দেশ পত্রিকার (এ বি পি প্রকাশনা) দোসরা এপ্রিল সংখ্যা বর্তমানের একটি অতি জরুরী বিষয়কে সামনে তুলে এনেছে।এর জন্য প্রথমেই দেশ পত্রিকার সম্পাদক সুমন সেনগুপ্তকে নদীমাতৃক সবুজ অভিনন্দন জানাই। গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে যেন নদীর বিষয় টাই উঠে এসেছে।গঙ্গা তো শুধু নদী নয়।ভারতীয়দের জীবন ও সংস্কৃতি। ভারতবর্ষের অর্থনীতি। দেশের অগ্রগতির দ্যোতক। কিন্ত সেই নদীর বর্তমান হাল বেহাল। বিবিধ উপায়ে গঙ্গাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। সেই জীবনরেখাকে বাঁচাতে নানান সময়ে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্ত গঙ্গার হাল ফিরেছি কি?
এখন তো আবার গঙ্গাকে রক্ষার নাগরিক দের দাবীর কথা শুনতেও পাচ্ছেনা সরকার। প্রতিবাদীরা অনশন করছেন, তাতে মৃত্যুবরণও করেছে।আবার বর্তমানে একজন মৃত্যুপথযাত্রী। কিন্ত সরকারের হেলদোল নেই। এই সমস্ত বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীভূত করেই দেশ পত্রিকার সংখ্যা ” মাতস্তব জলমহিমা”। লিখেছেন চঞ্চল কুমার ঘোষ, কল্যান রুদ্র (কিছুদিন আগেই কলকাতায় নদী কনভেনশনে পাশাপাশি বসে নদীর কথা হয়েছে) ও সুপ্রতিম কর্মকার, আমার বন্ধু ।
প্রথম লেখক আমার অচেনা। সেটা একান্ত ভাবে আমারই ব্যর্থতা। কিন্ত পরের দুজনকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি এবং সেটাও বেশ কিছুদিন থেকেই।তাই নদী নিয়ে তাদের সাথে কথা হয়। চঞ্চল কুমার ঘোষের শিরোনাম ” জ্ঞান তপস্যার স্মৃতিযজ্ঞ সূত্র “।গঙ্গা জন্মের কাহিনী লেখার প্রথমভাগে বর্ণনা করে তিনি লিখছেন ‘ গঙ্গা জন্মের চিরন্তন এই কাহিনীর সৃষ্টি কবে, কেমন করে হল তার কোন বিবরণ নেই। হয়তো সবটুকু কবির কল্পনা। সেই কল্পনার স্রোত কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের মানুষের জীবনে এমনভাবে প্রবাহিত হয়েছে, প্রত্যেক ভারতবাসী অন্তরের গভীরতম স্থল থেকে বিশ্বাস করে যে, গঙ্গা কোন সাধারণ নদী নয়….।’
কিন্ত এই অসাধারণ নদীর কি হাল বর্তমানে? ঠিক এখান থেকেই কল্যাণ রুদ্রের লেখায়( শিরোনাম-নির্মল গঙ্গা: প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তব) আসি। তিনি শুরু করছেন এভাবে। গঙ্গা এখন আর ‘শুদ্ধিদাত্রী’নয়। দু’হাজার আঠার সালে মহামান্য জাতীয় পরিবেশ আদালত দেশের যে- তিনশো বাহান্নটি নদীর বিভিন্ন অংশকে দূষিত বা স্নানের অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন, তার মধ্যে গঙ্গাও আছে। এটুকু বলতে পারি যে গঙ্গা ভয়ংকর ভাবেই আছে।কারণ গঙ্গার দূষণ সর্বজনবিদিত। সেই দূষণের মোকাবিলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান এবং বর্তমানে নমামি গঙ্গে- অর্থ মঞ্জুর হয়েছে অনেক, সময়ও গিয়েছে কিন্তু গঙ্গাকে অবিরলতা, নির্মলতা দেওয়া যায়নি।
