বাংলাদেশকে ‘নদীমাতৃক’ বলা হয় শুধু এই কারণে নয় যে, দেশটির সভ্যতা, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশ সবই নদীর আশীর্বাদধন্য।
বলা হয় এই কারণেও যে, খোদ ভূখণ্ডটি গড়ে উঠেছে এবং এখনও দক্ষিণে সম্প্রসারিত হচ্ছে নদীবাহিত পলি সিঞ্চনে। এমনকি আর পাঁচটা ব-দ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য হচ্ছে, নদ-নদী কেবল ভূখণ্ডটি গড়েই তোলেনি, এর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেও ভূমিকা রেখেছে।
যে কারণে অনেক সময় রিভারাইন পিপল থেকে আমরা বলে থাকি- বাংলাদেশের ‘প্রকৃতি থেকে প্রতিরক্ষা’ সবই নদীর অবদান।
প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে নদী ঐতিহাসিক কাল থেকেই অবদান রেখে আসছে। কেউ কেউ মনে করেন, আলেকজান্ডার বাংলা তথা পূর্ব ভারতে আসেননি মূলত নদীপথের বাধার কারণে। সুলতানি ও মুঘল আমলে মধ্যবঙ্গে রাজধানী স্থাপন করা হয়েছিল এর চারপাশে নদীঘেরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণেই।
মহান মুক্তিযুদ্ধেও আমরা নদীর সুফল দেখতে পাই। নদ-নদী থেকে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা সুবিধা পেতেই মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি আক্রমণের জন্য বর্ষাকাল অবধি অপেক্ষা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে নদ-নদীর অবদান ফুটে উঠেছে সেই সময় নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনে।
পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ পাঠিয়েছেন।
এ সব প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ নিয়ে পরবর্তীকালে প্রকাশ হয়েছে একটি বই। সেখানেই তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের নদ-নদী কীভাবে ‘দ্বিতীয় বাহিনী’ হয়ে উঠেছিল। ১৩ এপ্রিল ডেটলাইনে তিনি- বাঙালিরা নির্ভর করছে বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির ওপর, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যা শুরু হবে।
পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের জটিল পথ- গাঙ্গেয় বহ্মপুত্র জলধারা ও সহস্র নদীর আঁকিবুকি- পশ্চিম প্রদেশের শুষ্ক ও পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত পাঞ্জাবি ও পাঠানদের কাছ অপরিচিত। যখন বর্ষায় নদী ফুলে উঠবে এবং মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়বে, তখন এই অপরিচিতি আরও বাড়বে।
‘আমরা এখন বর্ষার অপেক্ষায় রয়েছি’, বললেন এক বাঙালি অফিসার। ‘তারা পানিকে এত ভয় পায় যে, আপনি ভাবতেই পারবেন না এবং আমরা হচ্ছি জলের রাজা।
তারা তখন ভারি কামান ও ট্যাংক নিয়ে চলতে পারবে না। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী’। (ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান/ সিডনি শনবার্গ/ মফিদুল হক অনহৃদিত/ সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৫)।
ব্যক্তিগতভাবে বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গোড়াতেই। মূলত নিউইয়র্ক টাইমসে পাঠানো সংবাদ ও বিশ্লেষণের সংকলন ওই বইয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও নদী ও প্রকৃতির বর্ণনা সিডনি শনবার্গ সম্পর্কে বিশেষ শ্রদ্ধা তৈরি করেছিল।
তার প্রতিবেদনগুলোতে দেখা যায়, যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও তিনি পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির বর্ণনা দিতে ভোলেননি। যেমন- ১৬ ডিসেম্বর ডেটলাইনে যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকামুখি পথের বর্ণনা দিতে দিয়ে লিখেছেন- ‘কোথাও কোথাও এমনকি দেখা যায় ধানক্ষেতের পাশের নালায় মাছের উদ্দেশে ঝাঁপ দিচ্ছে মাছরাঙা পাখি।
কাছের কলাবাগানে সবুজ নারিকেল বীথির নিচে চরে বেড়াচ্ছে গরু। বস্তুত অনেক সময় এটা বোঝা কঠিন হয়ে ওঠে যে, এই দেশকে স্পর্শ করেছে একটা যুদ্ধ…।’
প্রসঙ্গত, সিডনি শনবার্গ ১৯৭৬ সালে পুলিৎজার পান; ২০১০ সালে প্রকাশ হয় তার বই ‘বিয়োন্ড দ্য কিলিং ফিল্ড’। এর তৃতীয় অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে একাত্তরের বাংলাদেশ অভিজ্ঞতা। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে ৮২ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
রিভার বাংলা ডট কমে আরো পড়ুন…
উৎসবে নদী দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়, দূষণ মোকাবিলায় করনীয় কি?
