।। রিভার বাংলা ডট কম ।।
কেউ কেউ নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, বিশ্ব নদী দিবস নিয়ে একটি মজার বিষয় রয়েছে। বহুলব্যবহৃত অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়া বা তথ্যভাণ্ডার উইকিপিডিয়ায় যদি ইংরেজিতে ‘ওয়ার্ল্ড রিভারস ডে’ খুঁজতে যায় কেউ, ব্যর্থ হবেন। উইকিপিডিয়ায় পরিবেশ-সংক্রান্ত দিবসগুলোর তালিকায় এর নাম থাকলেও পেজটি এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু বাংলায় ‘বিশ্ব নদী দিবস’ সার্চ দিলে খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। যদিও নদী দিবস সম্পর্কে জানতে এখন উইকিপিডিয়ার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন প্রায় ফুরিয়ে আসছে। কারণ নদী নিয়ে তৎপর আন্দোলন, উদ্যোগ, সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যম তো বটেই, এদেশের সাধারণ মানুষ বিশেষত তরুণদের বিপুল অধিকাংশ এখন জানেন যে, ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালিত হয় সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার।
এ-ও অনেকে জানেন, দিবসটির সূচনা হয়েছিল কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে আশির দশকের গোড়ায়। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক এবং নদীপ্রেমিক মার্ক অ্যাঞ্জেলো তাঁর কিছু ছাত্রছাত্রী ও বন্ধুকে নিয়ে একটি নদীতে ‘ক্লিন আপ’ বা পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান। নদীটি র্যাফটিংয়ের জন্য জনপ্রিয় ছিল; কিন্তু যারা অংশ নিতেন তাদের খাবারের প্যাকেট, র্যাফটিংয়ের যন্ত্রাংশ, বিনোদন উপকরণ প্রভৃতি নদীটিতেই পরিত্যাজ্য হত। তারা সেগুলো পরিস্কার করেন। একটা পিকনিকের আবহে দলটি অংশ নিয়েছিল এবং তখনও তারা হয়তো জানতেন না যে, একটি ইতিহাস তৈরি হতে যাচ্ছে।
পরের বছরগুলিতে দিবসটি উদযাপন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে; ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্য হয়ে ক্রমে পুরো কানাডা, নর্থ আমেরিকা, সাউথ আমেরিকা, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া। ২০০৫ সালে এসে জাতিসংঘ দিবসটি সমর্থন করে এবং ২০১৫ সাল পর্যন্ত ‘ওয়াটার ফর লাইফ ডিকেড’ কর্মসূচির অংশ করে নেয়। মার্ক অ্যাঞ্জেলো ততদিনে তাঁর নদীপ্রেমের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনিই প্রতিষ্ঠিত হন দিবসটির জাতিসংঘ চেয়ার হিসেবে।
বিশ্ব নদী দিবসের বাংলাদেশ সূচনাপর্বেরও প্রায় একই ধরনের অনানুষ্ঠানিক অথচ অক্ষয় এক ইতিহাস রয়েছে। ২০০৯ সালের দিকের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা ‘রিভার লাভিঙ পিপল’ নামে যে অনানুষ্ঠানিক সংগঠন করতাম, ততদিনে সেটা ‘রিভারাইন পিপল’ নাম নিয়েছে। মূলত ফেসবুকের একটি গ্রুপ কেন্দ্র করে। অনলাইন গ্রুপটি কীভাবে অফলাইনে সক্রিয় করা যায়, সেই প্রচেষ্টা চলছে। গ্রুপটিতে সক্রিয় অনেককেই তখনও আমি সামনাসামনি দেখিনি। ফেসবুকে, ইমেইলে, ফোনেই কথাবার্তা চলে আমাদের। সবাই একমত হলাম, একদিন অফলাইনে বসা দরকার। কিন্তু কোন দিন?
আমরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, রিভারাইন পিপল ‘এক্সক্লুসিভলি’ নদী নিয়ে কাজ করবে; অন্যান্য পরিবেশ আন্দোলনের মতো পরিবেশ-প্রতিবেশের সবকিছু নিয়ে নয়। তখন থেকেই আমার মাথায় চিন্তা ঘুরছিল, পরিবেশ দিবস রয়েছে, পর্বত দিবস রয়েছে, বন দিবস রয়েছে, মহাসাগর দিবস রয়েছে, এমনকি পানি দিবসও রয়েছে। ‘নদী দিবস’ থাকবে না কেন? আমরা যেহেতু শুধু নদী নিয়ে কাজ করব, দিবস পালনের ক্ষেত্রে কেন ‘শুধু নদী’ প্রাধান্য পাবে না? মুশকিল হল, সার্বিক অর্থে ‘নদী দিবস’ পাওয়া যাচ্ছিল না।
ইন্টারন্যাশনাল রিভারস নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ অ্যাকশন ফর রিভারস’ ততদিনে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছিল। অঙ্গীকার বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমিও ব্যক্তিগতভাবে ২০০৫ সালে তাদের একটি আয়োজনে যোগ দিতে ভারতে গিয়েছিলাম। হাতের পাঁচ হিসেবে সেই দিবসটা পালন করা যায়। কিন্তু দিবসটি মূলত আইআর-কেন্দ্রিক, তার বাইরে অন্যদের কাছে ততটা পরিচিত ও প্রসারিত নয়। খুব বেশি দিনেরও নয়। একবার ভাবি, পানি দিবসই কি তাহলে আমরা আমাদের প্রধান দিবস হিসেবে গ্রহণ করব? পানি দিবস একদিক থেকে খুবই সহজ; জাতিসংঘের দিবস, সরকারিভাবে পালিত, ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিচিত। কিন্তু পানি দিবসের প্রতিপাদ্য কখনও কখনও নদীর সঙ্গে সম্পর্কহীনও হতে পারে। যেমন তার আগের বছরই দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল, ‘স্যানিটেশন’। একে নদীর সঙ্গে মেলানো কঠিনই বটে।
এই সময়ই চোখে পড়ল ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালিত হয়। তবে আমাদের আশপাশের কোনো দেশে এর নজির নেই। মূলত উন্নত বিশ্বে– আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া। এশিয়া, আফ্রিকা তখনও দিবসটি সম্পর্কে জ্ঞাত বা আগ্রহী নয়। এর প্রতিষ্ঠাতার নামও জানলাম, গুগলে সার্চ দিয়ে বের করলাম তাঁর ই-মেইল অ্যাড্রেস। মেইল করলাম তাঁকে যে, আমরা বাংলাদেশের একটি তরুণ নদীকর্মী গোষ্ঠী পরের বছর বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে চাই। তিনি প্রথমে সম্ভবত বিস্মিত হলেন, এতদূর থেকে মেইল পেয়ে। তারপর খুবই উৎসাহ দিলেন, অনুপ্রেরণামূলক কথা বললেন। এ-ও বললেন যে, বাংলাদেশে নদী দিবস পালন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিজের জন্য এবং দিবসটির জন্যও অনুুপ্রেরণাদায়ক হবে। কারণ এর মধ্য দিয়ে তারা ভূগোলকের সম্পূর্ণ উল্টো দিকে পৌঁছে যেতে পারছেন। বললেন, আমাদের প্রতি তাঁর বিশেষ নজর থাকবে।
এর প্রমাণও পেয়েছিলাম ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি যখন ঢাকায় এসেছিলেন। রীতিমতো গরুখোঁজা করে তিনি আমাকে বের করেছিলেন। আমরা প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছিলাম। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যাহোক, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে রিভারাইন পিপল বিশ্ব নদী দিবস পালন করবে এবং প্রথমবারের মতো অনলাইন থেকে অফলাইনে মিলিত হবে। ঢাকায় যারা আছেন, তারা ওই দিন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে একত্র হব। আর ঢাকার বাইরে যারা, তারা নিজ নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্র হবেন। সম্ভব হলে নদীতে ঘুরতে যাবেন। প্রশ্ন উঠল, দিবসটির ‘প্রতিপাদ্য’ কী? আবার মেইল করলাম মার্ক অ্যাঞ্জেলোকে। তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় বললেন, এই দিবসের কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিপাদ্য নেই। দেশ ও অঞ্চলভেদে আলাদা প্রতিপাদ্য ঘোষিত হতে পারে। বাংলাদেশ প্রতিপাদ্য কে ঘোষণা করবে? তিনি বললেন, তোমরাই কর! আমি অনুমতি দিচ্ছি। আমরা ঠিক করলাম বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপাদ্য: ‘নদী ডাকছে, আমরা সাড়া দেব না?’
