বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নদী ভালবাসা ও নদী নির্ভরতার সামান্য প্রমাণ

আপামর বাঙালির সামনে এক প্রজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বরাবর শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই বঙ্গবন্ধুর নদী নিয়েও যে বিশেষ ভাবনা ছিল, তার কথা অনেকেই জানে না। শেখ মুজিবুর রহমান আসলে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী ও জলাশয়কে বুকে ধারণ করে চলতেন। তাইতো তিনি অনায়াসে বলতে পারেন নিজেকে ‘পানির দেশের মানুষ’। এভাবে তিনিই বলতে পারেন যার জলের প্রতি ভালবাসা আছে।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সত্যিকারের নদীমাতৃক দেশ বলতে যা বোঝায় তা হল বাংলাদেশ। একেবারে জলের দেশ বলতে যা বোঝায় তাই। ট্রেনে যেতে যেতে দেখেছি দূরে নদী অথবা জলাশয় থাকলেও জমির গোড়ায় ছিপছিপে জল। নদী-বিল-খাল সব দিয়ে কতটা সংযুক্ত থাকলে এমন হয়!
বঙ্গবন্ধু তার যে আত্মজীবনী লেখার কাজ শুরু করেছিলেন তা শেষ হয়নি। সেখানে তিনি লিখছেন-‘পানির দেশের মানুষ আমরা।পানিকে বড় ভালবাসি। আর মরুভূমির ভিতর এই পানির জায়গাটুকু ছাড়তে কত যে কষ্ট হয় তা কি করে বোঝাবো!’ এ যেন এক গভীর আর্তি ‘

শেখ মুজিবর রহমান, একজন প্রখ্যাত ও সফল রাজনীতিবিদ তিনিও কিনা নদী- জলের জন্য আবেগি, অনুভবি। নদীভিত্তিক উন্নয়ন, নদীকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা সেসব কথা পরে বলছি কিন্তু এই যে এভাবে নিজের পরিচয়কে বারবার বিধৃত করা এটা সম্ভব তখনই যখন বুকের ভিতর সে সম্পর্কে  গভীর ভালবাসা থাকে। আসলে বিশ্বনন্দিত হলেও তিনি পল্লিপ্রকৃতির। সেটাই তাঁর আপন পরিচয়। আর এই পরিচয় নিয়েই তিনি ঘুরেছেন সমগ্র বিশ্ব।সে সম্পর্কে পরে আমরা তার মেয়ের কথা শুনবো। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা।

আসলে টুঙ্গিপাড়ার নদীর কথা তিনি আজীবন ভুলতে পারেননি।নদীমায়ের সাথে সন্তানসম তাঁর সম্পর্কের কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। এবং বাংলাদেশ যেহেতু নদীনির্ভর, যাত্রাপথে নদী মিশে আছে অনিবার্য ভাবে। বঙ্গবন্ধুর কথায় বারবার আমরা উঠে আসতে দেখি নদী, নৌপথ, নৌকায় যাতায়াত অথবা ভ্রমণ ইত্যাদি। বস্তুত তিনি ছিলেন নদীবেষ্টিত জেলা গোপালগঞ্জের সন্তান। তাই নদীর গুরুত্ব তিনি বুঝতেন।

তিনি যখন রাষ্টের দায়িত্ব নেন তখন তো বাংলাদেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত। পুরোমাত্রায় বিপর্যস্ত। কোনোভাবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।সেইসময়ও যে তিনি নদীর কথা ভাবছেন। নদীকে ঘিরে পরিকল্পনা করছেন তার প্রচুর উদাহরণ আছে। তাই যদি না হবে তাহলে তিনি দায়িত্বভার নিয়েই নদী খননের জন্য চেষ্টা করবেন কেন? তিনি তার দূরদর্শিতা দিয়ে বুঝেছিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পর পাকিস্তান ‘খনক’ নামে যে ড্রেজার রেখে যেতে বাধ্য হয়েছিল শুধুমাত্র তার দ্বারা পরি অপসারণ বা নদী খননের কাজ সম্ভবপর হবে না।তাই তিনি আরো ড্রেজার আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ডেল্টা-1, ডেল্টা – 2, ড্রেজার -135,ড্রেজার-136, ড্রেজার -137,ড্রেজার-138 ও ড্রেজার- 139 যেগুলো এখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের সম্পদ।