তাড়াইলে নদী ভাঙ্গন, দেখার কেউ নেই!
জীবদ্দশায় তার হৃদয়ে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে ছিল। বাংলাদেশ সরকার ‘মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু’ হিসেবে তাকে সম্মানিত করতে চেয়েছিল; কিন্তু হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচারের কারণে তার দীর্ঘ বিমানযাত্রা নিষিদ্ধ ছিল বলে ঢাকা আসতে পারেননি।
প্রশ্ন জাগে, খোদ বাংলাদেশের সংবাদপত্র বা পরবর্তীকালের বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতারসহ বৃহত্তর পরিসরের সংবাদমাধ্যমে নদী কীভাবে এসেছে? আর কিছু না হোক সংবাদপত্রের নামের ক্ষেত্রে নদীর প্রভাব যে এড়ানো কঠিন, বলা বাহুল্য।
২৫ মার্চ-পরবর্তী হানাদার অবরুদ্ধ ঢাকায় যখন প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের দফতর ছিল ভস্মীভূত, জনশূন্য; যখন ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের সামনেও কঠিন বর্তমান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ; তখন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহর ছাড়াও প্রত্যন্ত থানা সদর থেকেও একের পর এক প্রকাশ হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংবাদপত্র।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে প্রকাশিত এ ধরনের ৬৪টি সংবাদপত্রের তালিকা পাওয়া যায়। হাতেগোনা কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া বাকি সবই সাপ্তাহিক, পাক্ষিক অথবা সাময়িকী। এগুলো বেশিরভাগই হাতে লিখে বা সাইক্লোস্টাইল করে প্রকাশ হতো। এর মধ্যেও আমরা দেখতে পাই ‘উত্তাল পদ্মা’ নামে একটি পত্রিকা, সম্পাদক ছিলেন আবু সাঈদ খান।
নদীর নামে সংবাদপত্রের নামকরণের ধারা পরবর্তীকালেও অব্যাবহত ছিল, বলা বাহুল্য। গত বছর জুন মাস পর্যন্ত প্রকাশনা ও চলচ্চিত্র অধিদফতরে নিবন্ধিত দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সংখ্যা ২ হাজার ২১৭। এর মধ্যে সরাসরি নদী বা নদী-সংশ্লিষ্ট নামে রয়েছে ৬৮টি।
অবশ্য ভোলা, ফেনী ও নোয়াখালী যদি নদীর নাম হিসেবে ধরা যায়, তাহলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৭তে। কারণ এই তিন জেলার নামকরণ যদিও নদীর নামে, সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে নদী না জনপদ কোনটি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে অনুসন্ধানসাপেক্ষ। সংবাদপত্রগুলোর তালিকা দিয়ে এই লেখা দীর্ঘ না করলেও চলে।
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, সম্প্রচারে থাকা বা সম্প্রচারের অপেক্ষায় থাকা মোট চ্যানেলের সংখ্যা ৪৩টি। এর মধ্যে মাত্র দুটি নদীর নামে- যমুনা ও তিতাস।
এ ছাড়া নদী ও সাগরের মিলনস্থলকে প্রতিনিধিত্বকারী নাম ‘মোহনা’। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি বেতারও জনপ্রিয় ও সম্প্রসারিত হয়েছে।
