তুহিন শুভ্র মন্ডল পেশায় একজন শিক্ষক। ২০০৪ সাল থেকে তিনি নদী ও পরিবেশ রক্ষার কাজে যুক্ত আছেন। নদী ও পরিবেশ বিষয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স-এ অংশগ্রহণ করেছেন। ২০১০-১১ সালে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় পেয়েছেন আনন্দলোক (আনন্দ বাজার) সেলাম বেঙ্গল পুরস্কার। ২০১৫ সালে পেয়েছেন পথিক সম্মান। আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০১৬ সালে পেয়েছেন কলকাতার ঋক শীর্ষ সম্মান। ২০১৭ সালে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় পেয়েছেন বেস্ট এচিভারস অ্যাওয়ার্ড। সম্প্রতি তিনি কুয়াকাটায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক জল সম্মেলনে অংশ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে আসেন। এসময় তার সাথে কথা বলেন রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ।
আমরা জানতে পেরেছি আপনি এবার বাংলাদেশে এসেছেন নদী বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে, সে বিষয়ে জানতে চাই
অ্যাকশন এইড একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যা সমগ্র পৃথিবী জুড়েই নদী ও মানুষের অধিকার নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছে। তাদের ঢাকা অফিস বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাতে চতুর্থ আন্তর্জাতিক জল সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। যার বিষয় ছিল নদী। থিম ছিল- “রিভার-এ লিভিং বিয়িং”। নদী যে একটি জীবন্ত সত্ত্বা সেকথাই আমাদের মনে রাখতে হবে। এই সম্মেলন উপলক্ষেই আমি এসেছি।
এই সম্মেলন থেকে আগামী দিনের জন্য কি ধরনের সিদ্ধান্ত আসলো?
আমরা নদীমাতৃক সন্তান। নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে সভ্যতা। নদী আমাদের সংস্কৃতি ও জীবিকা গড়ে দেয়। এককথায় নদী আমাদের জীবন। নদীরও জীবন আছে। তার অধিকার নিয়ে দুদিন ধরে কথা হয়েছে। ছিলেন নদী গবেষক, নদী অধিকার কর্মী, নদী বিশেষজ্ঞ, প্রশাসক, জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান সহ আয়োজক অ্যাকশন এইডের কর্মকর্তা। আগামীতে নদীর অধিকারের জন্য, নদীর অধিকারের জন্য লড়াই আরো জোরদার করতে হবে, প্রশাসনকে বাধ্য করতে হবে-এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আলোচক, আয়োজক সবাই। এই ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়ার আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে।
গ্রেটার পশ্চিমবঙ্গে নদী রক্ষা আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা টা কেমন?
ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ নদীবিধৌত। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ব্যবহারকারী অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্ত: সীমান্ত নদীও আছে। এছাড়াও রয়েছে ভারতবর্ষের প্রধান নদী গঙ্গা।কিন্ত এইসময় নদীরক্ষা আন্দোলন খুব চ্যালেঞ্জের মুখে। দূষণ, দখল, নদী ভাঙ্গন ও নানাবিধ সমস্যায় জেরবার। বেশ কিছু নদী মৃতপ্রায়। কিছু নদী হারিয়ে গিয়েছে। নদী ও পরিবেশ কর্মীরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নদী বাঁচানোর কথা বলছেন। তথ্য-প্রমাণ সহযোগে। নদীবিহীন ভবিষ্যতের আশংকার কথা তুলে ধরছেন। প্রশাসন বিক্ষিপ্তভাবে সক্রিয় হচ্ছে। সরকারের চেতনার বড়ো অভাব। চেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। নদী রক্ষার পরিকল্পনা নিতে হবে। সেই পরিকল্পনাকে উদ্যোগে বাস্তবায়িত করতে হবে। এটাই সময়। নাহলে দেরি হয়ে যাবে। তাই নদী রক্ষার আন্দোলন আরও জোরদার করতে হবে।