এদেশের নদ-নদীগুলো যুগ যুগ ধরে আবহমান গ্রাম বাংলার চিরচেনা অপরুপ সৌন্দর্য ও ইতিহাস বহন করে আসছে। তেমনি একটি উল্লেখযোগ্য নদী হল গড়াই নদী। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যে গড়াই নদী বহুমাত্রিকভাবে ইতিহাসের ধারক বাহক ও সাক্ষী।
গড়াই নদী গঙ্গা তথা পদ্মার একটি প্রধান শাখানদী হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্ব পূর্ণ নদী। গড়াই নদী কুষ্টিয়া জেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নে প্রবহমান পদ্মা নদী হতে উৎপত্তি লাভ করে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে মধুমতি নদীতে পতিত হয়েছে।
একসময় গড়াই নদী দিয়ে গঙ্গার প্রধান ধারা প্রবাহিত হতো। হুগলি-ভাগীরথী ছিল গঙ্গার আদি ধারা। কুষ্টিয়া জেলার উত্তরে হার্ডিঞ্জ সেতুর ১৯ কিলোমিটার ভাটিতে তালবাড়িয়া নামক স্থানে গড়াই নদী পদ্মা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নদীটি কুষ্টিয়া জেলার ভিতর দিয়ে কুমারখালী খোকসা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বড়ুরিয়া নামক স্থানে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। অতঃপর ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়ে চাঁদট গ্রাম দিয়ে রাজবাড়ী জেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর কুষ্টিয়া- ঝিনাইদহ-রাজবাড়ী জেলাকে অতিবাহিত করে মাগুরা-ফরিদপুর জেলার সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়ে মধুমতি নাম ধারণ করে নড়াইল ও বাগেরহাট জেলার মধ্য প্রবেশ করেছে। গড়াই নদীর দৈর্ঘ ৮৯ কিমি। কয়েকটি শাখা-প্রশাখা রয়েছে তারমধ্যে কুমার নদী, কালীগঙ্গা, ডাকুয়া অন্যতম।
গড়াই নদীর গা ঘেষে কুষ্টিয়া, কুমারখালী ও খোকসা শহর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের বহুসময় কাটিয়েছেন গড়াই-পদ্মা নদীর তীরে। গড়াই নদীর তীরবর্তী টেগরলজে তিনি রাত্রিযাপন ও বিশ্রাম করতেন। গড়াই নদীতে বসে তিনি রচনা করেছেন নোবেল জয়ী ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’। (২৭ আষাঢ়, ১৩১৭, গোরাই, জানিপুর।) গড়াই নদীর নাম অতীতে গোরাই লেখার প্রচলন ছিল। অন্যদিকে জানিপুর খোকসা উপজেলার গড়ীই নদী তীরবর্তী পুরাতন একটি প্রধান শহরের নাম।
কুষ্টিয়া শহরের লালন সাঁইজির আখড়াবাড়িও গড়াই তীরবর্তী কালীনদীর পাড়ে। কালী নদী, গড়াই নদীর শাখা। গড়াই নদীর পাশ ঘিরেই বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা। গোরাই ব্রিজ নামে ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থও রয়েছে এই শক্তিমান গদ্যশিল্পীর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ভিটেবাড়ীও ও এমএন প্রেসও গড়াই নদী সংলগ্ন। কবি আজিজুর রহমানের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই গড়াই নদীকে ঘিরে। তার জন্ম গড়াই নদী সংলগ্ন হাটশ হরিপুর গ্রামে।
একাত্তরের জনযুদ্ধের বহুস্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই গড়াই নদীকে ঘিরে। একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্তপাত, বোমা নিক্ষেপ ও নির্মমতার স্বাক্ষী এই গড়াই নদী। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতেও এই গড়াই নদীরও রয়েছে অজানা অনেক ইতিহাস।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ দ্বিতীয় খন্ডে আলোকপাত করলে দেখতে পাই, গড়াই নদীকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাসের তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১০১ পৃষ্ঠায় কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স নির্যাতন কেন্দ্র ও ২৮১ পৃষ্ঠায় পুলিশ লাইন্স বধ্যভূমির উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে। একাত্তর সালে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স ছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্যাতন কেন্দ্র এবং বধ্যভূমি। এখানে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই বন্দিদশা থেকেই ধরে নিয়ে হত্যা করা হয় অধ্যাপক দূর্গা দাশকে। কুষ্টিয়া শহরের গড়াই নদীর তীরবর্তী দক্ষিণ পাশেই এই পুলিশ লাইন্স অবস্থিত। ১২৫ পৃষ্ঠায় সরাসরি গড়াই নদী গণহত্যার বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে- ‘বিহারীরা হতভাগ্য বন্দিদের গড়াই নদীর চরে হত্যা করে লাশ সেখানেই পুতে ফেলত। আবার কখনো নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত লাশগুলোকে। কুষ্টিয়া পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কাশেমকে এভাবেই হত্যা করা হয়। ’