সরকারি, বেসরকারি ও কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের সংখ্যা এখন ৩৮। এর মধ্যে তিনটি কমিউনিটি রেডিও নদীর নামে- রাজশাহীর রেডিও পদ্মা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেডিও মহানন্দা ও কক্সবাজারের রেডিও নাফ।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে আধেয় যদি বিবেচনা করি, অনেক বছর পর্যন্ত কেন্দ্রীভূত ছিল শহুরে বিষয়াবলীতে।
মফস্বল থেকে শুধু সংঘাত-সংঘর্ষ ধরনের সংবাদগুলোই স্থান পেত। সত্তর ও আশির দশকে এই ধারা ভাঙেন ‘চারণ সাংবাদিক’ মোনাজাত উদ্দিন। তার প্রতিবেদনগুলো নাগরিকদের নতুন করে দেখতে শেখায় গ্রামবাংলাকে। কিন্তু তার প্রতিবেদনগুলোতেও ঠিক নদী উঠে আসে না।
মোনাজাত উদ্দিনের ‘কানসোনার মুখ’ বইটি ওই গ্রাম নিয়ে তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের সংকলন। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার কানসোনায় ১৯৮৭ সালে প্রথম ও ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার গিয়ে গ্রামটি নিয়ে যথাক্রমে ১৯ ও ৮ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লেখেন ‘সংবাদ’ পত্রিকায়।
দু’বারই তিনি ‘মরা-প্রায়’ করতোয়া বা ফুলঝোর নদী পেরিয়েছেন, লিখছেন ভূমিকায়; কিন্তু নদীটি তার ২৭ পর্বের একটিতেও ‘সাবজেক্ট’ হয়ে উঠতে পারেনি! এমন না যে নদী তখন স্বাভাবিক, তিনি নিজেই লিখেছেন ‘মরা-প্রায়’।
কেন একটি নদী মরছে, সাংবাদিকের মনে অন্তত খটকা লাগা উচিত নয়? একই কথা বলা চলে তার ‘পথ থেকে পথে’ নিয়ে। নদী তীরবর্তী জনপদগুলোতে গেছেন; কিন্তু নদী তার প্রতিবেদনের বিষয় হয়ে ওঠেনি। এমনকি মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ কাভারের সাফল্য তাকে স্থায়ী চাকরি দিয়েছিল; কিন্তু সেখানেও সাবজেক্ট ছিল লংমার্চ, গঙ্গা নদী নয়।
বস্তুত খোদ পরিবেশ সাংবাদিকতা সংবাদপত্রের জন্য আলাদা ‘বিট’ হয়ে উঠেছে আরও পরে। পরিবেশ বিটের মধ্যেও নদী ও পানি ইস্যু ক্রমেই স্বতন্ত্র ইস্যু হয়ে উঠছে। ঠিক কবে থেকে সংবাদপত্রে নদী বিশেষ মনোযোগ পেতে থাকলো? আমার পর্যবেক্ষণে এর তিনটি দিক রয়েছে।
একটি অভিন্ন নদী সংক্রান্ত; সেটা গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর থেকেই। অপরটি নদীর দুর্যোগ সংক্রান্ত, বিশেষত ভাঙন।
আশির দশকের শেষ দিকে নদী ভাঙন সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন বিশেষ মাত্রা পেতে থাকে। আর নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয় যেমন বন্যা, বাঁধ ব্যবস্থাপনা সংবাদমাধ্যমের নজরে আসতে থাকে ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর থেকে।
নব্বইয়ের দশকের আগে নদীতে দখল প্রকট হয়ে ওঠেনি। দহৃষণ থাকলেও তা ছিল সংবাদমাধ্যমের নজরদারির বাইরে।
নদী ঘিরে সংকট যত বেড়েছে, সংবাদমাধ্যমে এই ইস্যুর উপস্থিতি তত গাঢ় হয়েছে। নদীকেন্দ্রিক পর্যটন বহু দিন পর্যন্ত ছিল আলোকপাতের বাইরে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে উপজীব্য হতে থাকে নাব্য সংকট, পানি বণ্টন, দখল, দহৃষণ, বাঁধ, পর্যটন, ভাঙন প্রভৃতি নদীকেন্দ্রিক বিষয়।
এসব নিয়ে সংবাদের পাশাপাশি বিশ্লেষণ, কলাম, সাক্ষাৎকার যুক্ত হয়েছে আরও পরে, আমার পর্যবেক্ষণমতে একুশ শতকের গোড়ায়। সেদিক থেকে দেখলে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় নদীবিষয়ক সাংবাদিকতার ধারা শুরু হয়েছিল।
একই সময়ে নদী বিষয়ক সাংবাদিকতার তাত্ত্বিক ভিত্তিও গড়ে উঠতে শুরু করে। এর প্রথম সার্থক উদাহরণ ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘রিভারস অব লাইফ’ বইটি।
পরিবেশ সাংবাদিক ক্যালি হ্যাগার্ডের সম্পাদনায় বিসিএএস ও প্যানোসের উদ্যোগে প্রকাশিত বইটিতে ১৫ জন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম বিশেষজ্ঞের লেখা ছিল। এর মহৃল আলোকপাত ছিল আশির দশকের ফ্লাড একশন প্লান বা ‘ফ্যাপ’। পরে ১৯৯৬ সালে বইটির বাংলা সংস্করণ ‘জীবনের জন্য নদী’ প্রকাশ হয়।
একই সময়ে আমরা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা থেকে ‘পরিবেশ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা’ (১৯৯৬) বইটি প্রকাশ হতে দেখি।
প্রয়াত মোহিউদ্দিন ফাহৃক এবং ফিলিপ গাইন, সফিক চৌধুরী সম্পাদিত বইটিতে পরিবেশ সাংবাদিকতা নিয়ে আধা-তাত্ত্বিক আলোচনায় নদ-নদীর বিষয়টিও স্থান পায়।
গত আড়াই দশকে নদী বিষয়ক সাংবাদিকতা কলেবরে আরও অগ্রসর হয়েছে, বলা বাহুল্য। গত এক দেড় দশকে সংবাদমাধ্যামের মিছিলে সংবাদপত্রের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে টেলিভিশন, আরও ভেঙে বললে টিভি সাংবাদিকতা। এটাও নদীর সুরক্ষার আন্দোলনে নিঃসন্দেহে নতুন মাতা যুক্ত করেছে।
সংবাদপত্রে যা স্থিরচিত্র বা অক্ষরে বোঝাতে হতো, টেলিভিশন সাংবাদিকতায় তা সবাক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই বোঝানো যায়। জনসাধারণ খুব দ্র“তই ‘কমিউনিকেট’ করতে পারে। একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায়, কীভাবে দখল বা দহৃষণ চলছে। যারা এর জন্য দায়ি তাদের পলায়নপর চেহারাও কালেভদ্রে মেলে। বুক ফুলিয়ে ক্যামারার সামনেই নদী হত্যা যায়েজ করার ঘটনাও কম নয়।
দৃশ্যমাধ্যমে সংবাদের বাইরেও আমরা নদী বিষয়ে টক শো দেখে থাকি, বিশেষ বিশেষ সময়ে। এসব আয়োজনও নদী সম্পর্কে জনসাধারণের বোঝাপড়া বাড়াতে নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখছে।
ক্যামারায় উঠে আসা নদীর কল্লোলিত সৌন্দর্যও অনেকের নষ্টালজিয়া বা নদীযাত্রা বাড়াতে যে সক্ষম, তার প্রমাণ আমরা বিভিন্ন সময়ই পেয়েছি। এই প্রসঙ্গে অনলাইন সংবাদমাধ্যমেরও প্রসার কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নদী বিষয়ক পো¯দ্বও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, নদী বিষয়ক সংবাদ বা সাংবাদিকতার মাত্রাগত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটেছে ঠিকই, গুণগত পরিবর্তন এসেছে কি? পুরনো পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে- কলেবরে ও বিস্তৃতিতে বাড়লেও গুণগত পরিবর্তন সেই গতিতে বাড়েনি। বিশেষত আন্তঃসীমান্ত বা অভিন্ন নদীর মতো জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে সাংবাদিকতায় আমাদের আরও উন্নতি দরকার।
