আমার দাড়াইন ।। সুমনকুমার দাশ

দাড়াইন

ছোট্ট মফস্বল শহর ঘুঙ্গিয়ারগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বহে গেছে যে নদ-তা দাড়াইন। আমাদের শৈশব-কৈশোরের খেলার সঙ্গী। যতক্ষণ চোখ লাল না হতো, ততক্ষণ দাড়াইনের তরল বুকে চলত দাপাদাপি। ফাল্গুন-চৈত্রের নিস্তরঙ্গ রূপ আর জৈষ্ঠ্যের যুবক দাড়াইনের কত ফারাক! আষাঢ়-শ্রাবণে ফুলে-ফেঁপে দাড়াইন মিশে যেত হাওরের বুকে। মাঝ নদীতে গেরাফি-ফেলা নৌকার মতোই পুরো জনপদের গ্রামগুলো যেন ভাসত হাওরজুড়ে! শুষ্ক আর বর্ষা-দুই সময়ে দুই রূপ দাড়াইনের। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শ্রীহাইল হোসেনপুর গ্রাম থেকে পাশ্ববর্তী দিরাই উপজেলার ধলবাজারের কাছাকাছি পর্যন্ত সাপের মতো এঁকেবেঁকে গেছে দাড়াইন নদ। বর্ষায় পানিতে থইথই করলেও শুষ্ক মৌসুমে কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি থাকে।…

নদী নিরুদ্দেশ ।। পিয়াস মজিদ

নিরুদ্দেশ

কতকাল ধরে শুনে আসছি নদী; তার কূল নেই, কিনারাও নেই। এই পাড় ভাঙে তো ওই পাড় গড়ে। একপ্রকার নিরুদ্দেশ যাত্রার নিয়তি তার, যদিও জানি নদী কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রধাবিত। (অবশ্য বাঁধ দিতে দিতে মানুষ নদীর সমুদ্রযাত্রাও নিঃশেষ করে দিচ্ছে)। পঁচিশ জুন। শুক্রবার, বুড়িগঙ্গা (আমার বেড়ে ওঠার প্রতিবেশী নদী কুমিল্লার গোমতী; যদিও গোমতীর চেয়ে বুড়িগঙ্গাই স্মৃতিতে-শ্রুতিতে প্রভাবশীল বেশি)। প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুর লাগোয়া দুপুরের নদী। আকাশে মেঘ। পাশে ঘাট। ঘাট থেকে নদীতে স্নানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ছেলে-বুড়ো-বউ-ঝি। তাদের আগেও অগণন মানুষের স্নান সারা হয়েছে এ নদীতে। তারা হয়তো মরে গেছে কিন্তু নদী রয়ে…

আমার নদী মধুমতী ।। রুখসানা কাজল

মধুমতী

প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। রাগে দুঃখে অপমানে অভিমানে জন্মশহর থেকে শিকড় তুলে নিয়েছিল আমাদের পরিবার। কী যে মায়াবী সুন্দর ছিল শহরটি। শহরের গা ছুঁয়ে বয়ে যেত সাদা জলের এক নদী। যারা বয়স্ক তারা বলতেন, মরা মধুমতী। শান্ত শ্রীময়ী ধীর ছন্দের মধুমতী দুকূলে অজস্র শণবনের ঝোপঝাড় নিয়ে আমাদের জীবনের সাথে মিশে ছিল। ভোরে, সকাল, দুপুর বিকেল সন্ধ্যা এমনকি রাতেও বাপী,মা, দিভাই, আপুলিদের সাথে নদীপাড়ে ঘুরতে গিয়ে কতবার দেখেছি এ নদীকে। কুয়াশার দোপাট্টা পরে ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে ভোরের নদী। তার সাদা বুকে জলতরঙ্গের অনুচ্চ সুরের গুনগুনানি। নদীপাড়ের ঘাসেরা হাত পা…

কালী নদী, যেখানে ঋণী আমার শৈশব ।। মাসুম মাহমুদ

শৈশব

নদী ভরা কূলে কূলে, ক্ষেত ভরা ধান আমি ভাবিতেছি বসে কী গাহিব গান। কেতকী জলের ধারে ফুটিয়াছে ঝোপে-ঝাড়ে, নিরাকুল ফুলভারে বকুল-বাগান কানায় কানায় পূর্ণ আমার পরাণ। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন ওই নদীর কাছে গেলে মনে হয় মায়ের মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। তার স্বচ্ছ জলের চোখ আমায় দেখে যেন বলছেন, ‘কিমুন আছো, বাবা?’ বলছি কালী নদীর কথা। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব-বাজিতপুর সীমানা হয়ে প্রিয় কুলিয়ারচরে প্রবেশ করে ভৈরবের মানিকদীর নিকটে শেষ হওয়া একটি নদী। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের অনেকটা সময় কালী নদীর সাথে কেটেছে। ছোটবেলায় ওই নদীটার সাথে আম্মাই আমাকে পরিচয়…

আহা, এইখানে এক নদী ছিল… ।। প্রভাষ আমিন

প্রভাষ

সবারই শেষ জীবন কাটানোর একটা স্বপ্ন থাকে। কারো স্বপ্ন পূরণ হয়, কারোটা হয় না। আমার স্বপ্নটা ছোট, কিন্তু জানি পূরণ হবে না। আহা, আমার যদি ছোট্ট একটা নদীর পারে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর থাকত। সেখানে ফেসবুক দরকার নেই, ইন্টারনেট লাগবে না; খালি বই পড়া আর গান শোনার ব্যবস্থা থাকলেই হবে। সকালে নদীর পারে হাঁটব, বুক ভরে নেব, ফ্রেশ অক্সিজেন, দুপুরে নদীতে সাঁতার কাটব, বিকেলে নদীর পারে আরাম কেদারায় বসে বই পড়ব আর গান শুনব। রাতে নদী থেকে আসা ভেজা হাওয়া গায়ে মেখে, বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে ঘুমিয়ে যাব। আমার শেষ…

কচানদী: নদীও নারীর মতো ।। মনি হায়দার

কচানদী

এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায় এ আমার দেশ, এ আমার প্রেম আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে কত আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে এই মধুমতী ধানসিঁড়ি নদীর তীরে নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে এক নীল ঢেউ কবিতার প্রচ্ছদপটে এই পদ্মা এই মেঘনা এই হাজার নদীর অববাহিকায় এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয় এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুয়ে নির্ভয় নীলাকাশ রয়েছে নুয়ে যেন হৃদয়ের ভালোবাসা হৃদয়ে ফোটে গানটির গীতিকার আবু জাফর। আবু জাফরের মনস্বী চৈতণ্যে অনেক সুরেলা ও…

বুকের ভিতর একটা নদী ।। রাজু বিশ্বাস

বুকের

আমার প্রথম প্রেমিকা ইছামতি। তার বুকের উপর আমার বসবাস। আমার ঘরের উঠোন জুড়ে আছে সে। আমার প্রাণের উপকূল জুড়ে তার প্রবাহমানতা। তার কোল ছেড়ে আমি বেশি দিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারি না। সে আমার বাল্যকালের সখা; যৌবনের প্রেয়সী। আমি যতই বলবো তার কথা ততই কম বলা হবে। আমার গ্রামের নাম বাজিতপুর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নায়িকা কুসুমের বাপের বাড়ি ছিল বাজিতপুর। কিন্তু সেই গ্রাম আর আমার গ্রাম এক না হলেও এ গ্রামের পথে আমি কুসুমকে খুঁজে পাই। সে আজো শশী দাদাবাবুর উদাসীন প্রেমে আকুল হয়ে কেঁদে চলে সারারাত।…

নদী আমায় ডাকে ।। কাইয়ুম চৌধুরী 

কাইয়ুম

বরেণ্য চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী’র এই লেখাটি গত ০৮-১০-২০১০ তারিখ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর লেখাটি  সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম  পুন:প্রকাশ করে। কৃতজ্ঞতা পত্রিকা দুটির প্রতি। লেখাটি প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় রিভার বাংলার বিশেষ আয়োজন “আমার প্রিয় নদী” সংখ্যায় প্রকাশ করা হল, একইসাথে প্রয়াত এই চিত্রশিল্পীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি- সম্পাদক। নদী আমাকে হাতছানি দেয়, ডাকে আমি প্রলুব্ধ যৌবনবতীর আহ্বানে, ভেসে যাই তার দুকূল প্লাবিত যৌবনের টানে। আমি অবগাহন করি— দুহাতে উন্মোচিত করি তার উদ্দাম বক্ষদেশ, কি উচ্ছল উচ্ছ্বাসে— কি সুখের আলিঙ্গনে যাই ভেসে।…

আমার শৈশবের তুরাগ এখন অর্ধমৃত! ।। মোহাম্মাদ এজাজ

তুরাগ

দেশের অনেক নদীই আজ তার ঐতিহাসিক নাম হারিয়ে যেন এক নামে উপনীত হয়েছে- সেটি হলো ‘মরা নদী!’ একটি নদী মরে গেলে শুধু নদীই মরে না, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনসংস্কৃতিও মরে যায়! জনসাধারণের জীবিকা নির্বাহের প্রতিবন্ধকতা, নদীমাতৃক এলাকায় মরুকরণ, জীববৈচিত্র্যের বিপন্নতাসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। দেশের সেই সব মরণাপন্ন নদীর একটি তুরাগ। দখল, ভরাট আর দূষণে ‘নিখোঁজ’ হতে চলেছে তুরাগ নামের এই নদটি। এটিই  আমার শৈশব ও কৈশোরের কহর দরিয়া। শৈশবে এই তুরাগই আমার উচ্ছলতা ও চঞ্চলতার নেপথ্যে ছিল। এটিই আমার ভালবাসার নদ। প্রিয় তুরাগ, আদালতের রায়ে জীবন্তসত্তা তুরাগ।  আমার…

যে জলে জীবন জ্বলে ।। রেজাউল করিম

জীবন

ছেলেবেলা থেকেই নদী ও প্রকৃতির সাথে আমার জীবন জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। নদী ও প্রকৃতির শান্ত-সৌম্য-স্নিগ্ধ রূপ মাধুর্য দেখে যেমন মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়েছি তেমনি এর রুদ্র রূপ, ঝঞ্জা-বিক্ষুব্দ ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা দেখে হয়েছি অস্থির, কখনোবা বেদনায় নীল। প্রবল ঢেউ ও ঝরো হাওয়ায় কখনো বা বিপন্নবোধ করেছি মেঘনা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মাঝনদীতে। উত্তাল ঝড়ো হাওয়ায় ডুবে মরার হাত থেকেও দু’একবার প্রাণে বেঁচে ফিরেছি! আমার বেড়ে ওঠা খাল-বিল-নদী-নালা বিধৌত গ্রামীণ জনপদে। আশৈশব বিচরণ করেছি অনাবিল ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝে। নানা ধরনের দেশীয় নৌকা, লঞ্চ, স্পীডবোট, স্টীমারসহ নানান ধরনের জলযানে চড়ে নদীপথে ভ্রমণ করেছি…

আমার শৈশব নদী ।। হামিদ কায়সার

আমার

কোন্ নদীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, কোন্ নদী ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা? আমি খুঁজি, স্মৃতি হাতড়ে ফিরি, বিভ্রম তৈরি হয়, একবার যদি বুড়িগঙ্গার শেষ বিকেলের জল চলকে উঠে তো, আরেকবার চিরিক মেরে উঠে দুপুরের ঝলমলানো তুরাগ। বুড়িগঙ্গা আমার নানাবাড়ির আর তুরাগ দাদাবাড়ির। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এতোবার নানাবাড়ি আর দাদাবাড়ি করেছি যে, আমি আসলে প্রথম কাকে দেখেছিলাম, তুরাগ না বুড়িগঙ্গাকে, সাব্যস্ত করা সত্যি কঠিন হয়ে উঠে। শেষে দ্বারস্থ হই মায়ের, মা চোখ বন্ধ করে বলে দেন, বুড়িগঙ্গা! হ্যাঁ, বুড়িগঙ্গাই হবে। মায়ের এভাবে গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলার কারণটা হলো, ঢাকা…

জলকাটার শব্দ শুনি ।। সত্যজিৎ রায় মজুমদার

জলকাটার

মায়ের পরে খুব রাগ হচ্ছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছি তবু মনে হচ্ছে নৌকায় শোয়া আর একটা দোলা লাগছে। মা, আমি ঘুমাতে পারছি না! ঢুল লাগছে। মা এটাকে উপেক্ষা করছে। এবার চিৎকার করে কান্না জড়ানো সুরে জানালাম। মা তবু হাসছে- ওরে পাগল, সারাদিন নৌকায় শুয়ে থেকে ঢুল লেগেছে। শুয়ে পড়, একটু পর ঠিক হয়ে যাবে। টাবুরে করে মামাবাড়ি থেকে বাড়ি এসেছি। বিকালে একটু শুয়েছিলাম। আমাদের বাড়ি মোংলা পোর্ট থেকে পূর্ব দিকে তিন কি.মি. কাইনমারী গ্রামে। মামাবাড়ি একই জেলা বাগেরহাটের রামপাল থানার মালীডাঙ্গা গ্রাম।…