তার আগে আমরা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে যৌথ নিবন্ধ লিখে পাঠালাম। ঢাকার বাইরে থেকে যৌথ লেখায় যাদের অংশগ্রহণ ছিল, তাদের একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনজুরুল কিবরিয়া এবং রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদের কথা মনে আছে। মনে আছে, ছাপা হল প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, নিউ এইজ, ডেইলি সান ও আমার দেশ পত্রিকায়। উত্তেজনায় সারারাত আমাদের কয়েকজনের ঘুম হচ্ছিল না। সকালে উঠে সবকয়টা পত্রিকা কিনে এনে নদী দিবসের লেখা দেখি আর আনন্দে চোখ চকচক করে।
ঢাকার আমরা বসলাম মধুর ক্যান্টিনে। আলোচনার বিষয়: নদী নিয়ে ‘কিছু একটা’ করা। প্রথমবারের মতো সবাইকে সামনাসামনি দেখার উত্তেজনা তো ছিলই। যতদূর মনে পড়ে, ঢাকার বাইরে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট ও অনানুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান গৃহীত হল।
সেই দিন ‘নদী দিবস’ ছিল টক অফ দ্য টাউন। দিবস নয়, আয়োজকদের নিয়ে। ‘রিভারাইন পিপল’ নামটি সবার কাছে নতুন। এর আগে কখনও সংবাদমাধ্যমে আসেনি। মনে আছে, একটি সংবাদপত্রের সামনের চায়ের দোকানে নতুন এই পরিবেশবাদী সংগঠন নিয়ে নানা ধরনের অনুমানভিত্তিক আলোচনা চলছিল, আর আমি ভেতরে বেদম খুশি নিয়ে ওপরে শান্তভাবে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম।
পরের বছর কালের কণ্ঠে যে প্রতিবেদন ছাপা হল তার ভাষ্য মোটামুটি এমন– সরকার জানেই না আজ বিশ্ব নদী দিবস। তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী প্রতিবেদকের কাছে বললেন, রিভারাইন পিপল আমাদের কাছে আসে নাই কেন! আসলে আমরা তখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি এই সাংগঠনিক পরিচয়ে আমরা ব্যক্তিগতভাবে কতদূর ‘প্রকাশ্য’ হব। কারণ রিভারাইন পিপল ‘নেতৃবৃন্দের’ বেশিরভাগই তখনও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী।
২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যখন নদী দিবস পালনে এগিয়ে এল, তখন আমরা আরও আত্মবিশ্বাসী হলাম। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। ২০১৪ সাল থেকে সব পরিবেশবাদী সংগঠন মিলে ‘নদীর জন্য পদযাত্রা’ আয়োজন করা হচ্ছে। এর বাইরেও এককভাবে থাকছে সবার কর্মসূচি।
বাংলাদেশে বিশ্ব নদী দিবস পালনের তাৎপর্য কী, সেই প্রশ্নের জবাব লেখার শুরুতেই রয়েছে। ‘নদীমাতৃক’ দেশে নদী দিবসই তো হবে উদযাপনের প্রকৃত উপলক্ষ! সেই উদযাপন মাত্র আট বছরে কী মাত্রা গ্রহণ করেছে, উইকিপিডিয়া তার প্রমাণ। ইংরেজিতে ‘ওয়ার্ল্ড রিভারস ডে’ পাওয়া যায় না; কিন্তু বাংলায় ‘বিশ্ব নদী দিবস’ সহজলভ্য।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীপ্রিয় সবাইকে নদীময় শুভেচ্ছা।
লেখক : শেখ রোকন, সাংবাদিক ও মহাসচিব, রিভারাইন পিপল। সূত্র: বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ।