গত প্রায় এক দশকে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় কুষ্টিয়া অঞ্চলের নদনদীর করুণ অবস্থা নিয়ে অনেক প্রতিবেদন খেয়াল করেছি। প্রতিবেদনগুলোর শিরোনাম প্রায় একই রকম ছিল। যেমন হুমকির মুখে কুষ্টিয়ার আট নদী, কুষ্টিয়ার আট নদীতে দখলের মহোৎসব চলছে, কুষ্টিয়ার আট নদী বিলীন হওয়ার পথে অথবা কুষ্টিয়ার আট নদী এখন মরা খাল ইত্যাদি। এই নদীগুলোর বেশিরভাগই গঙ্গা-গড়াইয়ের শাখা নদী; যেমন- কালীগঙ্গা, ডাকুয়া, হিসনা, সাগরখালী, চন্দনা, মাথাভাঙ্গা, কুমার ইত্যাদি। বাংলাদেশের মোটামুটি সব অঞ্চলেই নদী দখল হয় এবং হচ্ছে। কিন্তু এ অঞ্চলের নদী দখল ও ভোগের চিত্রটা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ও ভিন্ন। এ অঞ্চলের অনেকেই মনে করেন, গঙ্গা নদীর উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং স্থানীয় দখলদারদের কারণে নদীগুলোর এই করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; যা উল্লিখিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ও বিষয়বস্তু থেকেও স্পষ্ট হয়।
বাংলাদেশের সার্বিক নদী ব্যবস্থায় ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও স্থানীয় দখলবাজির বিরূপ প্রভাবের কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে ফারাক্কা বাঁধের অনেক আগেই গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে এ অঞ্চলের এই শাখা নদীগুলোকে মেরে ফেলার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবের প্রয়োজন পড়েনি। ফারাক্কা বাঁধ ১৯৭৫ সালে চালু হওয়ার অনেক আগেই ১৯৫৪-৫৫ অর্থবছরে জিকে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। শুধু কুষ্টিয়া অঞ্চলের এই আটটি নদী নয়, জিকে সেচ প্রকল্প অঞ্চলের (কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা) প্রায় সব নদীই একই রকমভাবে করুণ অবস্থা বরণ করে। সে হিসেবে উল্লিখিত নদীগুলোকে জিকে সেচ প্রকল্প অঞ্চলের নদী বলে সাধারণীকরণ করাই শ্রেয়। তাতে এ অঞ্চলের নদীগুলোর ওপর জিকে প্রকল্পের বিরূপ প্রভাব স্বীকার করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আমি মনে করি, যে কোনো সমস্যা সমাধানের পূর্বশর্ত হচ্ছে এর মূল ও মৌল কারণকে স্বীকৃতি দেওয়া। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক চালিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই জিকে সেচ প্রকল্পের পাম্প হাউসটি গঙ্গা নদীর ডান তীরে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলায় স্থাপিত। এই সেচ ব্যবস্থায় গঙ্গা নদী থেকে ওই পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে আওতাধীন এলাকায় কৃত্রিম ক্যানেলের মাধ্যমে বণ্টন করা হয়। বৈশিষ্ট্যে এই প্রকল্প অঞ্চলও নদীমাতৃক বাংলাদেশের বাইরে নয়।
আরো পড়তে পারেন…
কলকাতা প্রেস ক্লাবে আলোচনা: নদী ও পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিক রাজনৈতিক দলগুলো
কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার এলংগী গ্রামের মধ্য দিয়ে গড়াই নদী থেকে শাখা হিসেবে ডাকুয়া নদী বেরিয়ে ঝিনাইদহ শৈলকুপার কচুয়া নামক জায়গায় কালিগঙ্গা নদীর সঙ্গে মেশে। উৎসমুখ থেকে এক-দুই কিলোমিটার ভাটিতে ‘চাপড়া ধর্মপাড়া’ নামক জায়গায় জিকে ক্যানেল এই ডাকুয়া নদীটিকে (কোনো রকম স্লুইস গেট স্থাপন না করেই) সরাসরি ক্রসিং করে। আর এ সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ভরাট, দখল, কৃষিজমি ও বাড়িঘর করে উৎসমুখের এই এক-দুই কিলোমিটার অংশ নদী হিসেবে ম্যাপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই একসময় এখানে নদী ছিল। নিজের চোখে দেখলে কারোরই আর সন্দেহ থাকবে না, কেন নদীর এই এক-দুই কিলোমিটার নদী হিসেবে ম্যাপে নেই! বরং সন্দেহ হবে নদীটির উৎসমুখ নিয়ে। কেউ এই ডাকুয়া নদীকে কালিগঙ্গার একটি শাখা মনে করতে পারে। তখন আবার প্রশ্ন আসবে, তাহলে কালিগঙ্গার উৎস কোথায়? এই কালিগঙ্গাও কুষ্টিয়া শহরের পাশে গড়াই নদী থেকে বেরিয়েছে। সেটিও একই কারণে উৎসমুখ থেকে বিচ্ছিন্ন। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত এই দুই নদী ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার কচুয়া নামক জায়গায় মিলিত হয়ে কিছুটা এগিয়ে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত অন্য এক নদী কুমারের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রায় একইভাবে ভেড়ামারা উপজেলায় মাতৃস্নেহ বঞ্চিত হয়েছে গঙ্গা নদী থেকে বেরিয়ে আসা হিসনা ও চন্দনা নদীও। উপায় কি ছিল না, এই নদীগুলোকে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত না করেই জিকে প্রকল্পের ক্যানেল টানা? উপায় ছিল। যেমন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সাগরখালী নদী। জিকে প্রকল্পের একটি ক্যানেল উপজেলার আমলা বাজারের পাশে খামারপাড়া গ্রামে নদীটিকে বিচ্ছিন্ন করে ক্রসিং করেছিল। যদিও ডানপাশে দুটি স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ রক্ষা করার একটি চেষ্টা করা হয়েছিল; কিন্তু কাজে দেয়নি। বর্ষাকালে আমলা ইউনিয়নের খামারপাড়াসহ নদীটির উজানের গ্রামগুলোয় বন্যা লেগেই থাকত। স্থানীয়দের মতে, এই বন্যার পানি প্রত্যাহারের জন্য সদরপুর ইউনিয়নের নওদা আজমপুরসহ ভাটির অন্যান্য গ্রামের সঙ্গে তাদের প্রায়ই সংঘর্ষ হতো। বাধ্য হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ‘সাগরখালী-বড়বিলা প্রকল্প’-এর আওতায় সাগরখালী সাইফুন নির্মাণ করে, যা সরকার ২০০৬ সালে উদ্বোধন করে। এই সাইফুনের মাধ্যমে সাগরখালী নদীটিকে বাধাহীনভাবে জিকে ক্যানেলের নিচ দিয়ে প্রবাহের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়।
তাহলে সাইফুনের এই ব্যবস্থা জিকে প্রকল্প অঞ্চলের অন্য সব নদীর ক্ষেত্রে কেন অনুসরণ করা হয়নি? যেমন ডাকুয়া নদীর উৎসমুখ বিচ্ছিন্ন অংশের অঞ্চলেও বন্যার দেখা দিয়েছিল। কিন্তু নদীটি জিকে ক্যানেলে উৎসমুখের খুব কাছাকাছি বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। যে কারণে খুব সহজেই গড়াই নদী খননের বালু ও মাটিতে উৎসমুখটি বন্ধ করে দিয়ে দখল করার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালী গ্রামে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি কুমার নদের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। এই নদী পরিদর্শনের সময় আমার সঙ্গে ছিলেন কুমার নদ সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আবদুলল্গা মারুফ। উৎপত্তিস্থলের প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে পারকুলা গ্রাম থেকে হাউসপুর পর্যন্ত প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার নদী দু’দিক থেকে দুটি স্লুইস গেট স্থাপন করে জিকে ক্যানেলের ভেতরে নিয়ে নেওয়া হয়। ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া উজানের এই ১৫ কিলোমিটার নদী এলাকাতেও ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হতো। এই অঞ্চলের মানুষও যখন ফুঁসে উঠছিল, তখন সরকার বাধ্য হয়ে উৎসমুখে একটি গেট (কপাট) তৈরি করে মুখটিকে এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েই জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ করেছে। নদীর ক্ষতি করে এভাবে যদি বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো, তাহলে হয়তো সাগরখালী নদীতেও সাইফুন পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো না। সেচ কাজের অজুহাতে জিকে প্রকল্পকে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অপরিহার্য করে অস্বীকার করা হয়েছে নদীর অপরিহার্যতাকে। জিকে প্রকল্প তাই অর্থনীতির অপরচুনিটি কস্ট যেমন, বিকল্প ভালো সুযোগটি গ্রহণ না করার মূল্য দিয়ে বরং এ অঞ্চলের কৃষি অভিযোজন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিকাজকে ভয়াবহ সংকটে ফেলে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গা নদীর বাংলাদেশ অংশে সেচের সময় তেমন একটা পানি থাকে না। জিকে প্রকল্পের তিনটি মূল পাম্পের মধ্যে বর্তমানে দুটি বন্ধ। তৃতীয়টি পানির অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মাত্র একটি পাম্প দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চার জেলার সেচের পানির জোগান দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় শাখা নদীগুলো বৃষ্টি ও বর্ষার পানি তেমন একটা ধরে রাখতে পারছে না। যে সেচ কাজের জন্য এই জিকে প্রকল্পের ক্যানেল এ অঞ্চলের নদীগুলোকে প্রায় মেরে ফেলল, সে প্রকল্পও আজ মৃত্যুপথযাত্রী! সেচের পানি না পেয়ে ধান ছেড়ে এলাকার মানুষ এখন ‘কম পানি’ চাহিদাসম্পন্ন ফসল যেমন আখ ও বাদাম চাষ করতে চায়। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। দুষ্ট এই জিকে প্রকল্প তাড়িত প্রভাবশালীদের নদী দখল ও (মৎস্য চাষ) অবৈধ বাঁধে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে এই অঞ্চল এ ধরনের কৃষি অভিযোজনও সম্ভব হচ্ছে না। এ ধরনের অবৈধ বাঁধের কারণে বৃষ্টি ও হাওরের পানি নদীতে নিস্কাশিত হতে পারছে না বিধায় ফসল ডুবছে।
আমরা বলছি না যে, জিকে প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। তবে যেখানেই জিকে ক্যানেলের সঙ্গে নদীর ক্রসিং হয়েছে, সেখানেই সাগরখালীর মতো সাইফুনের ব্যবস্থায় নদীকে প্রবাহিত করার সুযোগ করে দিতে হবে এবং খননের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া সব নদীর উৎসমুখ খুলে দিতে হবে। খরচসাপেক্ষ হলেও সরকারকে এ কাজটি করতে হবে। একসময় নড়াইলের রূপচাঁদ সাহা নামক এক লবণ ব্যবসায়ী তার বাণিজ্যিক নৌকা যাতায়াতের সুবিধার জন্য ভৈরব ও কাজিবাছা নদীর সঙ্গে সহজ সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে একটি খাল খনন করেছিলেন, যা পরে তার নামানুসারে রূপসা নদী হয়েছে। এক ব্যক্তি যদি পারে, তাহলে সরকার কেন পারবে না? সরকারকে পারতেই হবে পাকিস্তান আমলের ভুল ধারণা ও নদীশাসন থেকে বেরিয়ে আসার। তা ছাড়া সম্প্রতি চলা সরকারের গতানুগতিক দখলবিরোধী অভিযানে বিশেষত এ অঞ্চলের নদী রক্ষা পাবে না। সূত্র: সমকাল।
পরিচালক, রিভারাইন পিপল ও সাবেক সভাপতি, পরিসংখ্যান বিভাগ, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।