নদীর জন্য আত্মবলিদান করছেন মানুষ : আসুন আমরাও সোচ্চার হই

Tapas Das
সনাতন ভারতবর্ষকে চেনা হয় সাধু-সন্তদের দেশ রূপে। কিন্তু একের পর এক সাধু সন্যাসীর বেশধারী ভন্ডের কৃত্তিকলাপ আর রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত ধর্মীয় ভাবাবেগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের দেশে। ফলে “ধার্মিক বা সন্ন্যাসী” শব্দ সন্দেহ আর ভীতির সঞ্চার করছে । সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্ববাদীর হাতে একের পর এক প্রগতিশীল মানুষের হত্যা, দেশদ্রোহী,শহুরে নকশালের নামে কবি লেখক চিন্তাবিদ, সমাজ কর্মীদের অনৈতিক গ্রেপ্তার হচ্ছে যা সাধারণ মানুষের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে চলছে। দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতা বেড়ে চলেছে
সনাতন ভারতবর্ষে ছিল প্রকৃতি নির্ভর জীবন যাপন, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি এবং প্রকৃতি এবং মানুষের নেওয়া ও ফিরিয়ে দেওয়ার চক্রাকার বন্ধন। তীব্র ভোগবাদ ও ব্যক্তি স্বার্থ সেই বন্ধনকে খণ্ডিত করার চেষ্টা করে চলেছে।
অপর দিকে, একই সাথে চলছে এই বন্ধন অটুট রাখার প্রচেষ্টা। আর এই প্রচেষ্টা, এই বর্তমান সময়ে আত্মকেন্দ্রিক ভোগ সর্বস্ব  যুগে, চলছে
আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে। এমনই ধারাবাহিক আত্মবলিদান দিয়ে চলেছেন সনাতন ধর্মের উত্তরসূরী একের পর এক সাধু ব্রহ্মচারী। আর তা চলছে দেশের মানুষের অগোচরে বছরের পর বছর ধরে।
নদীর জন্য আত্মবলিদান করছেন মানুষ
নদীর জন্য আত্মবলিদান করছেন মানুষ। ছবি সূত্র: নেচার ফার্স্ট, কলকাতা।
কঙ্খল এর মাতৃসদন আশ্রম এমনই এক ব্যাতিক্রমী আশ্রম, যাঁরা ধর্মকে ব্যবসার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার  না করে ধর্মকে অন্তঃকরনের শুদ্ধি এবং জীবন প্রবাহের ধারক এবং বাহকে রূপে ব্যাবহার করেছেন । ১৯৯৭ সালে আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয়, তারপর থেকেই গঙ্গার উপর অবৈধ বালি ও পাথর খননের  বিরুদ্ধে সোচ্ছার হন এই আশ্রমের সন্যাসীরা। হরিদ্বার থেকে কঙ্খল পর্যন্ত পূরাণে বর্ণিত “কুম্ভ ক্ষেত্র” বাঁচানোর লড়াইয়ে দেশের মধ্যে ব্যাতিক্রমী ভূমিকা পালন করে চলেছেন এই আশ্রমিকরা।এ এক আন্দোলন ও বটে। জনসম্মুখে প্রকৃতির বিরুদ্ধে অত্যাচারের নির্মম রূপ এবং গঙ্গা নদীর পৌরাণিক থেকে ভৌগোলিক গুরুত্ব প্রচার করে চলেছেন। আইনি ও প্রশাসনিক লড়াই এর সঙ্গে, আশ্রমে একের পর এক সন্ন্যাসী অনশন তপস্যার মাধ্যমে প্রাণ আহুতি দিচ্ছেন। ধারাবাহিক আত্মবলিদানে নিবেদিত সন্যাসীদের ঘিরে না আছে কোন কপট শিষ্যদের ভীড়, না আছে দেশের সংবাদমাধ্যম। সরকারে থাকা হিন্দুত্বর ধ্বজাধারী বিজেপি সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন শুধু নয়, ষড়যন্ত্র করে একেরপর এক অনশনরত সন্ন্যাসীকে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে আর হত্যা করা হচ্ছে তাঁদের।
অনশন তপস্যা বা গঙ্গা নদীর অবিরল-নির্মল ধারার স্বার্থে যে সমস্ত সন্যাসীগণ আত্মবলিদান দিয়ে চলেছেন:
পরিবেশকর্মী অধ্যাপক জিডি আগরওয়াল
