দেখে এলাম এশিয়ার প্রথম পানি জাদুঘর : অনন্য এক অভিজ্ঞতার কিঞ্চিৎ বয়ান

পানি জাদুঘর! তা-ও আবার এশিয়ায় প্রথম উদ্যোগ! সে কি কথা! পানি নিয়ে আবার জাদুঘরও হয়? সাধারণের মনে এমন প্রশ্ন জাগা খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এমন সব ভাবনা নিয়ে আমরা যখন জাদুঘরের সামনের সড়কে পৌঁছালাম, তখন ঝরছিল টিপটিপে বৃষ্টির ধারা। তাই কিছুটা দৌড়েই কাকভেজা হয়ে ভেতরে পৌঁছালাম, আমরা চারজনা। বৃষ্টিতে ভেজায় মেয়েদের মুখে কিছুটা বিরক্তির প্রকাশ দেখা গেলেও তাদের মাকে মনে হলো বেজায় খুশী।

পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার পথে কলাপাড়া উপজেলার পাখিমারা বাজার। এই পাখিমারা বাজারের অদূরেই একটি দোতলা টিনের বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে পানি বিষয়ে এশিয়ার প্রথম জাদুঘর। পাখিমারা মূল সড়কের একপাশে ব্যতিক্রমী এই জাদুঘরটি আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে বেশ ক’বছর ধরে, তৈরি করছে পানি ও পানির ন্যায্যতা বিষয়ে সচেতনতা।

জাদুঘরের ভেতরে ঢোকার মুখেই সহাস্যে আমাদের স্বাগত জানালেন, জাদুঘরের একজন নারী সহায়ক। সাথে সাথে ঘরটির দোতলায় অবস্থানরত (জয়নাল আবেদীন নামে) একজনকে তিনি বেশ উচ্চস্বরে কিছু বলে ডাকলেন। মুহূর্তেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা (শ্বেতশুভ্র পাজামা ও ফতুয়া পরিহিত) শশ্রুমন্ডিত ভদ্রলোক হাসিমুখে আমাদের আহবান জানালেন, জাদুঘরটি ঘুরে দেখার জন্যে। বেশ আন্তরিকতার সাথেই জানালেন, তাদের গড়ে তোলা, জাদুঘরটির গোড়াপত্তনের ইতিকথা।

পানি জাদুঘর। ছবি : লেখক

আলাপের এক ফাঁকে জাদুঘরের প্রবেশমূল্য/চাঁদার হার সম্পর্কে জানাতেও তিনি ভুললেন না। প্রথমেই তিনি বাংলাদেশের নদীর ইতিহাস, নদীর বিলুপ্তি, নদীগুলোর মরে যাওয়া এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার কথা বললেন পরম মমতায়। আমরা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। কথার শুরুতেই (আমাদের মতামত নিয়ে) বড় মনিটরে (আবহমান বাংলার রূপ-মাধুর্যের ধারণকৃত কিছু ফুটেজসহ) জাতীয় সংগীত বেজে উঠল। সে এক অভূতপূর্ব ব্যাপার! আমরাও গাইছি .. কী স্নেহ, কী মায়া গো..! অবচেতনেই দু’চোখ ভিজে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুবিন্দু!, কী মায়াবী আবেশ! পরাণের গহীনে বাজে কী এক শাশ্বত সুর!

আমরা উৎসাহ নিয়ে তার কথা শুনতে শুনতে দেখলাম – আন্তঃদেশীয় ১০১টি নদীর পানির নমুনা, নদী ও পানিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির নমুনা, নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে মনকাড়া কিছু ছবি, পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তথ্য ও শিক্ষা উপকরণ, নদীর মানচিত্র, ‘কুয়াকাটা ঘোষণা’ (Kuakata Declaration), পানি নিয়ে প্রতিবাদী স্লোগান সম্বলিত কিছু ফেস্টুন এবং আরও কতো কী।

শুনলাম, দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই জাদুঘরটি দেখতে আসেন। এই মিছিলে আছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি, সমাজকর্মী, নীতি-নির্ধারক, উন্নয়ন সংগঠকসহ নানা পেশা ও শ্রেণীর উৎসুক মানুষ। তারা দেখেন, আলোচনা করেন আবার পরামর্শও রাখেন বলে জানা গেল। নিঃসন্দেহে এটি ‘পানির ন্যায্যতা বিষয়ে একটি সামাজিক আন্দোলন’!

একশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে, কমিটেড ক’জন বুদ্ধিজীবীর পরিকল্পনায় এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায়, মহান এক ব্রত নিয়ে এই জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখন জাদুঘরটির ব্যবস্থাপনায় রয়েছে – উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘসহ কয়েকটি স্থানীয় সংগঠন।

যাইহোক, বেশ কিছুদিন আগেই পানি জাদুঘরের উদ্যোগ সম্পর্কে এক ঘরোয়া আড্ডায় এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার ইমতিয়াজ ভাইয়ের (প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ, আই আর, ঢা.বি) মুখে শুনেছিলাম। তখন থেকেই জাদুঘরটি দেখার খুব ইচ্ছে পোষণ করেছিলাম মনে মনে। এবার সুযোগ মতো সরেজমিনে এটি দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগলো, জানতেও পারলাম অনেক কিছু। তাই বলি, জীবনের ধন কিছুই যাবে না বৃথা!

জাদুঘরের সামনে রাখা প্রতীকী নৌকা । ছবি- লেখক

জাদুঘরটি সাজানো হয়েছে সুনিপুণ বিন্যাস আর নান্দনিক কুশলতায়। যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর বিন্যাস ও সংরক্ষণে কিছুটা মলিনতাও চোখ এড়ায়নি। কথা বলতে ও দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে কখন যে বিকেল হলো তা টেরই পেলাম না। এবার বিদায় নেবার পালা। বাইরে তখনও ঝরছে বারি ধারা। বিদায়ের মুহূর্তে চোখ আটকে ছিলো জাদুঘর ভবনের সামনের আংগিনায়। নোঙ্গর করা শুষ্ক নদীতে আটকে থাকা প্রতীকী নৌকাটি দেখতে দেখতেই জাদুঘর ছেড়ে এলাম। পেছনে তাকিয়ে বার বার দেখলাম, স্থানীয় উদ্যোক্তা, নিবেদিতপ্রাণ দু’জন আন্তরিক মানুষকে। হাত নেড়ে নেড়ে যেন বিদায় জানাচ্ছেন বিশেষ অতিথিদের, যেতে নাহি দিব, তবু… !

টুপিখোলা অভিনন্দন। জয় হোক। তোমাদের হোক জয়।

………………………………………

আরো পড়তে পারেন….

‘ফিরে চলো নদীর টানে’

নদী ভাঙন ঠেকাতে বিশেষ মোনাজাত

নদী দখলদারদের তালিকা প্রকাশ

………………………………………………………..

এবার জেনে নেয়া যাক, পানি জাদুঘর সম্পর্কে উদ্যোক্তা সংগঠন কি বলছে, এর প্রেক্ষাপটই বা কী।

পানি নিয়ে কেন এই উদবিগ্নতা?

সাম্প্রতিক সময়ে ভূমি কেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তার কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ আজ হুমকির সম্মুখিন। মানুষের তৈরি স্থাপনা, তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকান্ড, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ, দূষণ সর্বোপরি অব্যবস্থাপনা প্রভৃতির কারণে একদিকে যেমন মরুকরণ অন্যদিকে পানির লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি। এই সকল কারণে পানি, নদী ও জলার উপর নজর দেয়াটা এখন সময়ের দাবি।

বাস্তবতার কালো সোপান: তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের বলি হচ্ছে আমাদের সকল নদী। জীববৈচিত্র্য ও উপকূলীয় বাস্তুসংস্থান দিনে দিনে নিজস্বতা হারাচ্ছে। ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, ভূ-উপরিস্থ পানি হয়ে যাচ্ছে দূষিত।

বাংলাদেশ নদীবিধৌত একটি দেশ। ৮০০ এর অধিক নদী, উপনদী সারা ভূখণ্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই নদীগুলো এখন খুব নাজুক অবস্থায় আছে, কোনটি বিলুপ্তপ্রায়। যার কারণে এখানকার কৃষি,মানুষের জীবন-জীবিকা আজ দারুন হুমকির সম্মুখিন। প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবন-জীবিকার উপর ক্রম প্রসারমান এই হুমকি মোকাবিলা করতে আমরা কি প্রস্তুত?

জাদুঘরটি সপ্তাহে ৬ দিন খোলা থাকে – শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। www.watermuseum.net

বিজ্ঞাপন:

নদী দিবস- ২০১৯ উপলক্ষে নদী বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা রিভার বাংলা ডট কম কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। এর মধ্যে রয়েছে- নদীর জন্য পদযাত্রা ও আলোচনা সভা।

সংশ্লিষ্ট বিষয়