যারা নদী নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কাজ করেন, তাদের তরফে এমন অভিযোগ ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকবারই শুনেছি। যদিও তাত্ত্বিক ও কারিগরি পর্যায়ে এ ব্যাপারে খুব কম কাজ হয়েছে।
২০১৪ সালে আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অ্যান্ড নেচারাল রিসোর্সেস) থেকে প্রকাশ হয়েছিল ‘অ্যান এনালিটিক্যাল রিভিউ অব মিডিয়া রিপোর্টস: কনটেক্সট অব ট্রান্সবাউন্ডারি আসপেক্টস অব দ্য তিস্তা রিভার’।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বাগড়ায় তা ভেস্তে গিয়েছিল।
ওই সফরের আগে-পরে সংবাদপত্রের প্রবণতা বিশ্লেষণ করা হয়েছিল এতে। ভারত ভূষণ সম্পাদিত এই আধেয় বিশ্লেষণে ভারতের ছয়টি ও বাংলাদেশের তিনটি ইংরেজি সংবাদপত্র ছাড়াও দুই দেশের চারটি ইংরেজি ম্যাগাজিনের সংবাদ ও ভাষ্যকে আমলে নেওয়া হয়েছিল।
এতে বলা হচ্ছে, নদী বিষয়ক সাংবাদিকতায় দুই দেশেরই ‘জাতীয়তাবাদী প্রবণতা’ প্রকৃত চিত্র উঠে আসার অন্তরায়। এছাড়াও আরেকটি বড় ঘাটতির বিষয় হচ্ছে বিস্তারিত প্রেক্ষিত বা ‘ডিটেইলড কনটেক্সচুয়ালাইজেশন’ ধরতে না পারা।
নিরেট তথ্য-উপাত্তের বদলে ধারনাপ্রসহৃত ভাষ্য প্রদান আরেকটি সীমাবদ্ধতা দুই দেশের সংবাদপত্রেই। এমনকি যেসব তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও উৎস ছিল অনুপস্থিত। দাফতরিক নথি থেকে উদ্ধৃতির অভাব এবং সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সরাসরি বক্তব্যও খুব কম ছিল সেখানে।
গত আড়াই দশকে নদী ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমের অনেক অবদান রয়েছে, স্বীকার করতে হবে। আমার মতে, নহৃ্যনতম আরও তিনটি পরিবর্তন আনতে পারে সংবাদমাধ্যম। এর প্রথমটি হচ্ছে, কিছু ভাষা ও ভঙ্গিগত পরিবর্তন। যেমন মহৃলত ভাঙনের কারণে নদীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের একটি রেওয়াজ সংবাদমাধ্যমে রয়েছে। যেমন নদীকে ‘রাক্ষসী’ বলে সম্বোধন করা; তার ‘করাল’ গ্রাসের কথা বলা।
এই ভাঙন যে আসলে নদীর আর্তচিৎকার; উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে তার ছটফটানি- এই চিত্র নদীর প্রতি সহানুভূতির সঙ্গে তুলে ধরতে হবে সংবাদমাধ্যমে। কারণ উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে অথবা উজানে বা ভাটিতে অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে নদীর প্রবাহ মন্থর হয় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পলি জমে নদীর বুক উঁচু হয়। হঠাৎ প্রবাহ বেড়ে গেলে দেখা দেয় ভাঙন।
স্বল্প পরিসরে দ্বিতীয় যে বিষয়ে পরিবর্তন দাবি করা যেতে পারে, তা হচ্ছে নদী দখল-দূষণ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সংখ্যা বাড়ানো। এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘প্রভাবশালী’ বলে দখলদার ও দহৃষণকারীদের চিহিক্রত করা হয়ে থাকে সংবাদমাধ্যমে।
এখন সময় এসেছে নদী হন্তারকদের নাম-ঠিকুজি ধরে প্রকাশ করা। এটা ঠিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা এতটাই ‘প্রভাব’ ধারণ করেন যে সংবাদমাধ্যমে নাম-ঠিকুজি প্রকাশ হলেও খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কিন্তু তাদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহিক্রত করার সামাজিক তাৎপর্য বিরাট।