কল্যান বাবু আরও লিখছেন – লন্ডনের টেমস্ ও জার্মানির রাইন নদীও অতীতে দূষিত হয়ে এখন শুদ্ধ। কিন্ত গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। উপনদীগুলিকে দূষণমুক্ত না করলে গঙ্গার মূল ধারাকে দূষণমুক্ত করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গে এই কাজটি আরও কঠিন… । কিছুদিন আগে ভারতবর্ষের জলপুরুষ নামে আখ্যায়িত করা হয় যাকে সেই রাজেন্দ্র সিং- এর সাথে দু’দিন কাছাকাছি থেকে গঙ্গা নিয়ে অনেক মতের আদানপ্রদান হয়েছে এবং ওনার আলোচনাও শুনেছি। তাতে চুম্বকে যেটা বুঝেছি যে গঙ্গার অবস্থা নরেন্দ্র মোদি সরকারের সময় ভালো তো হয়ই নি, উল্টে খারাপ হয়েছে বহুগুণ। তিনি তাই ‘ গঙ্গা সম্ভাবনা যাত্রা’-র মাধ্যমে গঙ্গা যে রাজ্যগুলির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সেই রাজ্যের মানুষদের সচেতন করতে বেরিয়েছেন। কেন্দ্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রথম সদস্য সচিব গুরুদাস আগরওয়াল গঙ্গার অবিরলতার দাবীতে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করলেন কিন্ত সরকারের হুঁশ নেই।এখন আত্মবোধানন্দজি।একশো পঁচাশি দিন অতিক্রান্ত তার অনশন।অথচ সরকার নিরুত্তর।
ঠিক এখান থেকেই সুপ্রতিমের লেখায় আসি (শিরোনাম- আন্দোলন,রাজনীতি এবং গঙ্গা)। তিনি লিখছেন-এক নবীন সন্যাসীর আত্মবলীর সংকল্পের কথা।সম্মেলনটা (হরিদ্বার মাতৃসদন আশ্রমে, আয়োজক-বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের প্রাক্তন অধ্যাপক ভরত ঝুনঝুনওয়ালা) আয়োজিত হয়েছে তাঁর সমর্থনে । কিন্ত প্রস্তাবনাটা বিষম রকম মরবিড।কিন্ত তার চেয়েও বড় কথা, সন্যাসীর সংকল্পের সঙ্গে কিভাবেই বা জুড়ে গেল ভারতের এবং আন্তর্জাতিক নদী বিজ্ঞানীদের কন্ঠস্বর? আজ মৃত্যুপথযাত্রী গঙ্গাকে পুনরায় জীবনদানের জন্য দিকে দিকে আওয়াজ উঠছে।আর সেটা উঠবেই।বিভিন্ন নদী ও পরিবেশ সংগঠন গুলিও আত্মবোধানন্দের সমর্থনে ও গঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য কোমর বেঁধে নামছেন।এমনকি আত্মবোধানন্দজির পর স্বামী পূন্যানন্দও যে তৈরি সেকথাও জানিয়ে দিতে ভুলছেন না সুপ্রতিম।
বালুরঘাটে দীর্ঘদিন আগে ছাত্র- ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে যে আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলন শুরু করেছিলাম (নদীর কাছে এসো, জলবন্ধু ইত্যাদি যার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য) তা এখন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশেও প্রসারিত। কিংবা দক্ষিণবঙ্গের ইছামতি, চূর্ণী, মাথাভাঙা, বিদ্যাধরী, মাতলা ইত্যাদি নদী বাঁচানোর যে আন্দোলন, সেই সমস্ত আন্দোলনগুলোর গুরুত্বও যেন আরো একবার প্রতিভাত হল দেশ পত্রিকার এই সংখ্যার ইস্যুতে।
শেষ করবো পত্রিকা সম্পাদকের কলমের প্রসঙ্গ এনে।তিনি লিখছেন গঙ্গাকে নিয়ে- যে নদী মাতৃসমা, সে নদীর বুকে ভাসমান উচ্ছিষ্ট আর আবর্জনা- এ বোধ হয় একমাত্র এদেশেই সম্ভব ।এসবের ফলে গঙ্গার জীববৈচিত্র সংকটাপন্ন হওয়ার সঙ্গে অনিশ্চিত আরও অনেক কিছু গঙ্গার বিপন্নতা এদেশের অর্থনীতির পক্ষেও চরম এক অশনি সংকেত।এ তো যে কোন নদীরই কথা।নদীকে আমরা মা বলে সম্বোধন করি।তার কি হাল করছি আমরা? নদী যে সম্পদ ও সম্ভাবনার কথা বলে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে। দেশ পত্রিকার মাতস্তব জলমহিমা তাই বর্তমান সময়ের জরুরী দেওয়াল লিখন।সেই লিখন এখনই পড়তে না পারলে আমাদের সামগ্রিক ভবিষ্যতই যারপরনাই বিপন্ন ।