খরস্রোতা সময়, তবু সরস্বতী নদীর প্রাসঙ্গিকতা : সাতকর্ণী ঘোষ

কিংবদন্তীর নদীরা

কবিরা নদীকে বলেছেন জীবন, আবার জীবনকে নদী। কবিরা নদীকে বলেছেন নারী, আবার নারীকে নদী। আসলে নদী মানে তো আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। আমাদের ভৌগোলিক ভুবনে আলাপ-আলাপনের এক আশ্রয়। নৌকোর সঙ্গে ‘পরকীয়া’।

কবেকার সেই বনলতা সেনের মতো। তার জন্যে আমাদের হাজার বছর ধরে হাঁটা। নদী ছিল তখন ব্রহ্মার কাছে। সগর বংশের পুত্রদের বাঁচানোর জন্য ভগীরথের তপস্যায় নদী মর্ত্যে নমে এল। মধ্যে নদীর তীব্র বেগ মহাদেব তাঁর মস্তকের জটাজুট জালে ধারণ করলেন। ভগীরথের তপস্যায় মর্ত্যে নামার পথে ঘটল এক বিপত্তি। যাত্রাপথের মাঝে তপস্যারত জহ্নু মুনির আশ্রমের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ভেসে গেল নদীর স্রোতে। মুনি ক্রুদ্ধ হয়ে নদীকে এক গন্ডুষে সম্পূর্ণ উদরস্থ করলেন। ভগীরথ পুনরায় তপস্যা করে তাঁকে তুষ্ট করলেন। তখন তিনি নিজের জহ্নু কেটে নদীকে মুক্তি দিলেন। নদী পুনরায় স্রোত পেল প্রবাহিত হল। জহু থেকে তার দ্বিতীয় জন্ম হল। নদীর নাম হল জাহ্নবী। তারপর নদীর জলধারা পাতালে গিয়ে সগর রাজার পুত্রদের পুনরায় সঞ্জীবিত করল।

ঋকবেদে নদীমাহাত্ম্য 

শং নো দেবীর অভিষ্টয়ে

আপো ভবন্তু পীতয়ে।

শং ঘোর অভি স্রবন্তু নঃ

|| 8 ||

শান্তচরণে এসো দেবি জল

তৃষ্ণা-শান্তি হও,

আমাদের দিকে

কল্যাণ সুখ-

শান্তিধারায় বও [ অনুবাদ ঙ্ম গৌরী ধর্মপাল ]

আপঃ পূণীত ভেষজং

বরূথং তন্ত্রে মম।

জ্যোকচ সূর্যং দৃশে

॥৭॥

হে জল, ভেষজ করো হে পালন

এ দেহ আমার রক্ষা করতে

সুদীর্ঘকাল সূর্য দেখতে [ অনুবাদ : গৌরী ধর্মপাল ]

জলকে আমরা কোন্ দিব্য চোখে দেখব তার সূত্র ব্রহ্মদত্তের এই মুক্তিতে যা

গৌরী ধর্মপালের অনুবাদে এমনটা—

এখনো জলকে সামনে রেখে পুজার আসনে বসি।

সেই জলে টেনে আনি উত্তর-দক্ষিণ

পুব-পশ্চিম ভারতের সপ্ত নদীকে-

গঙ্গে চ যয়নে চৈব গোদাবরী সরস্বতী।

নর্মদে সিন্ধু-কাবেরি জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুরু।।

মন্ত্রটি সম্ভবত বেদের নদ-নদী আদলে গড়া—

ইমং মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতী শুভদ্রি স্তোমং সচতা পরুষ্যা।।

অমিক্যা মরুদ্বধে বিতস্তয়া আৰ্জীকিয়ে শৃণুহি-আসুযোনয়া [১০/৭৫/৫]

লক্ষ্যণীয় ঋকবেদে উল্লেখিত দশটি নদীর মধ্যে একটি সরস্বতী। অবশ্য একজন সরস্বতী দেবী হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বাগদেবী এবং নদীর দেবী। নদী-সুক্তে

[১০/৭৫/৫] বলা হয়েছে । “হে গঙ্গা! হে যমুনা সরস্বতী শতদ্রু ও পরুফি! আমার এই স্তবগুলি

তোমরা ভাগ করে নাও।’