অন্যান্য দুর্নীতিবাজ, অপরাধীর মতো তারাও সমাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটার আগে দু’বার ভাববে। তৈরি হবে মনো-পারিবারিক চাপ।
তৃতীয় বিষয়টি একজন নদী-কর্মীর দিক থেকে দেখা। আমাদের নদ-নদী যেখানে মুমর্ষ এবং প্রতিদিন পরিস্থিতির ক্রমে অবনতি হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের উচিত নদীর প্রশ্নে তাত্ত্বিক ‘অবজেকভিটি’ থেকে বের হয়ে আসা। বস্তুত জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে বা জরুরি পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমের এমন ভূমিকা নজিরবিহীন নয়।
আমাদের দেশেও ভাষা আন্দোলনে, ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায়, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সংবাদপত্র জনস্বার্থে ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়ক নীতি ও তত্ত্বের বেশ খানিকটা ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল। নদী যেহেতু আমাদের নদীমাতৃক দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, উৎপাদন, যোগাযোগ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রতিরক্ষার প্রাণপ্রবাহ; দখল, দহৃষণ, ভাঙন, পানি সংকট থেকে নদীকে বাঁচাতে সংবাদমাধ্যমের আবারও তেমন ভূমিকা প্রত্যাশা করা আর যা-ই হোক অসঙ্গত হতে পারে না।
আর সংবাদমাধ্যম, সংবাদপত্র হোক, টেলিভিশন হোক, অনলাইন পোর্টাল হোক- এর গুরুত্ব নদী সুরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ও ক্রমোবর্ধনশীল।
বস্তুত, নদী নিয়ে বিশেষজ্ঞ, গবেষক, মাঠকর্মীরা যেসব কথা বলেন, যেসব দাবি তোলেন; সংবাদমাধ্যমের যোগ ও যুক্তি সেটাকে বহুগুণ প্রবৃদ্ধি দিতে পারে। আমরা নদী-কর্মী বা গবেষক অথবা বিশেষজ্ঞরা উজান থেকে পানি প্রত্যাহার বন্ধ করা বা ভাটির দেশের ন্যায্য অধিকারের কথা অনেকদিন ধরেই বলছি।
মানব বন্ধন করে, সেমিনার করে, বিক্ষোভ সমাবেশ করে বহুবারই বলা হয়েছে যে, কীভাবে নদীতীরের দখল উচ্ছেদের পর কয়েক দিনের মধ্যে আবার বসে যায়; কীভাবে ওইসব দখলের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকায় থাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পক্ষগুলো; কীভাবে হাইকোর্টের আদেশ অনুসারে নদীর সীমানা খুঁটি বসাতে গিয়ে আসলে জেলা প্রশাসনগুলো প্রকারান্তরে দখলকেই বৈধতা দেয়; কীভাবে কাজীর ইটিপি কেতাবে থাকলেও গোয়ালে থাকে না।
এসব ইস্যু যখন কোনো সংবাদমাধ্যমের পরিসরে স্থান পায়, এক একজনের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে হাজার কিংবা লাখো কণ্ঠস্বর। বলা হয়ে থাকে, একটি ছবি হাজার শব্দের সমান। নদী নিয়ে ব্যক্তির কণ্ঠ যখন সংবাদমাধ্যমে যায়, তা হয়ে ওঠে হাজারো কণ্ঠ।
লেখক : নদী বিশেষজ্ঞ, মহাসচিব, রিভারাইন পিপল। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, প্রকাশ ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।।