অদ্বৈত মল্লবর্মণ: তিতাস একটি নদীর নাম

তিতাস

।। পলাশ মজুমদার ।। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের ভূমিকায় অদ্বৈত লিখেছেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়, রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়ে ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।’

এক.
বাংলা সাহিত্য কেবলমাত্র একটি উপন্যাসের জন্য একজন লেখকের কাছে ঋণী থাকবে। উপন্যাসটির নাম—‘তিতাস একটি নদীর নাম’, আর তার অমর স্রষ্টা কল্লোলযুগের নিভৃতচারী এক অসাধারণ প্রতিভাধর লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)। জন্মেছিলেন বৃটিশ ভারতের অখণ্ড বাংলা প্রদেশের তৎকালীন কুমিল্লা জেলাধীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার গোকর্ণঘাট গ্রামে, ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি, এক দরিদ্র মালো পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল অধরচন্দ্র বর্মণ। শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন হন তিনি। শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ দেখে এগিয়ে আসেন গ্রামের মানুষজন। অদ্বৈতকে গ্রামের মালোদের চাঁদার টাকায় লেখাপড়া করতে হয়েছে।

দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত অদ্বৈতর ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান-পিপাসা ছিল প্রগাঢ়, ছিল অজানাকে জানার দুর্বার কৌতূহল। তার সঙ্গে ছিল সাহিত্যানুরাগ আর বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা। তীব্র জ্ঞান-স্পৃহার কারণে ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে অবস্থিত অন্নদা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও আর্থিক দৈন্যের কারণে অধ্যয়ন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শুধু জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে ১৯৩৪ সালে কলেজ-পর্ব ঘুচিয়ে গমন করেন মহানগরী কলকাতায়। কলকাতায় কিছুদিন কষ্টে কাটলেও অচিরে ‘মাসিক ত্রিপুরা’ পত্রিকায় শুরু করেন কর্মজীবন। সাংবাদিক হিসেবে। এর বছর দু’য়েক পরে ক্যাপ্টেন নরেন দত্ত পরিচালিত ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন তিনি। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত কবি ও লেখক ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র’। প্রেমেন্দ্রর সংস্পর্শ তাঁর ভেতরের সুপ্ত সাহিত্য-প্রতিভাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তোলে। অচিরেই নবশক্তির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদকের সহকারী হিসেবে যোগদান করেন এবং একটানা তিন বছর এ পদে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এ-সময়ে একই সঙ্গে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায়ও সাংবাদিকতা করেন তিনি। তাছাড়া নবযুগ, কৃষক এবং যুগান্তর পত্রিকায়ও সহকারী সম্পাদকের পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আরো উপার্জনের আশায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা শাখায়ও খণ্ডকালীন চাকুরি করেন তিনি।

দুই.

‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদকের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটির কয়েকটি অধ্যায় সর্বপ্রথম ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসটি বন্ধু-বান্ধব ও পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তারপরই এই উপন্যাসটির পান্ডুলিপি হারিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় ধারাবাহিক প্রকাশনা এবং তিনি খুবই মর্মাহত হয়ে পড়েন। অতি আগ্রহী পাঠকের সনির্বন্ধ অনুরোধ এবং বন্ধুদের চাপাচাপিতে তিনি পুনরায় লেখা শুরু করেন কাহিনিটি।

তার কিছুদিন না যেতেই ১৯৫১ সালে তিনি কাল-ব্যাধি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন; কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে পরিণতির কথা ভেবে এই গ্রন্থের পান্ডুুলিপি দিয়ে যান এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হাতে। হাসপাতাল থেকে কলকাতার নারকেলডাঙার ষষ্ঠীপাড়ার নিজ বাড়িতে নিয়ে আসলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পরে সেই বন্ধুর প্রচেষ্টায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলা সাহিত্যের অনন্য সাধারণ প্রতিভা হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃতি লাভ করেন।

উপন্যাসটির সামগ্রিক মূল্যায়ন ও বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনীকার অধ্যাপক শান্তনু কায়সার বলেন, ‘তিতাস জীবনের শেকড় প্রাকৃত জীবনের গভীরে প্রোথিত। এই প্রাকৃত জীবনকে বাইরে থেকে যতই সরল দেখাক, এর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে তা বহু ভঙ্গিমা ও বৈচিত্র্যের অধিকারী।’

এই বিখ্যাত উপন্যাসটির কাহিনীকে উপজীব্য করে বাংলা চলচ্চিত্রের অমর স্রষ্টা ‘ঋত্বিক ঘটক’ ১৯৭৩ সলে নির্মাণ করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহের কারণ হিসেবে প্রখ্যাত এ চলচ্চিত্র-নির্মাতা বলেন—