নদী ও নৌপথের বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দেখলে প্রধানমন্ত্রীত্বের সাথে সাথে তিনি বেশ কিছুদিন নৌ- মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব নিতে পারেন।
আসলে তিনি জানতেন যে, বাংলাদেশের যদি উন্নতি করতে হয় তাহলে নদীকে ভাল রাখতে হবে। তাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হল দেশীয় ও আন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তিনি নদীকে নিদারুনভাবে নির্ভর করতেন। এক্ষেত্রে ভীষণভাবে উল্লেখযোগ্য মংলা-ঘষিয়াখালির 31 কিমি নৌপথ খননের কাজ। 1974 সালে চালু হওয়া এই নৌপথটির মূল উদ্দেশ্যই ছিল সুন্দরবনকে অক্ষত রেখে মংলা সমুদ্রবন্দরের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অল্পদূরত্বের বিকল্প পথের সন্ধান। মংলা- ঘষিয়াখালি নৌপথের জন্য তাঁর বারবার তদ্বির মনে রাখার মতো।পরবর্তীতে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ ‘ভারত-বাংলাদেশ নৌবানিজ্য প্রটোকল রুট‘-এর মধ্যে আসে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম সহকারে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দেশের অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন জায়গা থেকে ভারতের সাথেও পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

একটা গল্প বলি। একবার তিনি নদীপথে ভ্রমণ করছেন। সঙ্গী কিংবদন্তী লোকগায়ক আব্বাসউদ্দিন। নৌকায় বসে আব্বাসউদ্দিনের গান শুনতে শুনতে তাঁর মনে হল আব্বাসউদ্দিনের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের কন্ঠে না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত।বঙ্গবন্ধুর মনে হচ্ছিল যে নদীর ঢেউগুলিও যেন আব্বাসউদ্দিনের গান শুনছে। নদীর প্রতি নিখাদ ভালবাসা না থাকলে এমন বর্ণনা সম্ভব? আবার নদীর প্রতি নিতান্তই আবেগ ও ভালবাসা নয় নদী ব্যবস্থাপনার কথাও তিনি বলেছেন জোরের সাথে।

আমি নিজে বেশ কয়েকবার ঢাকাতে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছি যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী রক্ষার বিষয়ে উদ্যোগী ও তৎপর। কিন্তু তার এই ভাবনা যে তার পিতার কাছ থেকে এসেছিল সেটা বিভিন্ন ভাবে জানা যায়। বর্তমানে আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে দেখি যে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে ভারতের অংশে আত্রেয়ীর 42 কিমি খননের প্রস্তাব দিয়েছেন। কেননা তারা আত্রেয়ী (বাংলাদেশে আত্রাই) নদীর মাধ্যমে পুনরায় ভারত-বাংলাদেশ নৌপথ পরিবহনের সম্ভাবনা খুলতে চায়। এই ভাবনা গুলি কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাবনার অনুসারী নয়?

আসলে বঙ্গবন্ধুর জীবনে নদী ছিল খেলার দোসর, পরবর্তীতে উন্নয়নের সাথী।বাংলাদেশের প্রতিটি নদীর গায়ে লেখা আছে বঙ্গবন্ধুর নাম- এমন টা বললেও অত্যুক্তি হয়না মোটেই। একবার চীনে হ্যাংচা লেকে তাঁর নৌকা চালানো দেখে চীনের স্থানীয়রা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে নদী ছিল তাঁর জীবন।নদীর সাথে সখ্যতা ছিল নিবিড়। তাই পরবর্তীতে দেশের দায়িত্ব পেয়েও সেই ছোটবেলার খেলার সাথীকে ভোলেননি। তাকেই নির্ভর করেছেন।

বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় একবার লিখেছিলেন-
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান।

লেখাটা একশো শতাংশই সত্যি। এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের মানুষের পরিচয়ের সাথে মিশে আছে নদী।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাকে ভালবেসে বুকে স্থান দিয়েছেন আর দেশ হিসাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাকেই নির্ভর করেছেন। নদী ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক জোর দিয়েছিলেন যিনি তারই নাম শেখ মুজিব। আর তাকেই আপামর বাঙালি ‘বঙ্গবন্ধু’ নামেই চেনে।

ঋণস্বীকার:
এক) বঙ্গবন্ধু, নদ-নদী-নৌপথ ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থা: আশীষ কুমার দে
দুই) বঙ্গবন্ধুই নদী ও সুন্দরবণ সুরক্ষার পথদ্রষ্টা: JagoNews24.Com
তিন) নদী সুরক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সারাজীবন: শেখ রোকন

সংশ্লিষ্ট বিষয়