অনেক পথ হাঁটতে হবে আমাদের। গঠিত হয়েছে সবুজ মঞ্চ রাজ্য নদী নদী বাঁচাও কমিটি। রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রক্রিয়া চলছে। এই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নদী রক্ষার একটা ঐতিহাসিক দিকের সূচনা হচ্ছে কলকাতাতে। নদী কেন্দ্রিক যে সমস্যাগুলি স্থানীয় তাকে স্থানীয় ভাবে যে আন্ত:সীমান্ত সমস্যা আছে আন্তর্জাতিক ভাবে সমাধান করতে হবে।
ভারতে গঙ্গা নদী সুরক্ষা নিয়ে জোরালো আন্দোলন হচ্ছে, ইতোমধ্যে কয়েকজন সংগঠক মারাও গিয়েছেন
গঙ্গা নদীর সুরক্ষায় আন্দোলন করতে হচ্ছে এটাই তো লজ্জার। গঙ্গা ভারতবর্ষের প্রাণ, ঐতিহ্য। গঙ্গা আমাদের লাইফলাইন। অথচ তার সুরক্ষার জন্য লড়তে হচ্ছে মানুষকে। তার সন্তানরাই তার ক্ষতি করছে। গঙ্গা নিয়ে সচেতন করতে, কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করতে কিছুদিন আগে ভারতবর্ষের জলপুরুষ আখ্যায়িত রাজেন্দ্র সিং গঙ্গা সম্ভাবনা যাত্রা করেছেন দেশ জুড়ে। তার নির্মলতা, অবিরল ধারার দাবীতে অনশন করছেন নদী- চিন্তকরা। সরকারের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। অধ্যাপক জি.ডি. আগরওয়ালের মতো বিশিষ্ট মানুষ গঙ্গার জন্য প্রাণ দিলেন। কোন সভ্য দেশে এমন হয়? হয় না।আরও একজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন তবু অনশন ছাড়ছেন না। বর্তমান ভারত সরকার গঙ্গার জন্য নদীমন্ত্রক গড়েছেন, গঙ্গার নামে নাম দিয়েছেন, নমামি গঙ্গে প্রকল্প নিয়েছেন। তাতেও কিছ্ছু হয়নি। আমার প্রশ্ন গঙ্গার জন্য লড়তে হবে কেন? এটা লজ্জার নয়?
দক্ষিণ দিনাজপুরে আপনি আত্রেয়ী নদী সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছেন সে বিষয়ে জানতে চাই
দক্ষিন দিনাজপুরে দীর্ঘদিন ধরে আত্রেয়ী নদীর সুরক্ষায় আন্দোলন করছি। দু’হাজার ছয় সাল থেকে প্রথমে মূলত সচেতনতাভিত্তিক আন্দোলন হয়েছে। দু’হাজার চোদ্দ সাল থেকে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের অনুসারে আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলন হয়। মোহনপুরের রাবার ড্যামকে কেন্দ্র করে আত্রেয়ী নদী বাঁচানোর দাবী প্রবল হয়। আত্রেয়ী নদী ভারত-বাংলাদেশে প্রবাহিত একটি আন্ত: সীমান্ত নদী। বাংলাদেশের অংশে এর নাম আত্রাই। একে দুই দেশ মিলে একসাথে বাঁচাতে হবে। এবং সেই উদ্যোগ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। তাতে বিভিন্ন সময়ে যোগ দিয়েছে ছাত্র- ছাত্রী, নদী সচেতন নাগরিক, সিভিল সোসাইটির প্রাজ্ঞজন, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, গায়ক, নাট্যকর্মী প্রমুখ। তাতে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের নদী সচেতন নাগরিক। সেকথাই বক্তব্যের আকারে বলতে এসেছিলাম চতুর্থ আন্তর্জাতিক জল সম্মেলনে।
বাংলাদেশের নদী সুরক্ষা আন্দোলন নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