গবেষণা, অনুসন্ধান ও মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে এইসকল বধ্যভূমি এবং গণহত্যার দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ কোষের ৪০৪ পৃষ্ঠায় আলাদাভাবে রক্সি সিনেমার গলি ও গড়াই নদীর চর বধ্যভূমির বিবরণ রয়েছে। ৪৭০ পৃষ্ঠায় সিএন্ড বি কুষ্টিয়ার নির্যাতন কেন্দ্রের বিবরণ রয়েছে। ১০২ পৃষ্ঠায় কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গণহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে গড়াই নদী গণহত্যা ও বদ্ধভূমি অন্যতম। একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, আলবদর, রাজাকার ও বিহারীরা সাধারণ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এই সকল স্থানে নির্যাতন করে হত্যা করতো এবং লাশ নদীতে ফেলে দিতো। দেশ স্বাধীনের পরে এইসকল স্থান থেকে অসংখ্য মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিলো।
অন্যদিকে নারীনেত্রী ও রাজনীতিবিদ নুরজাহান বেগম একাত্তরের সময় তিনি অবরুদ্ধ অবস্থায় কুষ্টিয়া জেলায় পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তার স্মৃতিকথামূলক বই ‘একাত্তরের আমি’ গ্রন্থেও স্বাধীনতা বিরোধীদের হাত থেকে বাঁচতে গড়াই নদী পাড় হয়ে বিভিন্ন গ্রামে কিভাবে সাধারণ নারী, পুরুষ, শিশু ও মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছিলো তার বিবরণ দিয়েছেন। গড়াই নদীর ঘাটে গণহত্যায় আড়ুয়াপাড়ার তফাজ্জেল হোসেন কিভাবে গড়াই নদীতে ঝাপ দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন তার মৌখিক ভাষ্যের বিবরণ উল্লেখ করেছেন।
ড. সুকুমার বিশ্বাসের ‘একাত্তরের গণহত্যা ও বধ্যভূমি’ গ্রন্থের ১০৯ পৃষ্ঠায়ও গড়াই নদী গণহত্যা ও বধ্যভূমির বিবরণ রয়েছে।
লেখক ও গবেষক আহমদ রফিক এর ‘একাত্তরের পাক বর্বরতার সংবাদভাষ্য’ গ্রন্থের ৩৯৯ পৃষ্ঠায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নয় মাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। ‘গড়াই নদীতে গোসল করতে যাবেন না, পায়ে মানুষের কঙ্কাল বাধে’ শিরোনামের বিবরণে রয়েছে- ‘গত ন’ মাসে পাক-সৈন্য ও তাদের তাবেদাররা কুষ্টিয়ায় যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, এইসব নরকঙ্কালের টুকরো অংশ তারই জলন্ত স্বাক্ষী বহন করে। বর্বর পাক সেনা ও তাদের অনুচরেরা গড়াই নদীর ধার দিয়ে গঙ্গা কপোতাক্ষ ঘাট থেকে শশান ঘাট পযর্ন্ত দেড় মাইল এলাকার মধ্যে প্রায় পাঁচ ছয় হাজার বাঙালি নর-নারীকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিলো। সেই সমস্ত হতভাগা মানব সন্তানের হাড়গোর এখনো নদীতে গোসল করতে গেলে মাঝে মাঝে মানুষের পায়ে বাধে।’
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ইমাম মেহেদী রচিত ‘১৯৭১ ডাঁশার চাষী ক্লাব যুদ্ধ’ গ্রন্থের ৪৯ পৃষ্ঠাসহ কয়েক জায়গায় গড়াই নদী সাথে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কের বর্ণনা রয়েছে। ঐ যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলে অন্য যোদ্ধারা তাদের ডাঁশা গ্রাম থেকে নিয়ে নৌকা যোগে রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার নটাভাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পৌঁছান। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ দ্বিতীয় খন্ডের ১২৩ পৃষ্ঠায়ও গঙ্গা কপোতাক্ষ অফিসের পাশে বাঁধানো ঘাট বধ্যভুমি ও গণকবরের বর্ণণা রয়েছে। এই যুদ্ধক্ষেত্র ও গণকবরের অবস্থান গড়াই নদী তীরবর্তী এলাকায়।
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ডাঁশা গ্রামের যুদ্ধকালীন খোকসা কুমারখালীর গেরিলা কমান্ডার মো. লুৎফর রহমান সাক্ষাৎকালে জানান, ‘একাত্তর সালে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এলাকায় এসে আমার নেতৃত্বে প্রথম যুদ্ধ, চাঁদট মসজিদ যুদ্ধ। ঐ যুদ্ধে আমরা মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করি। চাঁদট যুদ্ধে আমরা চারজন রাজাকারকে মসজিদের ভিতর থেকে ধরে ফেলি এবং দুইজন রাজাকার আমাদের সাথে যুদ্ধে মারা যায়। এই যুদ্ধক্ষেত্রটা একদম গড়াই নদীর পাশে। বাদবাঁকী রাজাকাররা গড়াই নদী পাড় হয়ে পালিয়ে যায়।’ (সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ২১ নভেম্বর, ২০২০ নিজবাড়ি)
বধ্যভূমির ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্মমতার ইতিহাস ধরে রাখতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এর উদ্যোগে গত ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ কুষ্টিয়া গড়াই নদীর তীরে ‘কুষ্টিয়া গড়াই নদী বধ্যভূমি’এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন কুষ্টিয়া সদর আসনের সাংসদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
নদীর যেমন একুল ভাঙে ওকুল গড়ে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক আশ্রয়স্থল ও সাক্ষী এই গড়াই নদী। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৫০ বছর ধরে কখনো নির্মমতার ইতিহাস আবার কখনো জীবন বাঁচানোর ইতিহাস বহন করে আসছে এই এতিহ্যবাহী এই গড়াই নদী।
ইমাম মেহেদী : প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।