শেষ পর্যন্ত আত্রেয়ী আর তিস্তার দেখা হয় নি, কথাও না

আত্রেয়ী

এই লেখা আসলে শ্রদ্ধেয় কথাশিল্পী দেবেশ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।তাঁর সাথে আমার কোনদিন দেখাও হই নি, কথাও না। তবু আনত শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে, নদীকে যিনি বুকে ধারণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকে সম্ভবত ১৯৬৮ সালে তিস্তা নদীর ভয়ংকর বন্যার কথা জেনে আসলেও তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় অনেক পরে।।

নব্বই- এর দশকের শেষের দিকে। নদী যে তীব্র অভিঘাত তৈরি করে মনের ভিতর তখন সেটা করেনি। সেটা ছিল শুধু তাকানো। এখন বুঝি সেটা দেখা ছিল না। দেখার দৃষ্টি তো নয়ই। আর তিনি অর্থাৎ দেবেশ রায় তিস্তাকে গভীর ভাবে দেখেছেন না, তিনি শুধু তিস্তা পারের বৃত্তান্তের, তিস্তাপূরাণের লেখক নন, তাঁর আরও অনেক অসামান্য সৃষ্টি আছে।কিন্ত কী করে যেন তিনি নদীর আপনজন হয়ে রইলেন!

আসলে তার একটা বাঘারু ছিল।১৯৯০ সালে যখন তিস্তাপারের বৃত্তান্তের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রদান করা হয় সেই চূড়ান্ত নির্বাচনে বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’ও ছিল। শেষে পুরস্কার পায় ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’।

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন -“মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেমন ‘হোসেন মিঞা’, তেমনই তিস্তাপারের বৃত্তান্তের বাঘারু।অসাধারণ চরিত্র।‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ নিজগুণেই বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন পাবে।”

এই লেখার শিরোনামে আরেকটি নদীর উল্লেখ আছে। আত্রেয়ী। সে এক নদী। জীবনের বেশ কয়েকটি বসন্ত পার করার পর এখন অনুভব করি সেও বালুরঘাটের বুকের ভেতর দিয়ে যায়। তিস্তার মতো সেও ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের আন্ত:সীমান্ত নদী। কোথাও আত্রেয়ী কোথাওবা আত্রাই। তিস্তার তারও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। তারও মহাভারত আছে, দেবিপুরাণ আছে, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী আছে।

আত্রেয়ী নদীকে ভালবাসার কথা যখন আন্তর্জাতিক ভাবেও প্রতিষ্ঠিত সেসময় আনন্দবাজার পত্রিকাতে একটি পোস্টএডিটে শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় লিখেছিলেন আত্রেয়ীর কথা। সাল ২০১৮-১৯। তার আগে তিনি বিভিন্ন সময় তিস্তা নিয়ে এন্তার লিখেছেন ওই সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয়তে। মনে হয়েছিল কথা বলি। নদীকে অন্তর দিয়ে ভাল না বাসলে এমন গভীর পর্যবেক্ষণ হয়! মনে হয়েছিল আত্রেয়ীর আরও কথা তিস্তাকে জানাতেই হবে।

সেই যে ১৭৭৭ সালে দুই বোন আলাদা হয়ে গেল হিমালয় সানুর বিশালকায় বন্যায় তারপর তো তাদের আর দেখাই হল না। অথচ ফান্ ডেন্ ব্রোকের নকশায়,স্ট্রং- এর দিনাজপুর গেজেটিয়ারে পরিষ্কার উল্লেখ আছে তিস্তার সঙ্গে আত্রেয়ী যোগ।১৭৭৭ সালের পর তিস্তা তার গতিপথ পরিবর্তন করে ব্রহ্মপূত্রের সাথে যুক্ত হল।পরে অবশ্য ১৮৯৭ সালে আত্রেয়ী নদীকে তিস্তার সাথে পুনরায় যুক্ত করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।কিন্ত সেই চিরবিচ্ছেদকে আর মিলনের রুপ দেওয়া সম্ভব হয়নি।আলাদা হয়ে গেল দুজনা।

হায়রে নদী! তোদের মন যদি যন্ত্র-মানুষ অনুভব করতে পারতো! তাহলে বুঝতে পারতো বিচ্ছেদের যন্ত্রনা কি তীব্র হয়, ভয়ংকর হয়! অনেককে বলেছি, জিজ্ঞেস করেছি, খোঁজ করেছি কিন্ত কেন যে উত্তরের এই নদীসন্তানের ফোন নং পেলাম না! ক’দিন আগে এসব শুনে উত্তরের কবি গৌতম গুহ রায় বলছিলেন-‘ইশ,খুব ভাল হতো তাহলে। উনি যে কিভাবে নদীর পাশে, মানুষের পাশে দাঁড়ান তা বলে বোঝানো যাবে না।’

বললাম কিছু না আসলে তাঁকে জানাতে চেয়েছিলাম আত্রেয়ী নদীকেও মানুষের ভালবাসার কথা।এভাবেই যদি তিস্তার সাথে আত্রেয়ীর দেখা করিয়ে দেওয়া যেত মনে মনেও কথা বলিয়ে দেওয়া যেত! সে আক্ষেপ আমার থেকে যাবে আজীবন।

তিস্তা সম্পর্কে একবার দেবেশ রায় লিখেছেন -“তিস্তা পৃথিবীর যে কোন নদীর সমস্পর্ধী। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। তিস্তা যখন আমাদের ঘরের সিঁড়িতে বা দরজাতেই তখন সে দৈনন্দিনের অংশ হয়ে যায়…”

তিস্তা যেমন তার দৈনন্দিনের অংশ তেমনই আত্রেয়ীও আমাদের দৈনন্দিনতা। সেই যে দু পথ তাদের আলাদা হয়ে গেল আর এক হল না! আপনি নদীর মন বুঝেছিলেন।হে, নদীসন্তান আপনাকে নদীমাতৃক সবুজ অভিবাদন।

আরও পড়তে পারেন….

হালদায় রেকর্ড ডিম সংগ্রহ

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় নদী সংকেত দেয় 

সংশ্লিষ্ট বিষয়