখন ভৈরবে পন্যসামগ্রী পরিবহণেও নরসুন্দা নদী ব্যবহৃত হতো।
জানাযায়, হাওরের বিশাল এলাকা, বৃহৎ বাজার হোসেনপুর, বন্দর নগরী ভৈরব, তাড়াইল, নিকলীসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর যাতায়ত ও পন্যসামগ্রী পরিবহণের মাধ্যম ছিল কিশোরগঞ্জের প্রবাহমান নরসুন্দা নদী। তৎকালে নরসুন্দা ছিল উল্লেখিত বিশাল অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌ-ট্রানজিট পয়েন্ট।
জানাযায়, বারভুঁইয়া প্রধান বীর ঈসা খাঁর বজরা জঙ্গলবাড়ির দূর্গে যাতায়ত করতো এই নরসুন্দা নদী দিয়ে। ইতিহাস বলে, নদীকে কেন্দ্র করে বন্দর, নগর, জনপদ গড়ে উঠে। দেশে দেশে বাণিজ্যতরী নিয়ে বণিকেরা আসে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের অনেকেই মায়ার বাঁধনে সেখানেই গড়ে তোলে নিজেদের বসতি। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর কীর্তিমানদের জনপদ বর্তমান কিশোরগঞ্জ এমনি করে সৃজিত হয়েছে বহতা নরসুন্দাকে কেন্দ্র করেই।
একসময় হয়বতনগরের দেওয়ান পরিবার (ঈশাখাঁর উত্তরসুরি) ও বত্রিশের প্রামাণিক পরিবারের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হয়েছে আমাদের কিশোরগঞ্জ। একটি জনপদের সৃজন, সম্প্রসারণ ও বিকশিত হওয়ার পেছনে উল্লেখযোগ্য অবদান যে নদী ; ঐতিহ্যের স্মারক নরসুন্দা, সেই প্রাণ প্রবাহকেই আমরা অযত্ন- অবহেলায় ধ্বংস করেছি। স্থানে স্থানে বাঁধ-বেড়িবাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহকে আমরা রুদ্ধ করেছি। অবৈধভাবে দখল করেছি নদীকে। আজকের প্রজন্ম প্রবাহমান নরসুন্দাকে দেখে নাই। তারা গতিকে ভালোবাসে। তাই তারা সড়কপথে লংড্রাইভে যায়। কিন্তু যদি নদীর গতিকে রুদ্ধ করা না হতো- তাহলে দ্রুতগতির নৌযানও চলতো নদীতে। তখন মোহনীয় নদী, স্থানে স্থানে ঘাট, ঘাটে ঘাটে নোঙর করা শৈল্পিক কারুময় বাহারি নৌযান এবং নদীজলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম না। বাঙালির যে রোমান্টিকতা ও কবিয়াল ভাবনা তার জন্যও তো দরকার নদীর।
আমার ভাবতেও অবাক লাগে, যে নদীকে ঘিরে সভ্যতা তৈরি হয়, সে নদী হত্যা করে আমরা আধুনিকতার বড়াই করছি। বর্তমানে ‘নরসুন্দা লেকসিটি’ নামে শত কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্পটি নিয়ে সাধারণের মনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার করেছিল। যদিও প্রকল্পটির নকসা সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না, এখনো নগরবাসীর কাছে তা রহস্যাবৃত। তারপরও মনে করা হয়েছিল এটি যথাযতভাবে বাস্তবায়িত হলে শহরের উন্নয়ন ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশের সৃষ্টি করবে। কিন্তু প্রকল্পটির কাজের মান নিয়ে প্রচুর অভিযোগ নগরবাসীর সে আশাকে চুরমার করে দিয়েছে। নদীর বিকল্পতো ‘লেক’ নয় এ কথা আমরা সবাই জানি। এরপর আমরা কী করে আশা করতে পারি, সেই টলমল জল আর খরস্রােতা নরসুন্দাকে আবার আমরা ফিরে পাবো ?
মু আ লতিফ : সাংবাদিক, লেখক ও আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংগ্রাহক।
আরো পড়তে পারেন….
আমার সখা নরসুন্দা : মু আ লতিফ
একযোগে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই : বিআইডাব্লিউটিএ চেয়ারম্যান
আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও লেখক, কিশোরগঞ্জ।