‘তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খণ্ড জীবন, এটি একটি সৎ লেখা । ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে (দুই বাংলাতে) এ রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো—সব মিলে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল।……… অদ্বৈতবাবু অনেক অথিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে ভেতর থেকে, প্রাণ থেকে লেখা। আমি নিজেও বাবুর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। তিনি এর পরের পুনর্জীবন দেখতে পাননি। আমি দেখাতে চাই যে, মৃত্যুর পরেও এই পুনর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।’

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের সমগ্র সাহিত্যিক জীবনের অবিনশ্বর কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অনেক সাহিত্যবোদ্ধা বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায় এই শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটিকে প্রথম সারিতে রাখার পক্ষপাতী। ঘটনার বর্ণনায়, চরিত্রের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে, উপস্থাপনার সাবলীলতায়, শব্দ নির্বাচন ও ভাষার প্রাঞ্জলতায় তিনি অসাধারণ দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তিনি একজন, তাদেরই কাহিনি তিনি বর্ণনা করেছেন এই উপন্যাসে। ফলে তাঁকে আশ্রয় নিতে হয়নি কোনো কৃত্রিমতার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ধীবর জীবন নিয়ে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মতো কালজয়ী উপন্যাস লিখলেও সেটা ছিল বাইরে থেকে দেখা, কারণ তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণের সন্তান। অন্যদিকে অদ্বৈত ছিলেন প্রতিকূল সংঘাতে ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসা মৎস্যজীবী ‘মালো’ সম্প্রদায়ের একজন। তিনি তাঁর আজন্ম অভিজ্ঞতা, সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি ও শৈল্পিক রচনাশৈলীর মাধ্যমে জেলে সমাজের কঠিন জীবন-সংগ্রামের সাধারণ কাহিনীকে করে তুলেছেন অসাধারণ ও অবিনশ্বর। তিতাস নদী ও তিতাস পারের বঞ্চিত-শোষিত-নিপীড়িত খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রাকে শিল্পীর নিপুণ তুলিতে নিখুঁতভাবে এঁকেছেন। ফলশ্রুতিতে কিশোর, সুবল, অনন্ত, বনমালী, বাসন্তী প্রমুখ চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

তিন.

অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর ৩৭ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাড়াও তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো এক পয়সায় একটি, সাদা হাওয়া (উপন্যাস), সাগর তাথৈ, নাটকীয় কাহিনী, দল বেঁধে (গল্পগ্রন্থ), রাঙামাটি, জীবনতৃষ্ণা (অনুবাদ : লাস্ট ফর লাইফ)। এছাড়া তিনি শিশু-পাঠ্য বেশ কিছু কবিতাও রচনা করেছেন। কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হলে ওই সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে বেশ ঔৎসুক্য দেখা যায়।

অকৃতদার ও নিঃসঙ্গ অদ্বৈত ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ছিলেন মিতব্যয়ী ও স্বল্পাহারী, তেমনি লাজুক ও নিভৃত পরোপকারী। অমানুষিক পরিশ্রমে অভ্যস্থ অকৃপণ মানবতাবাদী এই মানুষটি তাঁর পরিশ্রমলব্ধ অর্থের অধিকাংশই ব্যয় করতেন স্বজনহীন দুঃস্থ মানুষ ও অসহায় আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে। বই-প্রেমিক অদ্বৈত চরম আর্থিক অনটনের মধ্যেও প্রচুর বই কিনতেন। কারণ পড়া ছাড়া তিনি থাকতে পারতেন না।
চার.

অদ্বৈত মল্লবর্মণের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং জেলা পরিষদের অর্থায়নে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাটে মল্লবর্মণের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর পূর্ণাঙ্গ আবক্ষ-মূর্তি স্থাপন করা হয় যা বিলম্বে হলেও একজন গুণী ব্যক্তির প্রতি তাঁর স্বদেশবাসীর কৃতজ্ঞতা-স্বীকারের একটি ক্ষুদ্র নমুনা বলে অভিহিত করা যায়।

পলাশ মজুমদার: কথাসাহিত্যিক।

 ।। রিভার বাংলা-য় প্রকাশিত কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি ।।

নদীর বই- জলের লেখাজোকা-য় আরও পড়ুন…

‘মহানদী’, এক সাধারণ পাঠকের অনুভব
“দুই বাংলার নদীকথা”- নদীমাতৃক বাংলার বিশ্বকোষ

সংশ্লিষ্ট বিষয়