নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও – বালুরঘাট কনভেনশন রিপোর্ট

বালুরঘাট

নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও এই স্লোগানকে সামনে রেখে গত ২৮-২৯ জুলাই ২০১৮, ভারতের বালুরঘাট শহরের সুবর্ণতট সভাগৃহে বালুরঘাট কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ভারতের নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মী তাপস দাস। বালুরঘাট কনভেনশন রিপোর্টটি কলকাতা থেকে “রিভার বাংলা” ডট কমের জন্য পাঠিয়েছেন তিনি।- সম্পাদক

নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে দেশ জুড়ে। সেই লক্ষ্যে বালুরঘাট কনভেনশন অনুষ্ঠিত হলো গত ২৮-২৯ জুলাই ২০১৮, বালুরঘাট শহরের সুবর্ণতট সভাগৃহে। বালুরঘাট কনভেনশন আহায়ক শ্রী বিশ্বজিৎ বসাক অথিতিদের বরণ করেন। এরপর বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য শ্রী বিপ্লব মিত্র মহাশয় দ্বারা নদী ইস্তেহার প্রকাশ করার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ্য সমাবেশ শুরু হয়। এরপর একে একে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, নদী বিশেষজ্ঞ, নদী কর্মী, সমাজ কর্মী সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা আলোচনা করেন নদী ব্যাবহারের ধারণা পদ্ধতি বদলের মধ্য দিয়ে নদীকে বাঁচিয়ে তোলা এবং বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। এই বিষয়ে রাজ্য সহ গঙ্গা সমভূমি অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক ভাবে এই ধরনের কনভেনশনের আয়োজন করে চলা হচ্ছে।

এই কনভেনশনের মাধ্যমে নদী ইস্তেহার-এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলা এবং উত্তরবঙ্গসহ অন্তর্দেশীয় নদী সমস্যা কে জনসমক্ষে তুলে ধরা ছিল অনতম লক্ষ। ওড়িশা থেকে আসা প্রতিনিধি আসা প্রতিনিধি ডা শরৎচন্দ্র পান্ডে ওড়িশার প্রধান নদী মহানদী এবং তার উপর গড়ে ওঠা হীরাকুঁদ বাঁধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্তমান সময়ে ছত্রিশগড় ওড়িশার মধ্যে জল বন্ঠন সংক্রান্ত সমস্যা তুলে ধরেছেন। তার মতে বড় বাঁধ এর সমস্ত সফলতা-বিফলতা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন, কারণ প্রায় প্রতিটি বাঁধ অন্তঃরাজ্য বা দেশীয় সম্পর্ক ব্যহত করেছে ভারত উপমহাদেশে।

এরপর নদী বিশেষজ্ঞ শ্রী সুপ্রতিম কর্মকার স্লাইড শো ‘নদী বৃত্তান্ত’ -র মাধ্যমে বাংলার নদী-জল চিত্রসহ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হারিয়ে যাওয়া নদী- বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি বলেন ছোট ছোট নদীর খড়ি – পুকুর- দীঘি এই সময় নিয়েই একটি নদীর গতিপথ এবং বেগময় জীবন, তাই বড় নদী বাঁচাতে ছোট নদী – খাড়ি- জলাশয় কে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন নদী পাড়ের মানুষকে নদী আন্দোলনে যুক্ত করা প্রয়োজন ও সেই লক্ষ্যে তাঁর প্রস্তাব নদীকেন্দ্রিক আত্মনির্ভর ‘নদী সভা’ গড়ে তোলা। যে সপ্রব্যাবস্থাপননা গড়ে তুলবে স্থানীয় ভাবে। নদী সভা থেকেই উঠে আসবে নদীর নদীর সমস্যা এবং নদীকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। পঞ্চায়েতস্তর থেকে দেশ জুড়ে তোলা ‘নদী সভা’-তে নদীর কথা তুলে ধরার কাজ করবে।
বিহার থেকে আগত বর্ষিয়ান সাংবাদিক তথা পরিবেশ কর্মী চন্দ্রশেখরম বাবুর কথার, যে কোশী নদীকে বিহারের দুঃখ বলা হত এখন সেই নদীই ‘দুঃখী* হয়েছে। পাড় বাঁধ আর ব্যারেজের শৃঙ্খলে নেপাল হিমালয় থেকে নেমে আসা বাগমতি, বুড়ি, গন্ডক, গন্ডি প্রভৃতি নদী আজ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে।

রিভার বাংলা ডট কমে আরো পড়ুন…

আত্রেয়ী নদীপাড়ে নদীকথা

চূর্ণীকথা : একটি নদীপ্রবাহের উৎসের খোঁজে – গৌতম অধিকারী

নদী বাঁচাতে অপূর্ব এক আত্মদানের কথা : গওহার নঈম ওয়ারা

মহারাষ্ট্র থেকে আসা বিশিষ্ট গান্ধীবাদি সমাজ ও পরিবেশ কর্মী অশোক ভারত বলেন- নদীর নিচেও নদী থাকে। বাঁধ তৈরি করে প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করার ফলে নদীর বহমানতাকে ধ্বংস করছে ও তার সঙ্গে নদী নির্ভর জীব বৈচিত্র্যর বাস্তুতন্ত্র আজ ভীষণ সংকটে পড়েছে। উন্নয়নের নামে হিমালয় যা উত্তর, উত্তর -পূর্ব ভারতের নদীর উৎস সেখানে ই নদীকে ধ্বংস করা হচ্ছে। দুই দিনের আলোচনায় বারবার জীব বাঁচানোর তাগিদে নদী বাঁচানোর কথা ওঠে। দেশের অবিলম্বে নদী নীতি গ্রহণ করার পক্ষে সওয়াল করেন বিভিন্ন প্রতিনিধিরা। বর্তমান সময়ের দাবি নদী সমস্যা তথা পরিবেশ সমস্যা দেশের মূল রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠুক সমস্ত বিকাশ নীতির আলোচনায় যখন উন্নয়ন বনাম পরিবেশ আলোচিত হচ্ছে সর্বত্রা দেশ তথা বিশ্বের কাছে জল সমস্যা ওকে ভীষণ সমস্যা, দেশ যথার্থ নদী নীতি গ্রহণ করতে না পারলে দেশের সমস্যা তীব্র হবে।

সুন্দরবন থেকে আসা প্রতিনিধি দীপক ভক্ত জানান সুন্দরবনের ১০ লক্ষ মানুষ নদী- জঙ্গল নির্ভরশীল অথচ এখনও ২০০৬ সালের বন অধিকার আইন লাগু হয় নি। সেখানে তাই গ্রাম সভা গঠন সহ আইন অনুযায়ী নাগরিক অধিকার থেকে সুন্দরবনবাসী বঞ্চিত , জীবিকা হারিয়ে তারা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। মালদা-মুর্শিদাবাদ জেলার নদী ভাঙ্গনের সমস্যা তুলে ধরেন ফারাক্কা থেকে আগত প্রতিনিধি মেহবুব আলম। তিনি রাজ্যসরকার ও ফারাক্কা ব্যারেজ কতৃপক্ষের এলাকার মানুষের সমস্যার প্রতি উদাসীন ব্যাবহারের কথা তুলে ধরেন। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিনিধিরা আলোচনা করেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই এই জেলার তিন দিকেই বাংলাদেশ। জেলার প্রধানত সাতটি নদীই বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করে ওই জেলা ঘুরে আবার বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে।

ভারত বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ৫৬ টি নদী, ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন তৈরি হলেও দুই দেশের মধ্যে জলবণ্টন ব্যাবসা অমীমাংসিত। নদী গুলির বহমানতা, নির্ভরশীল জনসংখ্যা, বাস্তুতন্ত্র বিষয়ে সঠিক আলোচনা জনসমক্ষে উঠে আসেনি ফলে জেলার কৃষক সেচের পাচ্ছেন না। মৎস্যজীবীরা তাদের জীবিকা হারিয়েছে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। নদীর জলবন্ঠন শুধুমাত্র রাজনৈতিক বোঝাপড়া বা কারিগরী ব্যাবস্থাপনা নয়, নদী নির্ভরশীল মানুষের অংশ গ্রহণ ব্যাতিত, সঠিকভাবে জনসংখ্যা ও বাস্তুতন্ত্র এর সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ ব্যাথিত নদী কমিশন সফল হতে পারে না। তাই নদী সভা গঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের অংশগ্রহণ এবং নদী ও নদী নির্ভরশীল জীবের পুনরুজ্জীবনের পথ খোঁজার উদ্যোগে গ্রহণ করতে হবে।

বিপ্লব মিত্র মহাশয় রাজ্য সরকারের জল ধরো জল ভরো ও NRGEA প্রকল্পেকে কাজে লাগিয়ে নদী পুনজীবনের উদ্যোগকে তুলে ধরেন।

কনভেনশনের দ্বিতীয় দিনে সর্বসম্মতিতে নির্মল, অবিরল গঙ্গার দাবিতে মাতৃ-সদন আশ্রমে স্বামী সদানন্দ জি-র অনশনের সমর্থনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। নদী নীতিসহ তার প্রস্তাবিত গঙ্গার জন্য পৃথক আইনের প্রতি সমর্থন জানান সকলে।

লেখক : তাপস দাস- নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মী, কলকাতা,ভারত।

সংশ্লিষ্ট বিষয়