নদীমাতৃক বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশ তাই। নদী এখানে উন্নয়নের ধারক-বাহক। অথচ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বড়, মাঝারি, ছোট সব নদীর অবস্থাই উদ্বেগজনক। কোথাও কোথাও ভয়াবহ।দূষণ, দখল, নাব্যতা হ্রাসের সমস্যা ক্রমবর্ধমান।সেই নিয়ে মানুষও জাগছে। অ্যাকশন এইড, রিভারাইন পিপল, বাপা, পবা, নোঙর এবং আরো অনেক সংগঠন নদীর অধিকারের জন্য লড়ছে। সেই লড়াই ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।আবার কখনো উপজেলা, জেলা থেকে নদী সুরক্ষার বার্তা পৌছাছে কেন্দ্রে। সেটাও খুব ইতিবাচক,আশাব্যঞ্জক। অ্যাকশন এইডের আন্তর্জাতিক জল সম্মেলনে দেখলাম বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশের মানুষ এমনকি প্রান্ত মানুষ নদীর অধিকারের জন্য লড়ছে, নদীর সাথে যুক্ত তাদের জীবন-জীবিকার জন্য লড়ছে। হারিয়ে যাওয়া নদী পুনরুদ্ধারের জন্য সোচ্চার হচ্ছে। এটাই তো আশা জাগাচ্ছে। লড়াইয়ের রাস্তা কঠিন কিন্ত অসম্ভব নয়। নদীকে যে কোন ভাবে সুরক্ষা দিতেই হবে।বাংলাদেশের জন্যও এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে পুনরায় রাস্ট্র ক্ষমতায় ফিরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদীকে দখল ও দূষন মুক্ত করতে পরিষ্কারভাবে তার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। সেই ভাষণ খুব প্রত্যয়ী শুনিয়েছে। নদীর সীমানা চিহ্নিতকরণ ও দখল-দূষন মুক্ত করতে শুরু হয়েছে কর্মকান্ড বিভিন্ন ভাবেই। আশা করবো এটা আশা জাগিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে না। এখানেই নদী অধিকার কর্মীদের লেগে থাকতে হবে। আশার আলো যখন একটু দেখা যাচ্ছে তখন মায়ের জন্য সন্তানদের জেগে থেকে অধিকার আদায় করতেই হবে। এটাই প্রথম ও প্রধান কাজ।
আপনি নিশ্চয়ই জেনেছেন আমাদের বাংলাদেশের একটি নদ তুরাগকে মহামান্য হাইকোর্ট লিগ্যাল পার্সন ঘোষণা করেছে?
হ্যাঁ জানি। মহামান্য হাইকোর্টের এটা গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান। রবিবারে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া যাবে।তাকিয়ে আছি সেই দিকে। এর ফলে নদীর অধিকারের জন্য লড়াই একটা স্বীকৃতি পেল। নদীকর্মীরা নতুনভাবে উৎসাহিত হলো। এখানে আমি বলবো শুধু তুরাগ নদ না সব নদীরই প্রাণ আছে। সব নদীই জীবন্ত সত্ত্বা।এই রায় দিতে হবে। আর সরকারকে সেই রায়কে যে কোন মূল্যেই কার্যকর করতে হবে। নদী কর্মীরা সর্বস্তরের মানুষকে এই লড়াইয়ে সামিল করবার জন্য বিবিধ উদ্যোগ নেবেন। তবেই সুদিন আসবে। আর সেই সুদিন আসা খুব জরুরী। উন্নততর বাংলাদেশের জন্য। উন্নততর ভবিষ্যতের জন্য ।
নদী নিয়ে আগামী দিনে আপনার পরিকল্পনা জানতে চাই
নদী দিয়ে আগামীদিনে সমস্ত স্তরের মানুষকে জাগাতে চাই। ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশকে জুড়তে চাই। আত্রেয়ীর পাড় থেকেই আত্রাই ও অন্য নদীগুলির বন্ধনের মাধ্যমে একে অপরের লড়াইকে থামিয়ে শান্তির বার্তা দিতে চাই। আর এই কাজে প্রধান সেনানী করতে চাই ছাত্রীদের। ইতিমধ্যেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ তৈরি হয়েছে। একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য ।
রিভার বাংলাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
আপনাকে এবং রিভার বাংলা কেও অসংখ্য ধন্যবাদ। রিভার বাংলা নিজেই নদী আন্দোলন হয়ে উঠবে আমার বিশ্বাস। নদী চেতনা বৃদ্ধিতে আপনাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল।