নদীমাতৃক বা নদীবিধৌত ভারতবর্ষের সম্পদ নদী।নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠা জীবন-যাপন- জীবিকা- সংস্কৃতি।অথচ ভারতবর্ষে নদী বাঁচাতে অনশন করতে হচ্ছে।কিছুদিন আগে একজন অনশনকারী মৃত্যুবরণ করলেন।পাঠক বুঝতেই পারছেন জি.ডি.আগরওয়ালের কথা বলছি।এর থেকে লজ্জার কিছু আছে?আর পশ্চিমবঙ্গে কেমন আছে নদী?বর্তমান পরিস্থিতি যা তাতে নদী কি আর থাকবে আমাদের রাজ্যে?
পার্শ্ববর্তী দেশের দিকে তাকাই।আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ।কি অবস্থা সেখানে?গত আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের পর অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের শান্ত সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাতে অ্যাকশন এইড আয়োজিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক জল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে সেখানকার নদীভিত্তিক পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো।নদীমাতৃক বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশ তাই।সেখানে নদীর পরিস্থিতি ভয়াবহ।কিন্ত আশার কথা সেখানকার নবনির্বাচিত সরকার নদীর গুরুত্ব দেরীতে হলেও বুঝেছে।এবং খুব সঠিক ভাবেই বুঝেছে।সে দেশের বিচারালয় নদীকে লিগাল পার্সন ঘোষনা করছেন।নদীকে রক্ষা করতে সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং দখল মুক্ত করতে উচ্চ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে।সে কথায় আসছি।তার আগে ভারতের দিকে তাকাই।
কিছুদিন আগে ভারতবর্ষের জলপুরুষ আখ্যায়িত,স্টকহোম ওয়াটার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রাজেন্দ্র সিং-এর সঙ্গে দুদিন থাকার সুযোগ হয়েছিল।একবার মুখোমুখি কথোপকথনে আর একবার নিরি আয়োজিত একটি সেমিনারে।রাজেন্দ্র মূলত বললেন গঙ্গা নিয়ে।তার মতে গঙ্গার হয়েছে হার্টের রোগ।করা হচ্ছে দাঁতের চিকিৎসা।সারা দেশ জুড়ে গঙ্গা সদ্ভাবনা যাত্রার অঙ্গ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন।কেন্দ্র সরকারের নদী নীতির তুলোধনা করে বুঝিয়ে দিলেন সমস্যাটি কোথায়?নমামি গঙ্গে প্রকল্প হোক কিংবা নদী মন্ত্রকে গঙ্গার নাম সংযুক্তি চমক ছাড়া কাজ হয়নি কিছুই।অধ্যাপক জি.ডি.আগরওয়ালের প্রজ্ঞা কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণে তার সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাজ নিয়ে সবাই ওয়াকিবহাল।তার মতো মানুষ কে দেশের সরকারের অনন্ত উদাসীনতায় অনশন অবস্থায় মরণ বরণ করতে হলো।এটা মৃত্যু? নাকি পরিকল্পিত হত্যা? যা রাষ্ট্র কতৃক সংঘটিত?এখন হরিদ্বার মাতৃসদনের ছাব্বিশ বর্ষীয় স্বামী আত্মবোধানন্দ ‘নির্মল ও অবিরল গঙ্গা’-র জন্য অনশন করছেন একশোর বেশী দিন ধরে।অথচ সরকার উদাসীন।কোন সভ্য দেশে এসব হয়? এটা কি জাতীয় লজ্জা নয়?একটা গনতান্ত্রিক দেশের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার এমন ধৃষ্টতা দেখায় কি করে?যে দেশের প্রধানমন্ত্রী মাতৃস্বরুপা গঙ্গার বুলাবাতে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি কোথায়? ড্যাম আর ব্যারাজ নির্মানে ব্যস্ত? নাকি গঙ্গার মৃত্যুপরোয়ানা লিখতে ব্যস্ত?এদিকে গঙ্গা ও যমুনাকে জীবন্ত সত্ত্বা ঘোষনা করা হয়েছে ভারতবর্ষে এবং তার লিগাল অথরিটিও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কি পরিস্থিতি?পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিও ভয়ংকর।ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা রিপোর্ট দিচ্ছে এ রাজ্যে গঙ্গা নদীতে জীবাণু মাত্রাছাড়া। নিরির আলোচনাসভাতেই সংবাদিক ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি জয়ন্ত বসু দেখাচ্ছিলেন আদি গঙ্গা এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।শধু কি গঙ্গা?অন্য নদী গুলির কি হাল?দূষণ(করলা)দখল(মহানন্দা) বুকে নিজস্ব জমির পাট্টা(শ্রীমতি) অবাধ বালি উত্তোলন,নাব্যতা হ্রাস ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গের নদীর জ্বলন্ত সমস্যা।বেশ কিছু নদী হারিয়ে গিয়েছে রাজ্যের মানচিত্র থেকে।তিস্তা ছাড়াও কিছু আন্ত:সীমান্ত নদীকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে।যেমন আত্রেয়ী যেমন চূর্ণী। পুনর্ভবার পারে অবস্থিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ গঙ্গারামপুরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নদী ব্রাহ্মণী এখন আর নেই। এই সমস্ত নদীর তালিকা করে,রাজ্যের সামগ্রিক নদী চিত্র লিপিবদ্ধ করে( ইতিমধ্যেই নবগঠিত সবুজ মঞ্চ রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটির পক্ষ থেকে কলকাতা বইমেলাতে নাগরিক মঞ্চের স্টলে প্রকাশিত হয়েছে কেমন আছো নদী?অন্যান্য বিশিষ্ট দের সাথে সবুজ মঞ্চের সম্পাদক নব দত্তও উপস্থিত ছিলেন ) রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।এই মর্মে আগামী 20 ফেব্রুয়ারী সকাল দশটায় কোলকাতা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে নদীর জন্য পদযাত্রার জমায়েত এবং তারপর মহাজাতি সদনে সভা অনুষ্ঠিত হবে।তার জন্য তৈরি হচ্ছে সমগ্র রাজ্যের নদী ও পরিবেশ কর্মীরা।পশ্চিমবঙ্গে এই কর্মসূচি প্রথম ।
কিন্ত প্রশ্ন হলো কেন দরকার পড়লো এই কর্মসূচির? কারণ গোটা রাজ্যের নদী পরিস্থিতি বেহাল।অভিজ্ঞতা বলে কি দক্ষিণবঙ্গ কি উত্তরবঙ্গ পরিস্থিতি একই।এখনও চূড়ান্ত অসচেতন মানুষ, রাজ্যও। নদী যে উন্নয়নের মহাযজ্ঞে একটা মাধ্যম হতে পারে তা মনেই রাখিনি,রাখিনা আমরা।উন্নয়ন তো শুধু ইট কাঠ পাথরের নয়।উন্নয়ন তো পরিবেশিকও।এই সহজ সত্য কবে বুঝবো আমরা? বুঝিনা বলেই দায়িত্বশীল (?) মানুষ ভয়ংকরভাবে নদী হত্যালীলায় মেতেছে।রাজ্যেরও সামগ্রিক নদী নীতি নেই।ভুতের বাসায় পরিণত হয় নদীয়াতে অবস্থিত রাজ্যের একমাত্র নদীগবেষণা প্রতিষ্ঠান ( ক’জন জানেন এই প্রতিষ্ঠানের কথা সেটাও একটা বড়ো প্রশ্ন) ।কোচবিহারে এই ধরণের প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ থাকে নামমাত্র একটি সাইনবোর্ড ।
নদী আমাদের সম্পদ।তাহলে তাকে রক্ষা করবে কে?মানুষ?রাজ্য? রাষ্ট্র? উত্তর হচ্ছে তিনজনেই।এই প্রসঙ্গে প্রতিবেশী দেশের প্রসঙ্গে আরেকবার আসা যাক।পটুয়াখালি জেলার কুয়াকাটাতে আন্তর্জাতিক জল সম্মেলনের মূল বিষয় ছিল” রিভার – এ লিভিং বিয়িং”। কাকতালীয় হলেও সত্যি যে সম্মেলনের মধ্যেই তুরাগ নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা ঘোষনা করা হলো।এবং সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে বাংলাদেশ জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের যে ভিডিও ফুটেজ দেখালেন তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট ।রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে নদীর।বাংলাদেশের নদী বিশেষজ্ঞ ড.আইনুন নিশাতের কথায় বাংলাদেশের নবনির্বাচিত সরকার নদী রক্ষার পথে যাত্রা শুরু করেছে।পথ যেতে হবে অনেক।সে পথ সহজও নয়।কিন্ত তার অব্যবহিত পরপরই যেভাবে বাংলাদেশে নদীর সীমানা চিহ্নিত করণ, দখল উচ্চ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে তাতে আশা জাগছে( তাতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্যের স্থাপনা থাকলেও রেয়াত করা হচ্ছেনা।বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কতৃপক্ষ এতটাই দৃপ্ত পদক্ষেপ নিয়েছে)।নদী ও পরিবেশ ভিত্তিক সংগঠন তাতে সহযোগিতা করছেন, জনমত তৈরি করছেন।মানুষও তাতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন ।
পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতবর্ষে আমরা কোন পথে এগোবো সেটা এইসময় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।আরও একটু নির্দিষ্ট কর যাক।দায়িত্বটা কে নিচ্ছে বা কাকে দেওয়া হচ্ছে।যতদিন তা না সুনিশ্চিত হচ্ছে আসুন ততদিন এই প্রশ্ন বিভিন্ন ভাবেই আমরা জোরালো উপায়ে করতেই পারি। পরিবেশের স্বার্থে,আমাদের, রাজ্যের ও রাষ্ট্রের স্বার্থে। নোট- মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।