ঋকবেদের আর একটি সুক্তে সরস্বতী নদীর কাছে প্রার্থনার কথা আছে।

সরস্বতৌ দূষদত্যৌ দেবনদ্যৌ যদন্তারম্।

ত্বং দেবনির্মিতং দেশং ব্ৰহ্মাবর্ত্ত প্ৰচক্ষতে৷৷

সরস্বতী ও দৃসদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী এক দেশের নাম ব্রহ্মাবর্ত। এই ব্রহ্মাবর্তে বসেই ঋষিরা বেদ রচনা করতেন।

চর্যাপদে নদীমাতৃক বাংলাভূমি

ভবণই গহণ গম্ভীর বেগে বাহী।

দুআন্তে চাখিল মাঝে ন যাহী

ধার্মাথে চাটিল সাক্কম গড়ই

পারগামি লৌঅ নিভর তরই।।

পটিল্লপাদের এই পদে বলা হয়েছে গহীন গভীর নদী ভীষণ বেগে ব’য়ে যাচ্ছে। তার দু’ধারে কাদায় পা ডুবে গেলেও মাঝখানে কোনো থই পাওয়া যায় না। এই নদী পারাপারের জন্যে তার ওপর কাঠের একটি পুল তৈরি হওয়ার অনেক ভাবনার অবসান ঘটেছে। যদিও নদীর কথাটি জানানো পদকর্তার উদ্দেশ্য নয়। নদী এবং সাঁকোর রূপকে কবি সহজ সাধনায় সিদ্ধি লাভের কথা বলেছেন।

শুধু চর্যাপদ কেন যেকোনো সাহিত্যে নদীর প্রতীকী ভূমি কাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্র সাহিত্যে নদীর অসামান্য ভূমিকা রবীন্দ্রপাঠক মাত্রেই জানেন।

কেন নদী, কোন্ তাৎপর্যে নদী এসব ভাবতে ভাবতে বেদ থেকে চর্যাপদ। চর্যাপদ থেকে জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান ও দর্শন মনস্কতার সমীকরণ। ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থের ‘জনীরথীর উৎস সন্ধানে’ প্রবন্ধ থেকে কয়েক পঙক্তি!

“নদী তোমার সহিত আমার সখ্য। বাল্যকাল হইতে, তুমি আমার জীবন বেষ্টন করিয়া আছ, আমার জীবনের এক অংশ হইয়া গিয়াছ, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ, জানি না। আমি তোমার প্রবাহ অবলম্বন করিয়া তোমার স্থান দেখিয়া আসিব।’

তাইতো নদীর জন্যে আমাদের আবহতা তৃষ্ণা। অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।’ ‘উশতীর্ ইব মাত্তরঃ’। আবারও বেদ থেকে চয়ন। আর অনির্দেশ কোনো নদী নয়, এবার সরস্বতীতে আমাদের হার্দিক নিবেদন। যেন সরস্বতীই বুক খুঁড়ে শস্য, বৃক্ষ এবং অরণ্য ধারণ করে আমাদের লালনপালন করেছেন। একটি নদীর কাছে আমাদের পরম নির্ভরতা। তার বুকে নৌকো নামাতে পারলে আমাদের শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রা।

একটু দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা করতেই হল। নইলে সরস্বতী মাহাত্ম্যকে বুঝব কী অর্থে। কি করে অনুভব করব তার অপরিমেয় বেদনার কথা!

পুণ্যতোয়া-র কথা-বৃত্তান্ত

বাপী ঠাকুর তাঁর নদী ভাবনার আকর থেকে একটি গ্রন্থ লিখলেন। গ্রন্থটির মুদ্রণ এবং সর্বজনজ্ঞাতার্থে প্রকাশনও হল। গ্রন্থের নাম ‘পুণ্যতোয়া সরস্বতী’। প্রাকৃকথন রচনা করলেন তাঁর পিতা সু সাহিত্যিক দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী। বইটি আলোচনার জন্য গ্রহণ করতে সহজ হল। সরস্বতী নদীর উৎপত্তি ইতিহাসের কথা নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে সূত্র নিয়ে সরস্বতীর আত্মপ্রকাশের নানা ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক বৃত্তান্তে রূপরেখা আঁকলেন। তিনি সাহসিক উচ্চারণে একথা আমাদের জানিয়ে দিলেন যে সরস্বতীর সামগ্রিক বিলুপ্তির পিছনে একশ্রেণির স্বার্থলোভীদের মানসিকতাও ক্রিয়াশীল ছিল। প্রাকৃকথনটি গ্রন্থের সোনার পালক।