স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ: এর পূর্ব নাম প্রফেসর জি ডি আগরওয়াল, যিনি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ এবং আই আই টি র অধ্যাপক ছিলেন। কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদের সচীব থাকাকালীন পরিবেশ রক্ষার্থে অনেক কাজ করেছেন। তিনি হিমালয় ক্ষেত্রে প্রকৃতি সংরক্ষণ তথা গঙ্গা নদীর অবিরল ধারার প্রবক্তা ছিলেন। এই কারণে গঙ্গার ওপর বাঁধ দেওয়ার বিরোধীতা করেছেন আজীবন। বর্তমান কেন্দ্র সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও সানন্দজীর মতের সমর্থক ছিলেন এবং তার সাথে গঙ্গার ওপর বাঁধ দেওয়ার বিরোধিতাও করেছেন। স্বামী সানন্দজী গঙ্গা নদীকে রক্ষা করতে শেষ পর্যন্ত ২২শে জুন ২০১৮ থেকে অনিশ্চিত কালীন অনশন করেন অথচ নিজেকে গঙ্গা পুত্র বলা শ্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার না গঙ্গাকে বাঁচাতে না এই প্রকৃত গঙ্গা পুত্রকে (সানন্দজী) বাঁচাতে কিছু করেছেন। উপরন্তু এই অসহিষ্ণু সরকারের অসংবেদনশীলতা অনশনের ১১১ তম দিনে ১১ ই অক্টোবর ২০১৮ মা গঙ্গার এই পুত্রকে আত্মবলিদান দিতে হলো। স্বামী সানন্দজী এর আগে ২০০৯ এবং ২০১৩ তেও দীর্ঘদিনের অনশন করেছিলেন।  তাঁর মৃত্যু প্রশাসনের ষড়যন্ত্র করে হত্যা, এই মত মাতৃসদন সহ তাঁর অসংখ্য অনুরাগীর।
সন্ত্ গোপাল দাস : স্বামী সানন্দজীর অনশনরত অবস্থায় রহস্যজনক মৃত্যুর পর দ্বিতীয় সন্ন্যাসী সন্ত্ গোপাল দাস জী অনশন শুরু করেন। এনাকে প্রথমে দিল্লির এইমস্ এ ভর্তি করা হয় এবং সেখান থেকে তিনি নিখোঁজ হন। মাতৃ সদনের কর্মকর্তারা বিক্ষোভ দেখালে তাকে ২৯ নভেম্বর ২০১৮ এইমস্ হৃষিকেশে আনা হয়। ডাক্তারেরা প্রথমে বলেন যে সন্ত্ গোপাল দাস জীর ডেঙ্গু হয়েছে এবং তিনদিন পর হঠাৎই তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। ৬ই ডিসেম্বর ২০১৮ পুনরায় ঋষিকেশ এইমস এ তাঁকে নিয়ে আসা হয় সেখান থেকে আজ পর্যন্ত তিনি নিখোঁজ। দিল্লী হাই কোর্ট’এ হেবিয়াস করপাস আইনে মামলা করেও কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
মাত্র ২৬ বছর বয়সী ব্রহ্মচারী গঙ্গা বক্ষে অবৈধ খনন, বৃক্ষছেদন এবং গঙ্গার ওপর শ্রেনীবদ্ধ বাঁধ দেওয়ার বিরোধীতায় স্বামী আত্মবোধানন্দজী ২৪ অক্টোবর ২০১৮ থেকে অনিশ্চিতকালীন অনশন শুরু করেছেন। অবিরল ও নির্মল গঙ্গার সংকল্পের আত্মবলিদান দিতে নিবেদিত। তাঁর মত যে, “সরকার গঙ্গাকে হত্যা করছে। আমি একজন সন্ন্যাসী। আমার অনশন মানুষকে জাগ্রত করার জন্য এবং তাদের এই উপলব্ধি প্রদান করতে”। দেশে উন্নয়নের নামে নদী ব্যবহারের যে ধারণা ও পদ্ধতি চলছে তা নদীর জন্য বিপদ নিয়ে এসেছে। এরআগে ১৯৯৮ সালে মাতৃসদন আশ্রমের সন্যাসী স্বামী গোকুলানন্দ খনি মাফিয়া দ্বারা নিহত হন। ২০১১ সালে কুম্ভ ক্ষেত্রে অবৈধ বালি ও পাথর খননের বিরুদ্ধে অনশন তপস্যায় ১১৫ দিন কাটিয়ে, আত্মবলিদান দেন স্বামী নিগমানন্দ। মাতৃসদন আশ্রমের দাবী তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে হাসপাতালে। ২০১৪ সালে সন্যাসী বাবা নাগনাথ অবিরল গঙ্গার দাবীতে বেনারসে অনশন তপস্যার মাধ্যমে প্রাণ ত্যাগ করেন।
গাঙ্গেয় সমভূমি জুড়ে যে “নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও” আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে, তার তরফে আমাদের বিশ্বাস এই সন্যাসীদের আত্মবলিদান পরিবেশ সচেতন প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে নদী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাওয়া নদী কর্মীদের উদ্যোগ থেকে পৃথক নয়। তাই আমাদের আবেদন ব্রহ্মচারী আত্মবোধানন্দজী’র অনশনের  দাবী মেনে “কেন্দ্র সরকার অবিরল ও নির্মল গঙ্গা ফিরিয়ে দেওয়ার এবং অবিলম্বে তরুন সন্যাসীর প্রাণ রক্ষা করতে যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করুক”।

আরো পড়তে পারেন….

কুয়াকাটায় শুরু চতুর্থ আন্তর্জাতিক জল সম্মেলন

নদী চেতনা বাড়াতে নদীপাড়ের মেলা আয়োজক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া উচিত

সংশ্লিষ্ট বিষয়