গ্রন্থের যে রচনাবিন্যাস উল্লেখের দাবি রাখে এই শিরোনামগুলি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সরস্বতী নদী, সরস্বতীর প্রবাহ, মন্ডগ্রাম, বেতড়, সরস্বতীর অববাহিকায়, সরস্বতী নদী আন্দোলন, সরস্বতীর অপমৃত্যু ইত্যাদি।

হাওড়া এবং হুগলি জেলার যে অংশ নিয়ে আলোচ্য নদীটি প্রবাহিত সেই অংশের নাম সুক্ষদেশ। প্রাবন্ধিক তাঁর এই মন্তব্যের সুত্র পেয়েছিলেন নীহার রঞ্জন রায়ের লেখায় ‘গঙ্গা ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী দক্ষিণতম ভূখণ্ড অর্থাৎ বর্তমান বর্ধমানের দক্ষিণাংশ লর বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলাই প্রাচীন সৃক্ষ জনপদ।’ -[বাঙালীর ইতিহাস]

গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর একসঙ্গে ত্রিবেনী বলা হয়। সরস্বতীর নানা যাত্রাপথ ও প্রবাহ সম্পর্কে নানা অভিমতের সঙ্গে পরিচিত হয়েও তার বর্তমান ফেলে যাওয়া গতিপথ সম্পর্কে বলা যায় এটি ত্রিবেনীর কাছে হুগলি শহরের উত্তরে ভাগীরথী থেকে নির্গত হয়ে হাওড়ার বলুবাটীতে শীর্ণ প্রবাহ রূপে প্রবেশ করেছে। তারপর দক্ষিণে সর্পিল ভাবে রাজাপুর খাল পশ্চিমে রেখে ডোমজুড় ও আন্দুল পার হয়ে সাঁকরাইলের দক্ষিণে গঙ্গায় পতিত হয়েছে। এ প্রবাহ খুবই সংকীর্ণ। অথচ পাঁচশো বছর আগে এই নদীর নাব্যতা পর্তুগীজদের বাণিজ্যতরী যাবার মতো।

শ্রীযুক্ত বাপী ঠাকুর বিভিন্ন প্রবন্ধে সরস্বতীর ঐতিহ্যের নানা বহরের কথা উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পরিবৃত্তে এবং জনসংস্কৃতির চরিত্রায়ণে এই নদীর ভূমিকা অবিসংবাদিত সত্য। কিন্তু আমাদের কষ্ট হয় যখন তিনি লেখেনঙ্গ তরতর করে বয়ে যাওয়া সরস্বতীর আর নেই।’ একটা ঐতিহ্যের অপমৃত্যু থেকে জন্ম নেয় ‘সরস্বতী নদী বাঁচাও কমিটি’ ডোমজুড় এবং পাশ্ববর্তী সমাজসচেতন মানুষরা যেন নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের এক একজন মেধা পাটেকর। এই গ্রন্থে রয়েছে সেই আন্দোলনের প্রস্তুতি, বিকাশ এবং সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি। কিন্তু আন্দোলনকারীদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। এখন অর্থই জলের মধ্যে এই নদী বিষয়ক ভাবনাটি হাবুডুবু খাচ্ছে।

তবু ‘পুণ্যতোয়া সরস্বতী’গ্রন্থের লেখক ইতিহাস সচেতন লেখক বাপী ঠাকুর সামাজিক দায়বদ্ধতার একটা বড়ো জানালা আমাদের সামনে খুলে রাখলেন। তিনি সকলের অভিনন্দন গ্রহণ করুন এই প্রকাশনার জন্যে।

পূন্যতোয়া সরস্বতী – বাপী ঠাকুর চক্রবর্তী।

সাতকর্ণী ঘোষ : বিশিষ্ট কবি, সম্পাদক-আন্তর্জাতিক কবিতা পত্রিকা এবং সারঙ্গ সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্য সংগঠক। ভারতের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত। এযাবত ‘নির্বাচিত কবিতা ’গ্রন্থ সহ ২০ টিকাব্যগ্রন্থ। ইংরেজি অনুবাদ কবিতাগ্রন্থ ৩ টি, গল্পগ্রন্থ, ছড়াগ্রন্থ, উপন্যাস, গবেষণাগ্রন্থ এবং সম্পাদিত গ্রন্থ ২৬ টি। কবিতার আমন্ত্রনে আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামে গেছেন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়